পর্ব এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ
(২৫)
প্রথম সেমিস্টারে একটা অনলাইন কোর্স নিয়েছি। কোর্সের নাম ফাউন্ডেশন্স অফ আউটকামস রিসার্চ। ক্লাসরুমের বালাই নেই, ঘরে বসে লেকচার শোন, ঘরে বসে পরীক্ষা দাও। দারুণ মজা। দেখতে দেখতে ক্লাস শুরুর সময় চলে এল। ক্লাস শুরুর তিনদিন আগে খেয়াল হল, আমি জানি না কীভাবে অনলাইনে ক্লাস করতে হয়। ভার্সিটির ওয়েবসাইট ঘেঁটে ফালাফালা করে ফেললাম। সব জায়গায় লেখা – আইডি, পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে স্লু পোর্টালে লগইন কর, ব্ল্যাকবোর্ড লার্ন নামের টুলে যাও, সেখানেই পাবে অনলাইন লেকচার। কিন্তু ব্ল্যাকবোর্ডে ঢুকেও আমি ক্লাস করার পদ্ধতি বুঝতে পারছি না। হন্যে হয়ে কোর্স ইন্সট্রাক্টরকে ইমেইল করলাম। জানতে চাইলাম, ব্ল্যাকবোর্ডে ঢুকার পর আমাকে কী করতে হবে। উনি দেখা করতে বললেন। সরাসরি বুঝিয়ে দেবেন কীভাবে ক্লাস করতে হয়। স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর জীবনে আমি প্রফেসরদের এড়িয়ে চলেছি। সবসময় নিরাপদ দূরত্বে থেকেছি। রাস্তায় কাউকে আসতে দেখলে খাম্বার আড়ালে লুকিয়েছি। সেই আমি যাব প্রফেসরের সাথে দেখা করতে? তাও আবার বৈদেশী প্রফেসর? কভি নেহি।
গেলাম ক্লাসমেট ক্লেয়ারের কাছে। ও গত বছরের ফল সেশনে এখানে ভর্তি হয়েছে। আমার এক বছরের সিনিয়র। কিন্তু মেটাবোলিজম ক্লাস আমরা একসাথে করি বলে ঐ সূত্রে ক্লাসমেট। আমেরিকার ভার্সিটিগুলোর শিক্ষা পদ্ধতি দেশের তুলনায় অন্যরকম। এখানে একটা প্রোগ্রামের অধীনে যেসব কোর্স থাকে সেগুলো স্টুডেন্টরা তাদের ইচ্ছেমত যেকোনো টার্মে নিতে পারে। আমাদের দেশে যেমন প্রথম বর্ষে প্রাণ রসায়ন, দ্বিতীয় বর্ষে বিপাক ক্রিয়া এভাবে নির্দিষ্ট করা, এখানে তা নয়। এখানে কেউ ইচ্ছে হলে প্রথম সেমিস্টারে বিপাক ক্রিয়া, দ্বিতীয় সেমিস্টারে অন্য কিছু, আর তৃতীয় সেমিস্টারে প্রাণ রসায়ন নিতে পারে। মোট কথা, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সব কোর্স শেষ করতে পারলেই হল, যখনই নিন না কেন। তবে এটা ঠিক, সব সেশনে সব কোর্স পাবেন না। কিছু কোর্স থাকে যেগুলো শুধুমাত্র ফলে পড়ানো হয়। এভাবে আরও কিছু কোর্স থাকে যেগুলো শুধুমাত্র সামারে পড়ানো হয়। আবার কিছু কোর্স শুধু স্প্রিংয়ে। এগুলোর বেলায় ঝামেলা আছে। যেগুলো শুধু ফলে পড়ানো হয়, সেগুলো আপনি সামারে পাবেন না। একইভাবে সামাররটা পাবেন না স্প্রিংয়ে। তবে কিছু কোর্স থাকে যেগুলো ফল, সামার, স্প্রিং সবসময় পড়ানো হয়।
ক্লেয়ারকে জিজ্ঞেস করলাম কীভাবে ব্ল্যাকবোর্ড থেকে অনলাইন ক্লাস করতে হয়। ও বুঝিয়ে দিল। ‘ব্ল্যাকবোর্ড লার্ন’ হল ভার্চুয়াল শিক্ষা ব্যবস্থা। শ্রেণীকক্ষের বিকল্প। এখানে শিক্ষকরা লেকচার রেকর্ড করে রাখতে পারেন, যেগুলো স্টুডেন্টরা নিজেদের ইচ্ছেমত সময়ে শুনতে পারে। প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট আপলোড করে রাখা যায় যেগুলো স্টুডেন্টরা ডাউনলোড করতে পারে। আছে ক্লাসের সব স্টুডেন্টের একসাথে আলাপ আলোচনা করার ব্যবস্থা। এই আলাপ অবশ্য মুখে মুখে নয়, বরং লিখে লিখে হয়। আপনার মন্তব্য আরেকজন দেখতে পারবে, সেটার প্রত্যুত্তরও দিতে পারবে। অনলাইন ফোরাম আর কি। আপনি অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে পারবেন, শিক্ষক আপনার গ্রেড আপলোড করতে পারবেন। মোট কথা, আপনার পড়াশোনা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য ব্ল্যাকবোর্ড থেকে পাওয়া যাবে। শুধু অনলাইন ক্লাসই নয়, ক্লাসরুমে যেসব ক্লাস হয় সেসব ক্লাসের গ্রেডও ব্ল্যাকবোর্ডে আপলোড করা হয়। বললাম না, আপনার কোর্স সংক্রান্ত সব রেকর্ড ব্ল্যাকবোর্ডে তোলা থাকে?
