Read Time26 Minute, 30 Second
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালাব্যামা অঙ্গরাজ্যে বার্মিংহ্যাম নামের এক শহর আছে। সেখানে অবস্থিত অ্যালাব্যামা বিশ্ববিদ্যালয়ের (সংক্ষেপে ইউএবি) পুষ্টি বিভাগে গেল ডিসেম্বরে আবেদন করেছিলাম পিএইচডি অ্যাডমিশনের জন্য। সেই ২০১৪ সাল থেকে ইউএবির পুষ্টি প্রোগ্রামের দিকে আমার শ্যেন দৃষ্টি। ২০১৪ একটা বিশেষ বছর কারণ ঐ বছর থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আসার পরিকল্পনা শুরু করি আমি। তো, ২০১৫ সালের ফল সেশনে পিএইচডিতে ভর্তির জন্য ইউএবির পুষ্টি বিভাগের প্রফেসরদের ইমেইল দিয়েছিলাম। কেউ উত্তর দেননি। অবশেষে একজন বলেছিলেন, এখানে সেন্ট্রাল অ্যাডমিশন হয়। অর্থাৎ প্রফেসরদের নক দিয়ে লাভ নেই। কেন্দ্রীয়ভাবে আমার অ্যাডমিশন হলেই কেবলমাত্র পছন্দের প্রফেসরের সাথে কাজ করার সুযোগ মিলবে। যিনি উত্তর দিয়েছিলেন, অস্বীকার করব না তার চেহারা কিছুটা অদ্ভুত লেগেছিল। টাক মাথা, মোটা মোটা ঠোঁট, চোখ দুটো ঢুলুঢুলু। ওয়েবসাইটে দেওয়া ছবি দেখেই মানুষটাকে বিচার করে ফেলেছিলাম। ভাবছিলাম বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নাকি? ঐ ধরনের চিন্তাভাবনার জন্য এখন খুব লজ্জা লাগে। তবে এটাও ঠিক, আমি বেরিয়ে আসতে পেরেছি ঐ মানসিকতা থেকে। আমার মাথায় ঐসব চিন্তা আসার পেছনে সমাজ, শিক্ষা, সঙ্গ – অনেক কিছুই ভূমিকা রেখেছিল। তাই স্বশিক্ষিত হোন। যতদিন না কেউ স্বশিক্ষিত হয়, অর্থাৎ নিজেকে নিজে শিক্ষিত করে, ততদিন মানসিক সংকীর্ণতা থেকে বের হওয়া যায় না।
.
যা হোক, ২০১৬ সালে আবার আমি ইউএবির প্রফেসরদের ইমেইল দেওয়া শুরু করি। যদি কেউ দয়াপরবশ হয়ে আমাকে নিতে চান! কিন্তু যেই লাউ, সেই কদু। এক প্রফেসর বললেন, ‘তুমি প্রোগ্রামের পরিচালকের সাথে যোগাযোগ কর। উনি তোমাকে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে দিক নির্দেশনা দিতে পারবেন।’ বুঝলাম, সরাসরি কেউ আমাকে রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে নেবেন না। তারপরও ২০১৭ সালে আবার নক দিলাম। বুঝতেই পারছেন কতটা ইচ্ছে ছিল এই প্রোগ্রামে যাওয়ার। ভাবতে পারেন, নক না দিয়ে সরাসরি আবেদন করে ফেললেই তো হয়। হ্যাঁ, তাই করলাম ২০১৮ সালে। তবে পিএইচডিতে নয়, মাস্টার্সে। মাথায় ঘুরছিল, আমার প্রোফাইল পিএইচডির জন্য উপযুক্ত নয়। মাস্টার্সের জন্য হলেও হতে পারে। আর যেহেতু কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি করে, সেহেতু ৫০-৫০ সুযোগ নেওয়াই যায়। আশায় বুক বেঁধে আবেদন করে ফেললাম। কিন্তু দুঃসংবাদ এল। সুযোগ পাইনি। কিন্তু একই বছর সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুষ্টির উপর মাস্টার্স করার সুযোগ এল। ফলে অ্যালাব্যামা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পাওয়াটা বেশি কষ্ট দিতে পারল না।
.
