1 0
Read Time25 Minute, 47 Second

পর্ব এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো

(২৮)

আগেই বলেছি নিউট্রিশন ডিপার্টমেন্টের নিজস্ব একটা বাগান আছে। ওখানে গ্র্যাজুয়েট অ্যাসিস্টেন্টদের পালা করে কাজ করতে হয়। যারা নতুন জিএ হয়, তারা বাগানে বেশি সময় দেয়। এক বছরের পুরনো হয়ে গেলে জিএদের টিচিং অ্যাসিস্টেন্টশিপ, রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্টশিপে বেশি সময় দিতে হয়। তখন বাগানে অতটা সময় দেওয়ার অবস্থা থাকে না। ফল সেশনে আমরা নতুন জিএ এসেছি আটজন। পুরনো জিএ আছে দুইজন। এই দশজনের মধ্যে আবার রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ান হল পাঁচজন। তারা ডায়েটেটিক ইন্টার্নদের প্রিসেপ্টর হিসেবে কাজ করে বলে বাগানে বেশি সময় দিতে পারে না। দিনশেষে মাত্র পাঁচজন বাগানে কাজ করি। এ তো আর বাসাবাড়ির বাগান না, অর্চার্ড আর সবজি বাগান মিলে মোটামুটি দুই ব্লক সমান জায়গা। হুলুস্থূল অবস্থা। এত বড় বাগান পাঁচজন মিলে সামলানো চাট্টিখানি কথা না। অবশ্য বাগানের ম্যানেজার ম্যারেলিন আমাদের সাহায্য করেন। তিনি ষাট বছর বয়সী চিরতরুণ। আমাদের অনুষদে অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি হিসেবে আছেন। সাথে জুটিয়ে নিয়েছেন বন্ধু স্যারাকে। স্যারাও ম্যারিলিনের মত ষাট পেরোনো বুড়ি। অথচ মনের দিক দিয়ে দুজনেই আমার চেয়ে তরুণ। খাটার দিক দিয়েও। আমি একটুখানি মাটি কোপালেই হাঁপিয়ে যাই, জিভ বের করে বসে পড়ি ঘাসে। কিন্তু ইনারা মাটি কুপিয়ে, আগাছা পরিষ্কার করে, সেটা নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে তারপর বিশ্রাম নেন। যেখানে আবাদ করা শাকশব্জি, ফলমূল সরবরাহ করা হয় ভার্সিটির দুটো ক্যান্টিনে। এই বাগান চালু করার জন্য প্রাথমিকভাবে ডোনেশন দিয়েছিলেন সেন্ট লুইসের অনেক ধনী পরিবার। প্রতি বছর হোমকামিং ডে’তে তাদের জন্য বাগানে একটা পার্টি দেওয়া হয়। গতকাল সন্ধ্যায় ছিল এ বছরের হোমকামিং ডে’র পার্টি। পার্টিতে স্বেচ্ছাসেবক লাগবে প্রচুর। বাগানের সব ধরনের কাজকর্মের তদারকি করেন প্রফেসর ল্যান্ডফ্রিড। উনি সব জিএ আর ডায়েটেটিক ইন্টার্নকে ইমেইল দিলেন। কেউ যদি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করে জিএ আওয়ার কামিয়ে নিতে চায়, তার জন্য সুবর্ণ সুযোগ। এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে ভেবে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নাম লিখিয়ে ফেললাম। আমেরিকান পার্টি দেখতে দেখতে GA hour পূরণ করব। কোনোদিন আমেরিকান পার্টি দেখিনি। এই সুযোগে ফার্স্ট হ্যান্ড অভিজ্ঞতা হয়ে যাবে।

বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে ডিনার শুরু হওয়ার কথা। এই জাতি এত দ্রুত ডিনার করে যে, এখনও ব্যাপারটার সাথে খাপ খাওয়াতে পারিনি। এরা সন্ধ্যা সাতটাকে বলে রাত, আটটাকে বলে অনেক রাত, আর দশটার দিকে আমার এলাকায় কোনো গাড়ি দেখা যায় না। পাঁচটায় আমি আর সারাহ বাগানে পৌঁছলাম। সারাহর কথা আগে বলেছি। আমার সাথে মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছে। মাত্র বাইশ বছর। এসেছে পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের পিটসবারগ শহর থেকে। ওর মত বন্ধুসুলভ আমেরিকান ক্লাসমেট এখনো পাইনি। খুব ভাল লাগে মেয়েটাকে। পিটসবার্গে ওর প্রতিবেশী হল মলি, যে আমার আরেক ক্লাসমেট। মানে সারাহ আর মলি একইসাথে ভর্তি হয়েছে স্লুতে। মলি আমার দেখা দ্বিতীয় বন্ধুসুলভ আমেরিকান। দুজনের মুখেই সারাক্ষণ হাসি লেগে আছে। ওদের দুজনকে দেখে মনে হয়, পিটসবারগের সব মেয়েই সুন্দর আর হাসিখুশি। তো, বাগানে এসে দেখি মোটামুটি সব জিএ হাজির। এসেছে কিছু ইন্টার্ন আর রেগুলার গ্র্যাড স্টুডেন্টও। সবাই পার্টি করতে চায়। পার্টি মানে ফ্রি খানা এবং পিনা। পুরো বাগান জুড়ে চেয়ার-টেবিল পাতা, টেবিলের উপর ছাতা বসানো। বাগানের চেহারাই গেছে পাল্টে। চেনা যাচ্ছে না মোটে। একটু এগিয়ে যেতে স্কোয়াশ আর টমেটোর বেড চোখে পড়ল। তখন বুঝলাম, এটা আমাদেরই বাগান।

মোট চারটা স্টেশনে ভাগ করা হয়েছে বাগানকে। সালাদ বার, মেইন ডিশ বার, হার্ড ড্রিংক বার, ডেজার্ট‌ বার। স্বেচ্ছাসেবীদের বিভিন্ন স্টেশনে ভাগ করে দেওয়া হল। আমি পড়লাম মেইন ডিশ বারে। মেইন ডিশ হিসেবে আছে বার্বি‌কিউড চিকেন, ছোট টরটিয়া (আটার রুটির মেক্সিকান রূপ), আর রোস্টেড রসুন। Seasoning হিসেবে ছিল তিন ধরনের সালসা সিজনিং। সালাদ বারে আছে কাঁচা শাকসবজি, যেমন লেটুস, পালংশাক, গাজর, সেলেরি, শশা, টমেটো ইত্যাদি। সাথে ছিল বিভিন্ন ধরনের শুঁটি (bean)। এরা ব্ল্যাকবিন, চিকপি, কিডনি বিন, লাইমা বিন ইত্যাদি খুব খায়। এগুলো ক্যানে করে বাজারজাত করা হয় আর কেনার পর সরাসরি খাওয়া যায়, রাঁধার দরকার পড়ে না। হার্ড ড্রিংক বারে আছে স্পারক্লিং ওয়াইন আর বিয়ারের ব্যবস্থা। বিয়ারটা ঘরে তৈরি। এত কষ্ট করে ঘরে তৈরি করার কী দরকার ছিল বুঝলাম না, যেখানে সেন্ট লুইস শহরের অতি বিখ্যাত একটি বিয়ার কোম্পানির নাম বাডওয়াইজার (Budweiser)। সেন্ট লুইসে গোড়াপত্তন হলেও এখন এটা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেচাবিক্রি করে। ওদের কাছ থেকে কিনলেই হত! কিন্তু না, সেন্ট লুইস শহরের পার্টিতে ঘরে তৈরি বিয়ার বেশ স্বাভাবিক। এখানকার মানুষ মনে হয় বিয়ার তৈরিতে সিদ্ধহস্ত। আরেকটা নতুন পানীয় দেখলাম বারে, গাঁজানো চা। কিছু একটা গাঁজিয়ে এই চা বানানো হয়েছে। আমার দেখা প্রথম গাঁজানো চা হলেও অনেকে আগেও চেখেছে এটা। ওরা বলল, জিনিসটা নাকি সেই লেভেলের! ঠিক করলাম, মদ খাই আর না খাই, গাঁজানো চা খাবই খাব। ডেজার্ট‌ বারে দেখলাম আমাদের ডিপার্টমেন্টের প্রধান শেফ টড পার্ক‌হার্স্ট‌ের তৈরি পেস্ট্রি, ফ্রুট সালাদ, আর চকলেট ভ্যানিলা মৌস (Mousse)।