ক্লেয়ারের কাছ থেকে বুঝে নিয়ে প্রফেসরকে ইমেইল দিয়ে বললাম, সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। ঘটনার দুইদিন পর আমাদের প্রথম ক্লাস হল। প্রফেসর কোনো লেকচার আপলোড করলেন না। শুধু একটা ডিসকাশন থ্রেড খুলে বললেন আমরা যেন নিজেদের নাম, পরিচয়, শখ ইত্যাদি সম্পর্কে দু’কলম লিখি। এতে করে ক্লাসের ত্রিশজন স্টুডেন্ট পরস্পরের সাথে ভার্চুয়ালি পরিচিত হতে পারবে। আলাপ শুরু করলেন প্রফেসর নিজেই। উনি বর্তমানে কী করছেন, কীসের উপর পড়াশোনা করেছেন ইত্যাদি বলে চলে গেলেন ব্যক্তিগত তথ্যে। উনার তিনটা বাচ্চা। তিনটার বয়সই দশের নিচে। ছুটির দিনে উনাকে বাচ্চাদের সাথে সকার আর গলফ খেলতে হয়। বর্তমানে তিন বাচ্চাই নাচ শিখছে। ছুটির দিনে প্রফেসরকে ওদের সাথে নাচতেও হয়। পড়ে আমি থতমত খেয়ে রইলাম। একজন প্রফেসর যে এভাবে ব্যক্তিগত কথা শেয়ার করতে পারেন, চিন্তাই করিনি। এরপর দেখি একে একে বাকিরা পরিচয় দেওয়া শুরু করেছে। জর্জ নামের এক কর্পোরেট অফিসার ষোল বছর পর লেখাপড়ায় ফিরেছে, সাঈদ নামের একজন কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার পদ থেকে সাময়িক বিরতি নিয়ে সেন্ট লুইসে পড়তে এসেছে, ক্যারি নামের এক মহিলা স্লুর হাসপাতালে ক্যান্সার সার্জন হিসেবে চাকরি করছে এবং হেলথ ডাটা সায়েন্সের উপর পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। ব্রাইস কাটলারের লেখা থেকে তার দুঃখ সম্পর্কে জানলাম। সে যে একটা মেয়ে, এটা কেউ বুঝে না তার নাম দেখে। জুয়ানজুয়ান ইয়াংয়েরও একই দুঃখ। আমাকে সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য করল এমিলি নামের এক মেয়ে। সে ফার্মেসির উপর পিএইচডি করেছে। এরপর দুই বছরের ফার্মেসি রেসিডেন্সি করেছে, এরপর করেছে দুই বছরের ক্রিটিকেল কেয়ার রেসিডেন্সি। চাকরি করছে সেন্ট লুইসের খুব বিখ্যাত এক হাসপাতালে। ওর প্রাতিষ্ঠানিক পদের নাম ‘Critical Care Clinical Pharmacy Specialist’। তারপরও ওর পড়ার খায়েশ মেটেনি। এখন এসেছে হেলথ ডাটা সায়েন্সের উপর পড়তে। বসনিয়া, সিরিয়া, ভারত, চীন , বাংলাদেশ, সৌদি আরব – সবখান থেকেই স্টুডেন্ট আছে এই কোর্সে। পুরোপুরি বহুজাতিক!
বহুজাতিকতা আছে ‘নিউট্রিশন ইন মেটাবোলিজম এন্ড ফিজিওলজি’ কোর্সেও। শ্রেণীকক্ষ এবং অনলাইন, দুই জায়গাতেই এই ক্লাস নেওয়া হয়। প্রথমদিন ক্লাসে গিয়ে আমি হতচকিত। সারাজীবন বাংলাদেশী স্টুডেন্টদের সাথে ক্লাস করে ক্লাসে দেশী চেহারা দেখেই অভ্যস্ত আমার চোখ। হঠাৎ এতগুলো বিদেশী ক্লাসমেট দেখে ঠিক হজম করতে পারছি না। পেছন দিককার চেয়ারগুলো সব দখলে। সামনের সারির কয়েকটা চেয়ার খালি। দুটো কলামের মাঝ দিয়ে যাওয়ার সময় নিজেকে খুব একা মনে হল। আমি কি পারব ওদের সাথে মানিয়ে নিতে? পারব মাস্টার্স কোর্স সফলভাবে শেষ করতে? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে দেখি সামনের সারিতে চলে এসেছি। পুরো সারিতে আমি একা। যাহ্, একাই বসব। সবসময় ‘কী করব? করব কি না?’ দ্বিধায় ভুগতে থাকা আমার সময় এসেছে দ্বিধাহীন হওয়ার। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে’। যদি মোর পাশে কেউ না বসে, তবে একলা বস রে। বসে পড়লাম। ডানদিকে তাকিয়ে দেখলাম পোডিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কোর্স ইন্সট্রাক্টর। এত সুন্দর একজন প্রফেসর আমাদের ক্লাস নিবেন? ক্রাশ খেয়ে গেলাম। প্রফেসর দেখি হাতাকাটা জামা পরে এসেছেন। সে জামা আবার হাঁটু পর্যন্ত লম্বা। হাঁটু থেকে পা পর্যন্ত অস্বচ্ছ মোজায় ঢাকা। দেশে থাকতে এ ধরনের মোজাকে আমরা স্কিন মোজা বলতাম। এখানে এগুলোকে শিয়ার টাইট (Sheer tight) বলে। উনার পোশাক দেখে আমি ধাক্কা খেলাম। চলচ্চিত্র বা টেলিভিশন সিরিজ দেখে দেখে আমেরিকার সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেকখানি অভ্যস্ত ছিলাম বলে আসার পর খুব একটা কালচারাল শক পাইনি। কিন্তু ক্লাস করতে এসে প্রফেসরের পোশাক দেখে কালচারাল শক পেলাম। আমাদের ক্লাসে মহিলা শিক্ষকেরা পড়াতে আসতেন শাড়ি বা সালওয়ার কামিজ পরে, যেগুলোতে ন্যূনতম ফাঁক ছিল না। কিন্তু এই কোর্সের প্রফেসর আমার মাথায় গেঁথে থাকা ‘শিক্ষকের পোশাক’ নামক অভ্যস্ততায় বিশাল ঝাঁকি দিলেন।