সেন্ট লুইসে দেখতে দেখতে দেড় বছর কেটে গেল। এবার আবেদন করতে হবে পিএইচডিতে। মাস্টার্সের পর পিএইচডিতে আবেদন করাটা বাধ্যতামূলক নয়। তবে আমার যেহেতু খুব ইচ্ছা পিএইচডি করার, আমার জন্য এটা বাধ্যতামূলক। সেই আবেদন করতে গিয়েও চোখ খালি চলে যায় ইউনিভার্সিটি অফ অ্যালাব্যামা অ্যাট বার্মিংহ্যামে। কী মুশকিল! তবে এবার যেহেতু ঝুলিতে একটা মার্কিন ডিগ্রি আছে, সাহস করে আবেদন করেই ফেললাম। তারপর “রাত যায় দিন আসে, এক্সেপ্টেন্স লেটার আসে না… আ… আ…আ” (সামিনা চৌধুরীর কণ্ঠে)।
.
সেদিন ছিল ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২০। আমার জন্মদিনের আগের দিন। দুপুর দুটো বাজে। পড়াশোনা করছি আর ফেসবুক ঘাঁটছি। হঠাৎ মোবাইলটা হাতে নিয়ে জিমেইল খুললাম। সে সময় আমার এমন অবস্থা, দিনে চব্বিশবার ইমেইল চেক করি। ৬ জায়গায় আবেদন করেছি। কোথাও থেকে কি রিপ্লাই এল? দেখি, ঠিকই ইউএবি থেকে একটা ইমেইল এসেছে। হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি একটা মিস হয়ে গেল। হড়বড় করে মেইলটা পড়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। দৌড়ে গেলাম প্রিন্সের কাছে। ওকে মোবাইলটা দিয়ে লাফাতে থাকলাম। না পাঠক, আমাকে পিএইচডিতে ভর্তি করা হয়নি। শুধু টপ ক্যান্ডিডেটদের একজন হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে। এদেরকে এখন ক্যাম্পাসে নিয়ে যাওয়া হবে। নেওয়া হবে সামনাসামনি সাক্ষাৎকার। তারপরই জানা যাবে কাকে পিএইচডিতে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। সেই ২০১৫ সাল থেকে ইউএবির পিছে লাগা শুরু। এতদিনে অন্তত টপ ক্যান্ডিডেট পর্যন্ত আসতে পারলাম। কম কী, বলুন?
.
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, ইমেইলটা এসেছিল ডঃ হোসে ফার্নান্দেজের কাছ থেকে, কারণ তিনি পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের পিএইচডি প্রোগ্রাম ডাইরেক্টর। এই লোক যে একসময় আমার জীবনের সেরা কিছু মুহূর্তের সঙ্গী হয়ে থাকবেন, সেটা কি ২০১৪ সালে ভেবেছিলাম? জীবন কত অদ্ভুত! ইমেইলে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল অন-ক্যাম্পাস ইন্টার্ভিউ দেওয়ার জন্য আমি অ্যালাব্যামা যেতে রাজি কিনা। আঃ মরণ! এটা আবার জিজ্ঞেস করতে হয়? দরকার পড়লে নিজের খরচে যাব, তারপরও এমন স্বর্ণালী সুযোগ হাতছাড়া করব না। তাই কবুল বলে দিলাম। যতদূর জানি, অন-ক্যাম্পাস ইন্টার্ভিউয়ে ডাকলে ভার্সিটিই সমস্ত খরচ বহন করে। বিমানের টিকেট কাটা থেকে শুরু করে হোটেলে থাকা, তিন বেলা খাওয়া, আশেপাশে ট্যুর দেওয়া – সবকিছু। তারপরও আমি জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে নিলাম যে, আমাকে কোনো খরচ করতে হবে না। মিশেল গোল্ড নামের এক ভদ্রমহিলা হলেন আমার পথ প্রদর্শক। মিজৌরি থেকে অ্যালাব্যামা যাওয়া, থাকা, খাওয়া, সাক্ষাৎকারের সময়সূচী হাতে পাওয়া, হোটেল থেকে ইউএবিতে যাওয়া আসা করা, সমস্ত কিছুর দায়িত্বে উনি। যেকোনো প্রশ্নের জন্য উনার কাছে ধর্না দেওয়া জায়েজ।
.