সারাহ পড়েছে সালাদ বারের দায়িত্বে। মলি, রন লুথ, কিমি আর মেইশাকে দেখছি হার্ড ড্রিংক বারে। স্যালাস কিচেনের ম্যানেজার জ্যাকি আর স্যালাস ক্যাফের ম্যানেজার শিয়াওকে ধরে আনা হয়েছে পার্টি তদারকির জন্য। বুঝা যাচ্ছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ পার্টি। ড্রিংক বার থেকে একটু দূরে এক কোণে গিটার হাতে একজন গায়ক বসে আছেন। গুনগুন করে গাইতে গাইতে গিটার টিউনিং করছেন। গায়কের সামনে মাইক্রোফোন আর পাশে বিশাল স্টেরিও সিস্টেম রাখা। অতিথিরা এলে শুরু হবে লাইভ মিউজিক। মেইন ডিশ বার আর সালাদ বার বাগানের এক মাথায়, পাশাপাশি; ড্রিংক বার আর ডেজার্ট‌ বার বাগানের আরেক মাথায়, পাশাপাশি। আমার আর সারাহর মধ্যে চোখাচোখি হল। দুজনেই ড্রিংক বারে ঢুঁ মারতে চাচ্ছি। ওখানে বেশিরভাগ স্বেচ্ছাসেবী জটলা বেঁধে আছে। হাহাহিহির শব্দও শুনছি। এখনো অতিথিরা আসা শুরু করেনি বলে দুজনে দৌড় দিলাম।

গিয়ে দেখি বিশাল দুটো ড্রামে বিয়ার আনা হয়েছে। ওয়াইনের বোতল টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখা। মলি আর রন মিলে অনুশীলন করছে কীভাবে ড্রামে লাগানো পাইপ থেকে বিয়ার ঢেলে পরিবেশন করবে। ওদের অনুশীলনের গিনিপিগ হচ্ছে মেইশা, সারাহ মরিসি, কিমি। দুজনে বিয়ার ঢেলে দিচ্ছে খেতে ওদের। আমরা আসার পর আমাদেরও খাওয়ার প্রস্তাব দিল। আমি খুব একটা ভরসা পেলাম না খেতে, যদি মাথা ভনভন করে? সারাহ ঠিকই এক গ্লাস ভর্তি করে নিল। ওদের খেয়ে অভ্যাস আছে। খেতে খেতে কাজ করতে পারে। আমি অতটা ঝানু নই। খেলে নেশা লেগে যেতে পারে। পরে হবে কেলেংকারি। মলি আজ পরেছে চামড়ার সাথে লেপটে থাকা টপ আর জিন্স। টপ আবার নাভির উপরে গিট্টু মারা। এরকম ‘আমেরিকান স্টাইলের’ জামা প্রথম পরতে দেখলাম ওকে। ক্লাসে কেউ নাভি দেখানো জামাকাপড় পরে না। হাঁটুর উপর অব্দি শর্টস পরে খোলা পা দেখায় ঠিকই কিন্তু টপের বেলায় পেট ঢাকা টপ পরে। আমি প্রথম প্রথম বাঙালি চিন্তাধারার সাথে মিলাতে পারতাম না। দেশে থাকতে ভাবতাম আমেরিকায় সবাই শরীর দেখিয়ে বেড়ায়। কিন্তু এখানে আসার পর দেখি সবাই স্বাভাবিক জামাকাপড় পরে। তাই মলির আচমকা পেট দেখানো গেটআপে আমি চমকে গেলাম। সাথে মেকআপ দিয়ে মাঞ্জা মেরে এত সুন্দর হয়ে এসেছে যে, চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। মোটামুটি সব মেয়েই মেকআপ দিয়েছে। সারাহ ক্যারোল, যে কিনা সালাদ বারে বসবে, সে লাল রঙের লিপস্টিক আর গালে রুজ মেখে এসেছে। এতেই ওকে লাগছে সিনেমার নায়িকার মত। মেইশারও একই অবস্থা। এদের আমি মেকআপ ছাড়া দেখে অভ্যস্ত। এই প্রথম সবাইকে সেজে আসতে দেখছি। সবার দিকেই হাঁ করে তাকিয়ে আছি। একটুখানি মেকআপ কীভাবে মানুষকে বদলে দিতে পারে, তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ হাঁটাহাঁটি করছে সামনে। ছেলেরা মাথার টুপি উল্টোভাবে পরে বেশ সেক্সি লুক এনেছে।