রুমের একদম সামনের দেওয়ালে বড় একটা হোয়াইট বোর্ড। বোর্ডের সাথে যুক্ত তাকে ডাস্টার আর রঙিন মার্কার রাখা। প্রফেসর যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, সে পোডিয়ামে দুটো কম্পিউটার দেখা যাচ্ছে। দুটো কম্পিউটারের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারছি না। উনি কিছু একটা চাপ দেওয়ার সাথে সাথে হোয়াইট বোর্ডের মাথার উপর থেকে প্রজেক্টর স্ক্রিন নামা শুরু করল। দেখতে দেখতে বোর্ডের জায়গা দখল করে ফেলল ঐ স্ক্রিন। বুঝলাম ওখানেই হবে স্লাইড শো। খেয়াল করলাম প্রফেসরের বসার জন্য কোনো চেয়ার নেই। এ কেমন নিয়ম? আমাদের দেশে টেবিল না থাক, শিক্ষকের জন্য ক্লাসরুমে চেয়ার থাকাটা বাধ্যতামূলক ছিল। আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করলাম। ক্লাসের পেছন দিকে যারা বসেছে, তারা যেন স্লাইড মিস না করে, সেজন্য পেছনের দিকের দেওয়ালে আঁটা আছে বিশাল টিভি স্ক্রিন। মুগ্ধ হয়ে গেলাম। একেই বলে আধুনিক শ্রেণীকক্ষ।
ঝাড়া দুই ঘণ্টা প্রফেসর দাঁড়িয়ে লেকচার দিলেন। উনার লেকচার শুনতে শুনতে অনেককে দেখলাম ব্যাগ থেকে খাবার বের করছে। অনেককে দেখলাম পাশের চেয়ারে পা তুলে আরামসে লেকচার শুনছে। কয়েকজন দেখলাম অনুমতির তোয়াক্কা না করে বাইরে চলে গেল। আবার অনুমতি না নিয়েই ভেতরে ঢুকল। এগুলো সম্পর্কে আগেই জানা ছিল। কিন্তু তারপরও নিজের চোখে দেখা অন্য ব্যাপার। প্রথমবার দেখে ধাক্কা লাগা স্বাভাবিক। আমি পুরো ক্লাস ধাক্কা খেতে খেতে করলাম। ক্লাসে বেশ কয়েকজন চৈনিক ছেলেমেয়ে দেখলাম। আমি বাদে আর কাউকে দক্ষিণ এশীয় মনে হল না। তিনজন হিজাব পরা মেয়ে দেখলাম যাদের এশীয় লাগছে না। হতে পারে ওরা আরবের কোনো দেশের। ক্লাস শেষে আবিষ্কার করলাম হিজাব পরা তিন মেয়ের একজন হল সিদ্দিকা আলজিশি। ও আমার সাথে ফল সেশনে ভর্তি হয়েছে। অ্যাডমিশনের পরপরই আমাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল পছন্দের সুপারভাইজারের নাম। সিদ্দিকা ইমেইলটা খেয়াল করেনি। প্রায় এক মাস পর যখন খেয়াল করেছে, তখন ডিপার্টমেন্টে ইমেইল দিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, এখনও কি সুপারভাইজারের নাম দেওয়ার সুযোগ আছে কিনা। বেচারা ইমেইলটা দিয়েছে ‘রিপ্লাই অল’ হিসেবে। ফলে আমরা সবাই ওর রিপ্লাই দেখে ফেলেছি। ঐ সূত্রে ওর নামের সাথে পরিচিতি ছিল, এবার সরাসরি দেখলাম।
সিদ্দিকাকে দেখামাত্র আমার মনে কে যেন এক বালতি ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিল। ওম শান্তি! ওকে দেখে মনে হল, বিদেশ বিভূঁইয়ে আমি আর একা নই। একজন বন্ধু পেয়েছি যার সাথে অন্তত বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কাটানো যাবে। কেন এমন মনে হল সেটা নিয়ে কাটাছেঁড়া করে বুঝেছি, ওর চেহারার সাথে দক্ষিণ এশীয়দের মিল আছে। ওর উচ্চতা আর দৈহিক গড়ন আমার মত। সর্বোপরি, ওকে দেখে শান্তশিষ্ট মনে হয়েছে যেটা আমারও বৈশিষ্ট্য। হইচই হাঙ্গামা আমার পছন্দ কিন্তু সবার সাথে সেটা করতে পারি না। আমার মত মানসিকতার মানুষদের সাথেই লাফালাফি, ঝাঁপাঝাঁপি করে থাকি। সিদ্দিকার সাথে লাফাতেও আমার আপত্তি নেই। আমি হাই দেওয়ার পর সিদ্দিকা হ্যালো বলল। কোথা থেকে এসেছে জানতে চাওয়ায় বলল, সৌদি আরব। ভুল অনুমান করিনি। অপর দুই হিজাবী মেয়েকে দেখিয়ে বলল, ওরাও সৌদি আরব থেকে এসেছে। সিদ্দিকার বন্ধুমানুষ। একজনের নাম মোনা, আরেকজনের রেহাম। রেহাম নামটা সৌদি সৌদি, কিন্তু মোনা? এ নাম শুনলে মোটেও আরব্য দেশের মানুষ মনে হয় না। মনে হয় দক্ষিণ এশীয় কোনো মেয়ে।