কিছুদিন পর মিশেল একটা ইমেইল পাঠালেন। স্মরণীয় ইমেইল। ইউএবির ‘গ্র্যাজুয়েট বায়োমেডিকেল সায়েন্স ডক্টরাল ট্রেনিং প্রোগ্রাম’ একটা ডিনারের আয়োজন করেছে প্রার্থীদের জন্য। প্রার্থী মানে এই প্রোগ্রামের আওতায় যাদেরকে ক্যাম্পাসে সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়েছে, তাদের। এর মধ্যে আমিসহ পুষ্টির বাকি তিনজন প্রার্থীও পড়েছি। সবাইকে নিয়ে যাওয়া হবে হিল্টন হোটেলে। শুনেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। সারাজীবন হিল্টন হোটেলের নামই শুনে এলাম। কখনো যাওয়া হবে, ভাবিনি। এখন দেখছি মেঘ না চাইতেই জল। মিশেল লিখেছেন, ডিনারে তিন ধরনের মূল খাবার পরিবেশিত হবে। Seasonal Vegetable Portobello Mushroom Entrée, Rosemary Chicken: Grilled Breast of Chicken with Fresh Rosemary and Red Currant Glaze, এবং Citrus Ginger Black Cod: Steamed Cod Filet with Ginger and Citrus Pan Jus । আমি কোনটা খেতে চাই, সেটা যেন উনাকে জানাই। পড়ে কিছুক্ষণ তব্দা মেরে রইলাম। এটা আবার কেমন জিজ্ঞাসা? খাওয়ার মত এত সাধারণ একটা ব্যাপারেও ইমেইল দিতে হবে? এতদিন ধরে যেসব দাওয়াতে গিয়েছি, যা দিয়েছে তাই খেয়েছি। এখানে এত ঢং করছে কেন? তাছাড়া তিনটার একটা খাবারও আমার পরিচিত নয়। পছন্দ করতে গিয়ে বিপদে পড়লে? দেখা গেল মুখেই রুচছে না। তখন কি আরেকটা অর্ডার করতে পারব? কয়েক মুহূর্ত পর খেয়াল হল, ওরা আমার পছন্দ অপছন্দ কত গুরুত্ব দিয়ে দেখছে! এত বড় একটা ব্যাপার অথচ আমি করছি কুমালোচনা। গুগলে সার্চ দিয়ে দেখলাম কোন খাবার দেখতে কেমন। কড মাছের পদটা দেখে গা গুলিয়ে উঠল। তাছাড়া আমিষ থাকলে আমি নিরামিষ খেতে চাই না। ফলে রোজমেরি চিকেনটাকেই বেছে নিলাম। মুরগীর মাংস বলে কথা। খারাপ হলেও কতই বা খারাপ হবে?
.
সবকিছু স্বপ্নের মত লাগছে। ২০১৪ সালে যখন প্রথম পরিচয় ঘটেছিল ফেসবুকের হায়ার স্টাডি অ্যাব্রোড গ্রুপের সাথে, সেখানে কিছু লেখা পড়েছিলাম অন-ক্যাম্পাস ইন্টার্ভিউ নিয়ে। কিছু ভার্সিটি আছে যারা প্রাথমিক বাছাইয়ের পর একটা ছোট তালিকা করে চূড়ান্ত প্রার্থীদের নিয়ে। এরা সবাইকে পিছনে ফেলে উঠে আসা আবেদনকারীর দল, যাদের সাথে ভার্সিটি কাজ করতে ইচ্ছুক। তাই এদের অন-ক্যাম্পাস সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য ঐসব ভার্সিটি প্রতি বছর কিছু ডলার বরাদ্দ রাখে। সেই ডলার দিয়ে টপ ক্যান্ডিডেটদের উড়িয়ে আনে, দুই-তিনদিন নামীদামী হোটেলে রাখে, সাক্ষাৎকার নেয়, ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখায়, শেষে শহরের দর্শনীয় স্থানে নিয়ে যায়। এসব পড়ে কতদিন যে চোখের জল ফেলেছি, ইয়ত্তা নেই। কী যে ভালো লাগত এসব পড়তে! ফ্যান্টাসির জগতে হারিয়ে যেতাম। সাথে হীনমন্যতাও জেঁকে ধরত। কই, আমার তো কিছু হচ্ছে না? কখনো কি হবেও না? অভূতপূর্ব ২০২০ সালে তাই অ্যালাব্যামা থেকে এই সুযোগ পাওয়ার পর নস্টালজিক হয়ে গেলাম। বারবার ভেসে উঠতে লাগল ২০১৪-১৫ সালের নির্ঝরের মুখ। কখনো কি সে ভেবেছিল, একদিন তাকেও উড়িয়ে নিয়ে যাবে এক ভার্সিটি? সে জায়গা করে নেবে প্রথম চারজন প্রার্থীর তালিকায়?