আমার ঘাড়ে ব্যাকপ্যাক ঝুলছে। এটা কোথায় রাখা নিরাপদ হবে বুঝতে পারছি না। মেইশাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমাদের টেবিলের তলায় ব্যাগ রাখলে কি নিরাপদে থাকবে?” মুখ ঝামটা দিয়ে মেইশা উত্তর দিল, “তার আমি কী জানি? এত বড় বাগান… ব্যাগ নিরাপদ থাকবে কিনা সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়?” মেইশা মেয়েটাকে এমনিতেই আমার ভাল লাগে না। আগেও ওর কাছ থেকে শীতল আচরণ পেয়েছি। এটা আমি ভিনদেশী বলে কিনা, কে জানে। এবারের আচরণেও অপমান অনুভব করলাম। মলি ব্যাপারটা দেখছিল। এগিয়ে এসে বলল, “তুমি রাখতে পার টেবিলের তলায়। বড় বাগান হলেও জায়গাটা নিরাপদ। এখানে যারা আছে বা আসবে, তারা কেউ চুরি করবে বলে মনে হয় না। আর যদি মানসিক শান্তি পেতে চাও, তাহলে তোমার কাউন্টারের আশেপাশে রাখ। সবসময় চোখে চোখে রাখতে পারবে।” মলির কথামত নিজের কাউন্টারে এসে ব্যাগ একপাশে রেখে দিলাম। মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগল মেইশার ব্যবহার। এতগুলো ক্লাসমেটের সামনে রূঢ় আচরণ করল আমার সাথে…

একটু পর দেখি পিলপিল করে ঢুকা শুরু করেছে অতিথিরা। বেশীরভাগই পুরো পরিবার নিয়ে এসেছে। বাবা, মা, ছেলেমেয়ে। মুহূর্তে পুরো বাগান ভর্তি হয়ে গেল। প্রাথমিক কথাবার্তা শেষে সবাই মেইন ডিশ নেওয়ার জন্য বাফে টেবিলের সামনে লাইন ধরল। আমরা কাঁচা মুরগি, মশলা, টর্টি‌য়া নিয়ে এসেছি বাগানে বসে টাটকা কাবাব বানাব, রুটি সেঁকব বলে। এতক্ষণ মুরগিতে মশলা মাখিয়ে মেরিনেট করা হচ্ছিলো। অতিথিদের আসতে দেখে দ্রুত বার্বি‌কিউ মেশিনে চড়ানো হয়েছে। অ্যালিসিয়া নামের এক ইন্টার্ন টর্টি‌য়া সেঁকছে। আমার দায়িত্ব হল প্লেটে কাবাব আর টর্টি‌য়া সাজিয়ে বাফে টেবিলে রাখা। অ্যালিসিয়া টর্টি‌য়ার প্যাকেট খোলা, চুলাতে দেওয়া আর সেঁকা একা হাতে সামলাতে পারছে না দেখে আমি প্যাকেট খোলার দায়িত্ব নিলাম। একটু পর দেখি ত্রিশজনের মত লাইন ধরে দাঁড়িয়ে পড়েছে। আমি প্লেট সাজিয়ে কূল পাচ্ছি না। অবস্থা সামাল দিতে জ্যাকি এগিয়ে এল। দ্রুত হাতে কাবাব আর টর্টি‌য়া সাজাতে লাগল। আমার ঠিক পাশেই জ্বলছে বার্বি‌কিউয়ের আগুন। প্রচণ্ড ধোঁয়া উঠছে মেশিন থেকে। নাক, মুখ দিয়ে ধোঁয়া ঢুকে বারবার কাশি আসছে, হাঁচি পাচ্ছে। অবস্থা খুবই খারাপ। কাবাব বানাচ্ছে ফেইথ নামের আরেক ইন্টার্ন। সে বারবার আমাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছে ধোঁয়ার জন্য। বেচারার আর কী দোষ?