আমি একটু অবাক হলাম তিনজনের পোশাক দেখে। আঁটসাঁট জিন্স আর শার্ট পরে চলে এসেছে। হিজাব খুলে ফেললে বুঝার কোনো উপায়ই নেই যে, ওরা সৌদি আরব থেকে এসেছে। আমি ভাবতাম, সৌদির মেয়েরা সব জায়গায় বোরখা পরে। ভুলটা ভাঙল। ওদের তিনজনের পদবীই ‘আল’ দিয়ে শুরু। রেহাম আর মোনা গত বছর এসেছে। ২০১৯ সালে মাস্টার্স শেষ হলে ওরা দেশে ফিরে যাবে। দুজনই তীব্র মেকআপ করে এসেছে। লিপস্টিক, কাজল, আইশ্যাডো, আইলাইনার, ফেস পাউডার, এমনকি গালে রুজও বাদ যায়নি। ক্লাসে এত সেজে আসাটা কেমন বেখাপ্পা লাগল। তবে দেখতে দুজনকেই সুন্দর লাগছে। অবশ্য দেশেও কিছু সাজুনি বন্ধু ছিল আমার। ওরা ক্লাসে যাওয়ার সময় এমনভাবে সাজত, যেন অনুষ্ঠানে যাচ্ছে। তিনজনের মধ্যে সিদ্দিকাই সবচেয়ে শান্ত আর সাদাসিধে। কিছুই মাখেনি মুখে। কথাবার্তাও খুব ধীরে বলে। ওর গলার স্বর এত নিচু যে, পাশে বসেও আমার বারবার ‘দুঃখিত, কী বললে?’ বলতে হচ্ছে।
সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে সিদ্দিকা টেক্সাসের অস্টিন শহরে ছিল এক বছর। ওখানকার কোনো এক প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ভাষা শিখেছে। তাও কথা বলতে গেলে ওর হাঁটু কাঁপে। সে অন্যদের কথা সবকিছু বুঝে কিন্তু নিজে কথা বলতে গেলে খেই হারিয়ে ফেলে। আমার ঠিক উল্টো। আমি মোটামুটি বলতে পারি কিন্তু অন্যরা যখন পূর্ণ গতিতে ইংরেজি বলতে থাকে, আমি কিছুই বুঝি না। ধীরে ধীরে বললে অবশ্য বুঝতে সমস্যা হয় না, কিন্তু ধীরে বলবে কে? যাদের মাতৃভাষা ইংরেজি, তারা তো ফুলস্পিডেই বলবে! সিদ্দিকা সৌদি সরকারের বৃত্তি নিয়ে পড়তে এসেছে। পড়া শেষে দেশে ফিরতে হবে। এই বৃত্তি যোগাড় করতে নাকি ভীষণ কষ্ট হয়েছে ওর। তিন তিনটা ধাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। দুইবার পরীক্ষা, এবং শেষে চূড়ান্ত সাক্ষাৎকার। এরপর ও নির্বাচিত হয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, সেন্ট লুইস নাকি অস্টিন, কোনটা বেশি ভাল লাগে? বলল, অস্টিন। ওখানে খুব ঘুরে বেড়াত ও। এখানে এসে বাসায় বন্দী হয়ে পড়েছে।
(২৬)
আজ স্যালাস সেন্টারে কাজ করতে গিয়ে খাঁটি আমেরিকান খানা খেলাম। এটাই খাঁটি মার্কিনী খাবার খাওয়ার প্রথম অভিজ্ঞতা আমার। এতদিন ধরে সব ফিউশন খেয়ে এসেছি। আমেরিকানরা যেমন তেল, মশলা ছাড়া খাবার খায়, সেরকম খাবার খাওয়ার সুযোগ হয়নি। আজ খেলাম হালকা তেল মাখিয়ে ওভেনে সেঁকা মুরগি (আমরা যেটাকে বলি বেকড চিকেন) আর ব্রকোলি, সাথে বাদামী ভাত (ব্রাউন রাইস)। আরেকটা খাবারও ছিল। স্প্যাগেটি সিদ্ধ করে সাদা রঙের পনিরের সাথে মিশিয়ে তৈরি কিছু একটা (ছবি ২)। দেশে থাকতে লম্বা, খাটো, সোজা, ঢেউ খেলানো সব ধরনের কাঠিকে নুডলস বলতাম। কিন্তু এখানে এভাবে বললে কেউ বুঝে না। বলতে হয় স্প্যাগেটি (লম্বা আর সোজা কাঠি), নুডলস (খাটো আর ঢেউ খেলানো কাঠি), চাওমিন (উচ্চ তাপমাত্রায় দ্রুত নেড়ে ভাজা নুডলস)। চীনারা একে উচ্চারণ করে ‘চওমেইং’। ওদের মত হয় না আমার উচ্চারণ। তবে এটা জেনে মজা পেয়েছি, চও মানে উচ্চ তাপমাত্রায় দ্রুত নেড়ে নেড়ে ভাজা, আর মেইং মানে নুডলস। দুইয়ে মিলে নাম হয়েছে চওমেইং। আরেকটা ব্যাপার হল, স্প্যাগেটি বা নুডলস যাই খান না কেন, সবই পাস্তা পরিবারের। মানে এগুলো এক প্রকার পাস্তা। জেনে ভীষণ ধাক্কা খেয়েছি। আমি ভাবতাম পাস্তা মানে ছোট ছোট লাঠি, যেগুলোর ভেতরটা ফাঁপা থাকে। দেশে থাকতে রাইফেলস স্কয়ারের (বর্তমান সীমান্ত স্কয়ার) ফুড কোর্টে গিয়ে প্রায় প্রায় পাস্তা খেতাম। দোকানটার নাম ভুলে গেছি কিন্তু ঐ দোকানের পাস্তাই সবচেয়ে সুস্বাদু ছিল। অন্তর্জাল ঘেঁটে ঐ দোকানের সিগ্নেচার বাটিসহ পাস্তার একটা ছবি পেলাম (ছবি ৩)। কিন্তু পাস্তার পরিমাণের তুলনায় দাম এত বেশি ছিল যে, ছোট বোন সিন্থিয়া ঠিক ঐভাবে পাস্তা বানানো শিখে নিল। এরপর থেকে ওর বাসায়ই পাস্তা পার্টি হত। হুবহু দোকানের স্বাদ। যাদের ইচ্ছে হচ্ছে বিভিন্ন রকম পাস্তা দেখার, তারা উইকিপিডিয়ার এই পেইজে ঘুরে আসতে পারেন (https://en.wikipedia.org/wiki/List_of_pasta)। চমক খাবেন, নিশ্চিত।