.
এরপর শুরু হল লাগাতার ইমেইল চালাচালি। একদিন চলে এল হোটেল রিজার্ভেশনের ডকুমেন্ট। রেসিডেন্স ইন নামের হোটেলে আমাকে থাকতে হবে। এই হোটেল ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির অংশ। ম্যারিয়টের নাম প্রচুর শুনেছি। এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হোটেল চেইন। তারই একটা ব্র্যান্ডে থাকব বলে বেশ পুলকিত হলাম। এমনিতে আমার হোটেল বিলাস নেই। সিলেটে ঘুরতে গিয়ে ছাপড়া হোটেলেও থেকেছি। কিন্তু যখন বিনামূল্যে বড় বড় হোটেলে খাওয়া কিংবা থাকার মওকা মিলে, ভালোই লাগে। নতুন নতুন সব অভিজ্ঞতা হয়। এখন পর্যন্ত কম অভিজ্ঞতা হয়নি! প্রথম প্রথম চটকদার হোটেলে গিয়ে পশ লোকজন দেখে পালিয়ে যেতে মন চাইত। মনে হত আমি এখানে অবাঞ্ছিত। না আছে ওদের মত হাল ফ্যাশনের জামা, না আছে ঐ চিবুক উঁচানো ভঙ্গি। কিন্তু আমার প্রাক্তন বস মনিকা বারিগোজ্জি আমাকে শিখিয়েছিল কীভাবে ত্যানা ত্যানা জামা পরেই পাঁচ তারা হোটেলে গিয়ে মিটিং করা যায়। ওরে বাপ! সে একখান চিজ ছিল বটে। টেক্সটাইল সেক্টরের কেউকেটা ছিল অথচ জামাকাপড় পরত নেতানো, রঙ উঠা। একই টিশার্ট তাকে দেখেছি চার বছর ধরে পরতে। শার্ট হলেও কথা ছিল। কিন্তু টিশার্ট চার বছর পরলে সেটার কী অবস্থা হয়, কল্পনা করে নিন। সেই টিশার্ট পরে সে চলে গেল র্যাডিসনে, অফিসের বাৎসরিক ডিনার পার্টিতে। অথচ একই পার্টিতে যাওয়ার জন্য আমি নতুন জামা কিনেছিলাম। মনিকা শিখিয়েছিল, অ্যাটিটিউডই সব।
.
চট করে হোটেলের ওয়েবসাইটে গিয়ে আমার রুমের ছবিগুলো দেখে নিলাম। স্টুডিও কিং সুইট। একটা কিং সাইজের বিছানা, বিশাল টিভি, ছোট্ট লিভিংরুম, পুরোদস্তুর রান্নাঘর (মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ফ্রিজ, থালা বাটি), লেখাপড়ার জন্য টেবিল-চেয়ার, আর একটা ওয়াশরুম। ছবি দিলাম, দেখে নিন। হুবহু এই ঘরেই ছিলাম আমি। ঘরটা আমার খুবই পছন্দ হয়েছিল কারণ আমি আর প্রিন্সও একটা স্টুডিও এপার্টমেন্টে থাকি। আমাদের এপার্টমেন্ট এই হোটেল ঘরের চেয়েও ১৩০ বর্গফুট বড়। তারপরও আমরা সেটাকে এত সুন্দরভাবে সাজাতে পারিনি। সাধে কি আর ইন্টেরিওর ডিজাইনারদের এত দাম হয়? ঘর ভর্তি রুচিশীল জিনিসপত্র, অথচ সেগুলো কোথায় ফিট হবে, কোথায় রাখলে সৌন্দর্য ফুটে উঠবে, এগুলো সবাই বুঝে না। যেমন, আমি। অন্য কারো বাসার সাজসজ্জা দেখলে মনে হয়, আমিও তো এভাবে নিজের বাসাটা সাজাতে পারি? কিন্তু বাসায় এলেই মাথা আউলে যায়। বুঝতে পারি না কীভাবে সাজাব।
.