ঘণ্টা দুয়েক ধরে আমরা খাবার পরিবেশন করলাম। বিকেল পাঁচটায় শুরু হয়েছিল পার্টি আর এখন বাজে সাতটা। পরিবেশকরা ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়েছি। মাঝে একবার আমাদের ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান এসে হাই হ্যালো করে গেছেন। প্রশংসা করেছেন রান্নার। বলেছেন, আমরাও যাতে সবার সঙ্গে খেয়ে নিই। কিন্তু ক্যাটারিংয়ের প্রধান শেফ ড্যান বলল কাজ শেষ করে খেতে। আমরা খেতে বসার পর কেউ এসে কিছু চাইলে বিপদে পড়তে হবে। কিন্তু চোরে শোনে না ধর্মের কাহিনী, ক্ষুধা মানে না দরকারি কথা। আমরা নিজেরা ঠিক করলাম এক দল খাবে, আরেক দল অতিথিদের দিকে চোখ রাখবে। এরপর ঐ দল খাবে, আর খাওয়া শেষ করা দল অতিথি সামলাবে। কিন্তু এটা করতে গিয়ে দেখা গেল কেউই শান্তিমত খেতে পারছে না। সবার মনে আশংকা, এই বুঝি কাজ চলে এল! আধাখেঁচড়া করে খেয়ে পেটটাকে শান্ত করা হল। অতিথিরা খাওয়া শেষ করলে পুরোদমে খানাপিনা করব।

ঘড়ির কাঁটা মাত্র সাড়ে সাতটা ছুঁই ছুঁই অথচ আকাশ ঘন কালো হয়ে গেছে। ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিক বলে এমন ঠাণ্ডা হাওয়ার ছড়াছড়ি। অক্টোবর নাগাদ নাকি সেন্ট লুইসে জব্বর ঠাণ্ডা পড়ে যায়। আমি ঐ ঠাণ্ডা দেখার জন্য হাঁ করে বসে আছি। পশ্চিমে আসার পেছনে আমার অন্যতম অনুপ্রেরণা ছিল তুষারপাত দেখা। এখন অবশ্য তুষারপাত দেখার জন্য পশ্চিমে আসতে হয় না, ফেব্রুয়ারি মাসে দার্জিলিং গেলেই তুষারের দেখা পড়ে। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল প্রথম তুষারপাত দেখব স্বপ্নের দেশ আমেরিকায়। হুমায়ূন আহমেদ তার জীবনীতে প্রথম তুষারপাত দেখার ঘটনা লিখে আমার মাথা নষ্ট করে দিয়েছিলেন। অষ্টম শ্রেণীতে থাকতে প্রথম পড়েছিলাম হুমায়ুনের “হোটেল গ্রেভার ইন” বইটা। সেখানে একটা অধ্যায় ছিল “প্রথম তুষারপাত” নামে। নর্থ ডাকোটার ফার্গো শহরে পিএইচডি করার সময় হুমায়ূন প্রথম তুষারপাত দেখেন। দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যান। এত সুন্দর! এত সুন্দর! সেই থেকে আমারও ইচ্ছা আমি ফার্গো শহরে বসে জীবনের প্রথম তুষারপাত দেখব। ইচ্ছা পূরণের জন্য আমি নর্থ ডাকোটা আর সাউথ ডাকোটা – উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের সাথেই যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম। কেউ আমার ইমেইলের উত্তর দেননি। ফলে ডাকোটায় আসার স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে গিয়েছিল।