আমার সাথে ক্যাফে ফ্রেশে কাজ করে জেরাল্ড আর্নেট। আমার মতই পুষ্টি অনুষদের একজন গ্র্যাজুয়েট অ্যাসিস্টেন্ট ও। ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা একটা ছেলে। জিম করা পেটানো শরীর। চেহারা অত্যন্ত সুন্দর। বিশেষ করে চোখ দুটো। খাঁটি সরলতা ফুটে আছে ওখানে। বয়স মাত্র চব্বিশ বছর। এ বয়সেই সে একজন রেজিস্টার্ড কাম লাইসেন্সড ডায়েটিশিয়ান। ব্যাচেলর শেষ করার পর ডায়েটেটিক ইন্টার্নশিপ শেষ করেছে। সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে মাস্টার্স করার জন্য। গত বছরের সামারে ভর্তি হয়েছে এখানে। আমার এক বছরের সিনিয়র। ওর সাথে পরিচয় পর্বটা বেশ মজার ছিল। যেদিন ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে আমাদের ওরিয়েন্টেশন ছিল, সেদিন জেরাল্ডের সাথে আমার প্রথম দেখা। এত বিশাল একটা ছেলেকে দেখলে চোখ বারবার ওর দিকে চলে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। তার উপর সুপুরুষ। জেরাল্ডও বোধহয় ব্যাপারটা জানে। বেশ ক’বার চোখাচোখি হল ওর সাথে। আমি বিব্রত হলেও জেরাল্ড স্বাভাবিক। অনুষ্ঠান শেষে আমি কয়েকজন জিএকে জিজ্ঞেস করলাম, ডিপার্টমেন্টের বাগানটা কোথায় জানে কিনা। ওরাও আমার মত নতুন ভর্তি হয়েছে। জিএ হিসেবে আমাদের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট হল বাগানের পরিচর্যা করা। কিন্তু আমি বাগান চিনি না। জিপিএসে নির্দেশনা দেখেও বুঝতে পারছি না সেটা কোথায়। হঠাৎ জেরাল্ড বলল, ‘বাগানের কাছেই গাড়ি পার্ক করেছি। আমার সাথে গেলে তোমাকে বাগানটা দেখাতে পারি।’
ধড়ে প্রাণ এল। জেরাল্ডের সাথে নেমে এলাম নিচে। টুকটাক কথা চলতে লাগল রাস্তা জুড়ে। ও এসেছে ইলিনয় থেকে। কয়েকজন রুমমেটের সাথে এখানে এপার্টমেন্ট ভাগাভাগি করে থাকে। আমাদের ডিপার্টমেন্টটা তিনতলায়। সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নামলে লাউঞ্জ পড়ে। সেখানে চেয়ার টেবিল পাতা। স্টুডেন্টরা বসে আড্ডা দিচ্ছে বা পড়ছে। লাউঞ্জের একপাশে দালান থেকে বের হওয়ার দরজা। কাজের দরজাটা স্বয়ংক্রিয়। মোশন সেন্সর লাগানো আছে। আশেপাশে গেলেই দরজা খুলে যায়। বাইরে বের হলে বিশাল লন। এই লন আমাদের দেশে মাঠ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু এখানে এটা শুধু একটা লন হিসেবেই পড়ে আছে। সবুজ ঘাসে ঢাকা সে লনে স্টুডেন্টরা শুয়ে, বসে রোদ পোহাচ্ছে। কেউ কেউ পড়ছে। লনের একদিক দিয়ে পায়ে হাঁটার রাস্তা। রাস্তাটা পিচ ঢালা নয়, কাঁকর বা নুড়ি বিছানো রাস্তা। রাস্তার শেষ মাথা এসে মিশেছে মূল ফটকের সাথে। ফটকের বাইরে বের হলে বাম দিকে আধা মাইলের মত লোহার বেড়া দেওয়া। বেড়া দেওয়া অংশ হল ভার্সিটির ক্যাম্পাস। এরপর শুরু হয়েছে আবাসিক এলাকা। বেড়ার ভিতর ক্যাম্পাস, বাইরে ফুটপাথ। ফুটপাথের পাশে বিশাল বিশাল গাছ দাঁড়িয়ে ছায়া দিচ্ছে। জেরাল্ড বলল, এই ফুটপাথ ধরে হেঁটে একদম শেষ মাথায় পৌঁছলে বাগান পাব। অনেক বড় বাগান, লোহার বেড়া দেওয়া। না চেনার উপায় নেই। অনেক ধন্যবাদ দিলাম ওকে। ভিনদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে এই প্রথম মনে হল, খারাপ যাবে না সময়। এত ভাল লোকজন আশেপাশে থাকলে একা লাগার প্রশ্নই উঠে না। জেরাল্ড বিদায় নিয়ে এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে। ওর গাড়ি দেখে আমার চোখ কপালে উঠে গেল। ঝা চকচকে বিশাল এসইউভি। আমেরিকানদের গাড়ি সংস্কৃতি বুঝি না। এত কম বয়সে এরা নতুন গাড়ি যোগাড় করে কীভাবে? ঋণ নিয়ে কেনে? নাকি বাবা-মা কিনে দেয়?