মিশেল আমাকে বললেন, আমি যদি বিমানবন্দরে খানাপিনা করি কিংবা ট্যাক্সি ধরে হোটেলে আসি, তাহলে সেই খরচ ইউএবি ফেরত দিবে। এজন্য একটা ওয়েবসাইটে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। করে ফেললাম। এরপর বললেন, আমার সাথে চারজন প্রফেসরের মিটিং ঠিক করা হচ্ছে। আমি কি এই তালিকায় আরও কারো নাম যোগ করতে চাই কিনা। দেখলাম, আমার স্টেটমেন্ট অফ পারপাসে যাদের কথা লিখেছিলাম, তাদের সাথেই মিটিং ধার্য করা হয়েছে, শুধু একজন বাদে। জিজ্ঞেস করলাম, উনাকে কি যোগ করা যায়? মিশেল বললেন, উনি ম্যাটার্নিটি লিভে আছেন তাই সম্ভব হবে না।
.
এরপর একদিন চলে এল সাক্ষাৎকারের চূড়ান্ত সময়সূচী। অবাক হয়ে দেখলাম, মোট আটজনের সাথে আমার ইন্টার্ভিউ। কয়েকদিন ধরে অভিজ্ঞদের সাথে কথা বলে অন-ক্যাম্পাস ইন্টার্ভিউ সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কেউই বলেননি চারজনের বেশি প্রফেসরের সাথে ইন্টার্ভিউয়ের কথা। আমার বেলায় এ কি গ্যাঁড়াকল? ইউএবি দেখি সবদিক দিয়েই প্রতিযোগিতা কঠিন করে রেখেছে। যা হোক, বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচ্যগ্র মেদিনী। আটজন প্রফেসরকে মোকাবেলা করতে হবে তো? প্রস্তুতিও নেব সেইরকম।
.
ইউএবি আমাকে ডেকেছে ফেব্রুয়ারির ২৭-২৯ তারিখ পর্যন্ত। ২৯ তারিখ মানে অধিবর্ষ। খুব শখ ছিল অধিবর্ষটা প্রিন্সের সাথে কাটাব। ফেব্রুয়ারি আমার জন্ম মাস, বিয়ের মাস। তাই ফেব্রুয়ারির ব্যাপারগুলো আমাকে বেশ আবেগী করে। অধিবর্ষটাও এমনই এক ব্যাপার। তবে মন খারাপ কাটানোর জন্য ভেবে নিলাম, ইউএবি থেকে যে ডাক এসেছে ফেব্রুয়ারিতে, এটাও তো একটা বিশেষ ঘটনা। ডঃ ফার্নান্দেজ আমাকে শুরুতেই বলেছিলেন, ইন্টার্ভিউয়ের তারিখ বদল করা যাবে না। আমার যদি ২৭-২৯ তারিখে ইন্টার্ভিউ দিতে কোনো সমস্যা হয়, তারা সেটা অন্যভাবে সমাধান করার চেষ্টা করবেন কিন্তু এই তারিখ পেছানো বা আগানো যাবে না। যেহেতু ২৭ তারিখ থেকে সাক্ষাৎকার