আরেকটা ঘটনা ঘটার ফলে আমেরিকায় আমার প্রথম তুষারপাত দেখার সম্ভাবনা নাকচ হয়ে গিয়েছিল। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অফিস ট্যুরে ইতালি যাচ্ছি। তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক বিমানবন্দরে বসে পরবর্তী ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করছি, এমন সময় সহকর্মীদের একজন বললেন, “তুষারপাত হচ্ছে!” লাউঞ্জে বসে আছি। যেদিকে মুখ করে বসেছি, সেদিকের পুরো দেওয়াল জুড়ে কাঁচ। রানওয়ে দেখা যায়। একটু আগেই গুনে দেখেছি প্রতি মিনিটে প্রায় দশটা উড়োজাহাজ উঠানামা করছে দৃশ্যমান রানওয়েগুলোতে। আমার চোখের আড়ালে রয়েছে আরও অনেকগুলো রানওয়ে। সবগুলোই এমন ব্যস্ত কিনা, কে জানে! এমনি এমনি তো আর বিশ্বের দশতম ব্যস্ত বিমানবন্দরের খেতাব পায়নি। এই তথ্যও একটু আগে অন্তর্জাল ঘেঁটে বের করেছি। যা হোক, সহকর্মীর কথায় ভাল করে লক্ষ্য করলাম বাইরে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মত পড়ছে। আমি এতক্ষণ ভেবেছি বৃষ্টি। কিন্তু হাবিল ভাইয়ের কথায় অবাক হয়ে কাঁচের কাছে গেলাম। বুঝলাম গুঁড়িগুলো পানি নয়, সাদা দানা। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। তুষারপাত হচ্ছে? এটাই তুষারপাত? পিচঢালা রাস্তায় তাকিয়ে দেখলাম তুষার জমছে না, বরং দানাগুলো পড়ে মুহূর্তেই পানি হয়ে যাচ্ছে। ধ্যেত! এটা আবার কেমন তুষারপাত? তুষারপাত হবে হলিউডি মুভিতে যেমন দেখায়, তেমন। সাদা তুলার মত বরফ পড়বে আকাশ থেকে, মুহূর্তে রাস্তাঘাট সাদা হয়ে যাবে। নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম এই বলে, এটা তুষারপাতের কোনো জাতই না। আসল তুষারপাত দেখব আমেরিকা গিয়ে।