স্যালাস ক্যাফেতে সেদিন জেরাল্ড আর সারাহ ক্যারোলের সাথে আমার শিফট পড়েছে। সারাহ আর আমি নতুন ভর্তি হয়েছি, জেরাল্ড ভর্তি হয়েছে এক বছর আগে। কাজের ফাঁকে জেরাল্ডের সাথে আমাদের হালকা আড্ডা চলছে। কে কোথা থেকে এসেছি, এর আগে কী করেছি এসব। হঠাৎ সারাহ জানতে চাইল কীভাবে নিউট্রিশনের প্রতি জেরাল্ডের আগ্রহ জন্মাল। জেরাল্ড যা বলল, তাতে আমি বিস্মিত এবং যুগপৎ মুগ্ধ। বলল, টিনএজ পর্যন্ত ও ছিল বিশাল মোটা। এজন্য ওকে প্রচুর বুলিংয়ের শিকার হতে হত। খেতে পছন্দ করত বলে ওর ইচ্ছে ছিল শেফ হওয়া, নিজের একটা রেস্তোরাঁ দেওয়া। কিন্তু স্থূলতার কারণে মানুষের কথা শুনতে শুনতে এক পর্যায়ে ও ঠিক করল, আগে নিজেকে বদলাতে হবে, এরপর স্বপ্ন পূরণ। শুরু হল ব্যায়াম করা। ধীরে ধীরে স্থূলতা কমে শরীর ফিট হল, মানে একদম সঞ্জয় দত্ত বা ঋত্বিক রোশানের মত মাসলম্যান। জেরাল্ড চিন্তা করল, নিজেকে ও যেভাবে বদলেছে, অন্য স্থূলকায়াদেরও সেভাবে বদলাতে সাহায্য করবে। এর জন্য প্রয়োজন ওজন কমানোর ফিল্ডে বিশেষজ্ঞ হওয়া। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য “নিউট্রিশন এন্ড এক্সারসাইজ সায়েন্স”-এর চেয়ে উপযুক্ত সাব্জেক্ট আর কী হতে পারে? সে হিসেবেই ওর এখানে আসা।
সারাহর কাহিনী আবার অন্যরকম। সে ছোটবেলা থেকে চেয়েছে আমেরিকার ইতিহাসের শিক্ষক হবে। তার ধারণা ছিল, শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে সে খুব উপভোগ করবে। ট্রায়াল দেওয়ার জন্য হাই স্কুল শেষে কিছু সময়ের জন্য সে শিক্ষকতা করল। করে টের পেল, এই পেশা মোটেও তার জন্য নয়। সারার ভাষায়, “This is the last thing I could ever want in my life!” শিক্ষকতা উপভোগ করতে পারছে না দেখে সারা ভীষণ মুষড়ে পড়ল। সে ভেবেছিল আমেরিকান ইতিহাসকে আন্ডারগ্র্যাড মেজর হিসেবে নিবে। কিন্তু এখন সে বুঝে উঠতে পারছে না, জীবনের পরবর্তী ধাপ কী হওয়া উচিৎ। সারা দারুণ ভলিবল খেলে। তো মনমরা হয়ে সে ভাবতে লাগল, পেশাদার ভলিবল খেলোয়াড় হয়ে যাবে কিনা। এমন সময় ওর এক বন্ধু বলল, “তুই তো খাবার দাবারের প্রতি আগ্রহী। নিউট্রিশনে পড়ার চেষ্টা করে দেখতে পারিস।” সারার মনে ধরল প্রস্তাবটা। সেই যে নিউট্রিশনে ঢুকল, এরপর তার প্যাশনে পরিণত হয়েছে এই বিষয়।
চিন্তা করে দেখলাম জেরাল্ড কিংবা সারাহর সাথে আমার কত পার্থক্য! গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে নিউট্রিশন নামক বিষয়ে ভর্তি হওয়ার আগে জানতামই না এই নামে কোনো প্রোগ্রাম আছে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজে সুযোগ পাইনি বলে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। পুষ্টি নিয়ে না ছিল আমার কোনো স্বপ্ন, না ছিল পরিকল্পনা। অথচ সিস্টেমের প্যাঁচে পড়ে সেটাতেই ভর্তি হতে হয়েছিল। পুষ্টির প্রতি আমার প্যাশন তৈরি হয়েছে পড়তে পড়তে। আমাদের দেশে বেশিরভাগ ছেলেমেয়ের প্যাশন খুব অল্প কিছু বিষয়ের উপরই ঘোরাফেরা করে। বাবা মা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংক অফিসারের বাইরে কিছু ভাবতে দিতে চান না বলে আমরাও এগুলোকেই ধ্যান জ্ঞান ভেবে বড় হই। অন্য বিষয়ের প্রতি প্যাশন থাকলেও আমাদের বুঝানো হয় সেগুলো পড়ে ভাল বেতনের চাকুরি পাওয়া যাবে না। ফলে সেগুলো নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনার ইচ্ছে জলাঞ্জলি দিতে হয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি, কবে যে নিজের ইচ্ছানুযায়ী বিষয়ে পড়ার মত মানসিকতা তৈরি হবে আমাদের দেশে!