শুরু, সাধারণ জ্ঞান বলে, ইউএবি অন্তত একদিন আগে অর্থাৎ ২৬ তারিখে ফ্লাইট বুক করতে চাইবে। সমস্যা হল, ২৬ তারিখ সন্ধ্যা সাতটার পিডিয়াট্রিক ক্লাসে আমার একটা প্রেজেন্টেশন আছে। সেটা একক হলে আমি তারিখ বদলের চেষ্টা করতাম। কিন্তু সেটা দলীয়। আমার জন্য বাকি দুইজনের প্রস্তুতিতে তো আমি বাগড়া দিতে পারি না! কীভাবে দুইদিক সামাল দেওয়া যায় ভাবতে ভাবতে অর্ধেক দিন পার হল। অবশেষে ঠিক করলাম, মিশেলকে অনুরোধ করব আমার ফ্লাইট ২৭ তারিখ ভোরে দেওয়ার জন্য। খুব ভোরে যদি রওনা দিই, সকাল দশটার আগে অ্যালাব্যামা থাকব। আশা করি, সাক্ষাৎকার সকাল নয়টা থেকে শুরু হবে না। একইসাথে কোর্স ইন্সট্রাক্টরকে পুরো ব্যাপারটা জানাব, সমাধান দিতে বলব। দেখি কার জবাব আগে আসে। মিশেল যদি রাজি হন ২৭ তারিখে টিকেট কাটতে, তাহলে সাপও মরল লাঠিও ভাঙল না। কিন্তু যদি সেটা সম্ভব না হয়, তাহলে ইন্সট্রাক্টরের দেওয়া সমাধান অনুযায়ী পথ হাঁটতে হবে।
.
পরদিনই ইন্সট্রাক্টর জবাব দিলেন। আমার ইন্টার্ভিউয়ের কথা শুনে উনি যারপরনাই আনন্দিত। শুভ কামনাও জানালেন। বললেন, আমি চাইলে এককভাবে প্রেজেন্ট করতে পারি। তবে সেক্ষেত্রে আমার প্রেজেন্টেশনের দিন চলে আসবে এক সপ্তাহ আগে, অর্থাৎ ১৯ তারিখে। ১৯ তারিখ মানে হাতে মাত্র সাতদিন আছে প্রস্তুতি নেওয়ার। কী ভেজাল! কিন্তু রাজি না হয়েও উপায় নেই। এদিকে মিশেলের উত্তর আসে না তো আসেই না। এর মানে কি উনারা ২৭ তারিখে পারবেন না? আমাকে একক প্রেজেন্টেশনই দিতে হবে? দলীয় কাজ হঠাৎ করে একক কাজে রূপান্তরিত হলে ব্যাপারটা ভীতিকর। আমারও ভয় ভয় করতে লাগল। কিন্তু চারদিন পর দেখি মিশেল ইমেইলে টিকেট পাঠিয়ে দিয়েছেন। ২৭ তারিখ সকাল সাতটায় সেন্ট লুইস থেকে প্লেন ছাড়বে। সেটা বার্মিংহ্যামে পৌঁছাবে সকাল সাড়ে দশটায়। আর প্রফেসরদের সাথে মিটিং শুরু হবে দুপুর একটা থেকে। বাঁচোয়া! তড়িঘড়ি ইন্সট্রাক্টরকে জানালাম যে, আমি দলীয় প্রেজেন্টেশনই দিতে পারব।
.