আবার লাইনচ্যুত হয়ে গেছি। ফিরে আসি হোমকামিং ডে’র গল্পে। ঠাণ্ডা হাওয়া আমাদের একটা সুবিধা এনে দিল। অতিথিরা এক এক করে বিদায় নেওয়া শুরু করল। সবাই ঝেঁপে ঠাণ্ডা পড়ার আগে বাসায় যেতে চায়। গায়ক তখনও গান গেয়ে চলেছেন। মৃদুমন্দ গলায় একের পর এক গান গাচ্ছেন। এত ভাল লাগছে শুনতে! অন্ধকার বাগানে কেবল বড় বড় মরিচবাতির আলো, বইছে শীতল হাওয়া, একপাশ থেকে ভেসে আসছে সুরেলা কণ্ঠ, সাথে গিটারের মূর্ছনা। নিজেকে হারিয়ে ফেলতে কি আর কিছু লাগে? গান শুনে শুনে এবার আমরা খেয়ে নিলাম। পুরো বাগানে শুধু আয়োজনকারীরা। ইচ্ছেমত সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে খেয়ে নিচ্ছে। হার্ড ড্রিংক বারে গিয়ে দেখি  ওয়াইন বা বিয়ারের বদলে সবাই গাঁজানো চা পান করেছে। খুব হিট হয়েছে আইটেমটা। ফলে আমাদের জন্য অবশিষ্ট কিছু নেই। আমার এটাই খাওয়ার ইচ্ছে ছিল আর এটাই শেষ হয়ে গেছে। শিয়াও জোর করল কিছু একটা নিতে। নিলাম স্পার্ক্লিং‌ রেড ওয়াইন। ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার জন্য সবাই জ্যাকেট, সোয়েটার, হুডির ভিতর ঢুকে পড়েছি। এখন ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছি আর গান শুনছি। চাট হিসেবে আছে বাদাম, তিশির বীজ আর মিষ্টি কুমড়ার বিচি। গায়কের সাথে চুক্তি ছিল রাত আটটা পর্যন্ত। আটটা বাজলে উনি গান শেষ করলেন, তারপর সবকিছু গুছিয়ে চলে গেলেন। উনি যাওয়ার পর আমাদেরও তাড়াহুড়া শুরু হল। আধা ঘণ্টার ভেতর সবকিছু গুছিয়ে যে যার মত রওনা দিলাম বাসার উদ্দেশ্যে। শিয়াও আমাকে রাইড দিতে চাইল। আমি বেশ কয়েকবার কাটাতে চাইলাম কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। স্যালাস ক্যাফেতে কাজ করার সময় শিয়াওয়ের সাথে আমার প্রায়ই স্নায়ু যুদ্ধ চলে। সেজন্য ওর কাছ থেকে কোনো সুবিধা নেওয়ার পক্ষপাতী আমি নই। কিন্তু সে আমাকে একা ছাড়বে না। এত রাতে নাকি পাবলিক বাসে উঠা আমার জন্য নিরাপদ নয়। কীভাবে বুঝাই, যে দেশ থেকে এসেছি, সে দেশের পাবলিক বাসে উঠার অভিজ্ঞতা থাকলে সেন্ট লুইসের পাবলিক বাস রীতিমত স্বর্গ। শেষ পর্যন্ত শিয়াওই জয়ী হল। উঠলাম ওর ঝা চকচকে নিসান আল্টিমায়। এই গাড়ি শিয়াওয়ের প্রাক্তন প্রেমিক অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমানোর আগে ওর কাছে বিক্রি করে গেছে। পাক্কা বারো হাজার ডলার দিয়ে কিনতে হয়েছে শিয়াওকে। জিজ্ঞেস করলাম, প্রেমিক হিসেবে কিছু কমিয়ে রাখেনি? শিয়াও রাগত স্বরে বলল, ‘ফাকিং বাস্টার্ডটাকে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানোর জন্য আমি এত টাকা দিয়ে কিনেছিলাম। আর অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে সে আমাকে ডিচ করেছে।’ কথা বাড়ালাম না। মেজাজ গরম করে না দুর্ঘটনা ঘটায় আবার!

অভিজ্ঞতা হল একখানা আমেরিকান পার্টির। পার্টিতে হই-হল্লা, উচ্চৈঃস্বরে সিডি বাজানো ছিল না, ছিল শান্ত সমাহিত একটা পরিবেশ। কিন্তু এটাকে আমেরিকান পার্টির মানদণ্ড ভাবলে ভুল হবে। এখানে নাইট ক্লাবের উদ্দাম পার্টিও আছে।

পর্ব তেরো এখানে

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
100 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post যুক্তরাষ্ট্রে স্নাতকোত্তর জীবনের দুই বছর (পর্ব ১১)
Next post যুক্তরাষ্ট্রে স্নাতকোত্তর জীবনের দুই বছর (পর্ব ১৩)