(২৭)
আজ ভার্সিটিতে “টেস্ট অফ সৌদি আরব” নামের একটা ইভেন্টে গিয়েছিলাম। আয়োজন করেছে সেন্ট লুইস ইউনিভার্সিটির ‘স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অফ সৌদি অ্যারাবিয়া’। সৌদিদের জাঁকজমক এবং উদারহস্তের গল্প অনেক পড়েছি। আজ চাক্ষুষ করব বলে অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিটের মাথায় আমি গ্লোবাল সিটিজেনশিপ সেন্টারে উপস্থিত। এই সেন্টারে ভার্সিটি তার আন্তর্জাতিক স্টুডেন্টদের জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে থাকে। আবার আন্তর্জাতিক স্টুডেন্টরাও চাইলে এই সেন্টারে নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য তুলে ধরার জন্য ইভেন্ট করতে পারে। তেমনই একটা ইভেন্ট ছিল আজকের “টেস্ট অফ সৌদি আরব”। আমার সৌদি বন্ধু সিদ্দিকা সকালে টেক্সট করে বলল, “তোমাকে আসতেই হবে এই ইভেন্টে।“ নিজের তো যাওয়ার ইচ্ছা ছিলই, তার উপর সিদ্দিকার মেসেজ পেয়ে কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, এখানে কোনো এন্ট্রি ফি আছে কিনা। উত্তর এল, “না। এটা সবার জন্য ফ্রি।” গেল সপ্তাহে চীনের স্টুডেন্টরা একটা ইভেন্টের আয়োজন করেছিল তাদের সংস্কৃতি তুলে ধরার জন্য। সে ইভেন্টে এন্ট্রি ফি ছিল পাঁচ ডলার। টাকা দিয়ে ঢুকে আয়োজন দেখতে ইচ্ছে করেনি, তাই যাওয়াও হয়নি। কিন্তু সৌদিদের ইভেন্টে এন্ট্রি তো ফ্রি-ই, বুফে খানা, মেহেদি লাগানো, নিজের নাম সৌদি ভাষায় লেখানো – সবই ছিল ফ্রি! যা বলছিলাম। বারোটা থেকে দুইটা পর্যন্ত ছিল ইভেন্টের সময়সীমা। বারোটা পাঁচ মিনিটে সেন্টারের সামনে গিয়ে দেখি বি-শা-ল লাইন ধরে মানুষ ভিতরে ঢুকছে। আমার চিন্তায়ই ছিল না এত মানুষ আসবে! সবাইকে একটা করে ছোট্ট কেক আর এক কাপ চিনি ছাড়া অ্যারাবিয়ান কফি দিয়ে স্বাগত জানানো হচ্ছে। স্বাগত জানাচ্ছে সৌদি আরবের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা ছেলেরা।
কফি আর কেক হাতে ভেতরে ঢুকতেই পড়লাম আরেক টেবিলের সামনে। এখানে সাজিয়ে রাখা হয়েছে আরবের খেজুর, বিস্কুট, আর বাকলাভা নামের মিষ্টি। সবকিছু প্লেটে তুলে নিলাম। লজ্জা করে লাভ নেই। টেস্ট করতে এসেছি, সবকিছুর স্বাদ জানতে হবে। এরপরের টেবিলে আছে আরেক ধরনের কফি, নাড়ুর মত দেখতে দুটো আইটেম, আর খেজুরের শুঁটকি। খেজুরকে ভর্তা বানিয়ে শুকিয়েছে। আরব থেকে আসা আরবী খেজুর খেয়ে তৃপ্তি পেলাম।এরপরের টেবিলে অতিথিদের নাম আরবী ভাষায় লেখা হচ্ছে। অনেকেই দেখলাম ব্যাপারটা নিয়ে উৎসাহিত। আমিও ভিড়ে গেলাম লাইনে। “রুথ” নামটা বানান করে দেওয়ার পর ওরা একটা কাগজে সেটা লিখল। বলল, চাইলে আমিও ওদের লেখা দেখে আরবী ভাষায় আমার নাম লেখার চেষ্টা করতে পারি। চ্যালেঞ্জটা নিলাম। ওদের লেখার নিচেই লিখলাম। ছেলেটা অবাক হয়ে গেল। পাশেরজনকে ডেকে কাগজটা দেখাল। পাশেরজনও বিস্মিত হয়ে বলল, “ইত’জ বেথার দ্যান ইউ! উনাকে টেবিলে বসায় দে, ব্যাটা!”সিদ্দিকাকে জিজ্ঞেস করলাম, ওরা কি আমার নাম ঠিকঠাক মত লিখতে পেরেছে কিনা। সিদ্দিকা হাসতে হাসতে শেষ! উঁহু, ঠিক হয়নি। আমি বানান করে দেওয়ার পরও ভুল করেছে। লিখেছে ‘Rudth’। কী আর করা! পরের টেবিলে গেলাম। এখানে বিশাল লাইন। হাতে মেহেদি লাগানোর লাইন। এই টেবিল ছেড়ে সামনে এগিয়ে দেখলাম মেঝেতে কুশন, কোলবালিশ আর চাদর বিছিয়ে বসার জায়গা করে রেখেছে। এর ঠিক সামনে একটা নিচু টেবিলে পেয়ালা, জগ সাজানো। সিদ্দিকা বলল, এটা সৌদিদের ঐতিহ্যবাহী বসার জায়গা। এখন আর এসবের প্রচলন নেই। ওদের দাদু-দিদিমারা এখানে বসে এসব পেয়ালায় করে চা কফি সুরা টুরা খেতেন।