পরবর্তী সমস্যা হল, ফর্মাল জামাকাপড় আমার নেই বললেই চলে। আমি পরতে পছন্দ করি না, দরকারও পড়েনি। টুকটাক যেসব প্রেজেন্টেশন দিয়েছি এতদিন, সেগুলোতে ১০০% ফর্মাল পোশাক না পরেই চলে গেছে। কিন্তু ইউএবিতে ঝাক্কাস ধরনের ফর্মাল পোশাক না পরলে আমাকে মেনে নেবে কিনা, কে জানে। তাই খুঁজতে বসলাম। সুটকেস ঘেঁটে মোটামুটি মানের দুটো পোশাক পেয়েও গেলাম। সেগুলো ইস্ত্রি করলাম। যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর এই প্রথম জামা ইস্ত্রি করছি। এমন হাসি পাচ্ছিল! মাত্র পাঁচ ডলারে বিকোচ্ছে দেখে টেবিলসহ ইস্ত্রি কিনে ফেলেছিলাম। কিন্তু সেটা অপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ছাড়া কিছু ছিল না। এতদিনে জিনিসটার উপযোগিতা পেলাম। ছোট একটা লাগেজে দুই-তিনদিনের ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু ভরলাম। আমার অভ্যাস হল, একদম শেষ মুহূর্তে গোছগাছ করা। কিন্তু এবার এক সপ্তাহ আগেই গুছাতে বসলাম। এক ভাইয়ের কাছ থেকে জানলাম, এক অঙ্গরাজ্য থেকে আরেক অঙ্গরাজ্যে গেলে সাথে আই-২০ রাখা উচিৎ। এটাই যুক্তরাষ্ট্রে আমার বৈধভাবে থাকার দলিল। তাই যক্ষের ধনের মত আই-২০ আগলে রাখলাম সুটকেসের গোপন কুঠুরিতে। যাওয়ার ঠিক আগে ভরতে হবে ল্যাপটপ আর চার্জার। সেটা মোবাইলে এলার্ম দিয়ে রাখলাম। নতুবা দেখা যাবে ল্যাপটপ আর মোবাইল নিয়েছি, চার্জার আনিনি।
.
এবার শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা। সাথে চলছে সাক্ষাৎকার মোকাবেলার প্রস্তুতি। ইউএবির পুষ্টি বিভাগের ওয়েবসাইট প্রায় মুখস্ত করে ফেলেছি। ভর্তি, পিএইচডি ক্যারিয়ার আর গবেষণা নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্নও টুকে রেখেছি। প্রশ্ন না করলে ওরা ধরে নেবে আপনার কৌতূহল নেই। আর কৌতূহলহীন পিএইচডি শিক্ষার্থী কে চায়? যে আটজন প্রফেসরের সাথে আমার মিটিং, সবার রিসার্চ প্রোফাইল ঘেঁটে, সিভি দেখে তাদের সম্পর্কে জানাটা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এই করতে করতে দেখি ২৬ তারিখ চলে এসেছে। সে রাতে ক্লাসে ধুন্ধুমার প্রেজেন্টেশন দিলাম। অ্যালাব্যামা যাওয়ার জোশে একটু বেশিই ভালো হয়ে গেল। তারপর বাসায় এসে শেষবারের মত লাগেজ চেক করতে বসলাম। তালিকা বানিয়েছিলাম কী কী নিতে হবে। সে অনুযায়ী মিলিয়ে দেখলাম। সকাল সাতটায় যেহেতু ফ্লাইট, আমাকে বিমানবন্দরে পৌঁছাতে হবে অন্তত এক ঘণ্টা আগে। ঘুম থেকে উঠতে হবে আরও এক ঘণ্টা আগে, ভোর পাঁচটায়। সাড়ে পাঁচটায় বাসা থেকে কীভাবে বিমানবন্দরে যাব সেটা নিয়ে বেশ দ্বিধায় ছিলাম। উবার ডাকব, নাকি ট্রাম ধরে চলে যাব? উবারে খামাখা বেশি টাকা যাবে। এরচেয়ে ট্রাম ধরে যাওয়া ভাল। তবে ট্রামে উঠার জন্য হাঁটা লাগবে বিশ মিনিট। সুটকেস টানতে টানতে বিশ মিনিট হাঁটা বেশ ঝামেলার। প্রিন্স সুটকেস টানার অভয় দিল। আমাকে শুধু পা চালিয়ে সময়মত স্টেশনে যেতে হবে। প্রিন্সের তুলনায় আমি একটু ধীরে হাঁটি। ও বিশ মিনিট হিসেব করে বাসা থেকে বের হলে বিশ মিনিটেই স্টেশনে পৌঁছায়। কিন্তু আমি পঁচিশ মিনিট বা তার বেশি লাগিয়ে ফেলি। এজন্য আমাকে নিয়ে ওর চিন্তা। পাঁচ মিনিটও যদি দেরি হয়, আপনি মিস করবেন কাঙ্ক্ষিত ট্রাম, কারণ ওগুলো স্টেশনে মাত্র এক মিনিটের মত দাঁড়ায়। আপনাকে তখন বিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী ট্রামের জন্য।
.
পর্ব দুই এখানে