এরপরে দেখলাম একটা স্ট্যান্ডে বেশ কিছু জামাকাপড় টানিয়ে রাখা। ছেলেমেয়ে সবার জন্য। কেউ ইচ্ছে করলে সৌদি পোশাক পরে দেখতে পারে। আমি আর ‘কাই’ নামের এক চীনা মেয়ে গেলাম এই কাউন্টারে। মেয়েটা এমবিএ করছে এখানে। ওর সাথে আজই পরিচয় হল সিদ্দিকা মারফৎ। ওরা দুজন একসাথে ‘ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ’ ক্লাস করে। কাইয়ের ইংলিশ শুনে বুঝতে পারলাম, কেন ও এই ক্লাস করে। বাংলাদেশ কোথায় বুঝানোর জন্য ওকে বললাম, ‘নেক্সট টু ইন্ডিয়া’। এরপর পাঁচ মিনিট গেছে ওকে ‘নেক্সট’ বুঝাতে। আমার উচ্চারণ সে বুঝে না, নাকি নেক্সট শব্দটা সে জানে না, কে জানে! পরে ‘বিসাইড’ বলে পার পেলাম। পোশাকের কাউন্টার সামলাচ্ছে আমার আরেক সৌদি ক্লাসমেট রেহাম। কাই একটা কালো সুতির আলখাল্লা পছন্দ করল, আর আমি একটা জাম রঙা আলখাল্লা। কাইয়ের জামা সাদাসিধা ছিল বলে পটাপট সেটার ভিতর গলে গেল সে। আর আমার পছন্দ অত্যন্ত জবড়জং বলে আমি কিংবা রেহাম খুঁজেই পেলাম না পোশাকটা পরার কায়দা। পরতের পর পরত দেওয়া জামার ভিতর। এদিকে লাইন বাড়ছে পেছনে। সবাই জামা পরে ছবি তুলতে চায়। অবশেষে ক্ষান্ত দিলাম দুজন, আর রেহাম চটজলদি জামাটা স্ট্যান্ডের পেছনে লুকিয়ে ফেলল যেন আর কেউ সেটা পরতে না চায়।
এরপর লাইন ধরলাম দুপুরের খাবারের জন্য। অনেক ভারতীয়, চীনা আর শ্বেতাঙ্গ স্টুডেন্ট এসেছে খাবার চাখার জন্য। ঠিক করলাম, সব আইটেম চেখে দেখব। দেখলাম দেশের মতই বিফ রাইস, চিকেন রাইস, টমেটো-শশার সালাদ, লাউ দিয়ে মুরগির কারি, বেগুন ভর্তা সাজিয়ে রেখেছে। চমক খেলাম। সিদ্দিকাকে বললাম, ‘তোমাদের সাথে আমাদের খাওয়ার এত মিল!’ একটা মাত্র নতুন খাবার দেখলাম যেটা ছিল ছোট পাতায় মোড়ানো সিদ্ধ ভাত জাতীয় জিনিস। খাবারটা লেবুর রসের মধ্যে রাখা ছিল। খেতে টক, কিন্তু ভাল লাগল। কুইজিন দেশের মত হলেও স্বাদ অন্যরকম। চিকেন রাইসটা সবচেয়ে বেশি মজা লাগল। পুরো মেনুতে সফট ড্রিঙ্কস বলে কিছু ছিল না, শুধু পানি।লাঞ্চ সেরে আরও কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম তিনজন। দুইটা বাজে বাজে সময়ে বের হয়ে এলাম। আসার পথে টেবিল থেকে প্যানকেকের মত একটা খাবার তুলে নিলাম। খেতে খেতে মজার একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। বেশিরভাগ সৌদি ছাত্র ঐতিহ্যবাহী আলখাল্লা আর পাগড়ি পরে এলেও সৌদি ছাত্রীরা পরেছে শার্ট/টিশার্ট, প্যান্ট, সাথে হিজাব। যেসব মহিলা ভার্সিটির বাইরে থেকে এসেছেন, তাদের দেখলাম বোরখা, নেকাব, আর হিজাব করতে। কাই শুধাল, ‘দেশে কি তোমার বোরখা পরতে হয়?’ সিদ্দিকা মাথা ঝাঁকালো। বোরখা, নেকাব, হিজাব সব পরতে হয়। কিন্তু আমেরিকায় এসে হয়েছে সমস্যা। এখানে শুধু হিজাব পরে বলেই মানুষের আড় চাহনি সহ্য করতে হয়। সে জায়গায় নেকাব পরলে ও চিন্তাই করতে পারে না কী পরিমাণ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে। হুম! গল্প করতে করতে যে যার বাসার দিকে রওনা দিলাম। প্রচুর অ্যাসাইনমেন্ট বাকি।
পর্ব বারো এখানে