পর্ব এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো, বারো, তেরো, চৌদ্দ
(৩৪)
কফি
আমেরিকানদের কফি প্রীতি অসাধারণ। সকাল বেলা ভার্সিটি প্রাঙ্গণে পা রাখলে দেখা যায় লোকজন কফির মগ হাতে হাঁটাহাঁটি করছে। মগগুলোর সিস্টেম খুব সুন্দর। ডিসপোজেবল উপাদান দিয়ে তৈরি। হাতে যেন গরম না লাগে সেজন্য মগের চারপাশে কাগজের তৈরি একটা বেড়া লাগানো যায়। আমেরিকায় এলে কফি বিশারদ না হয়ে পারা যায় না। কয়েকমাস থেকে আমি মোটামুটি শিয়াল পণ্ডিত। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে আজ কফি নিয়ে কথা বলব। ইতালিয়ানদের সাথে কাজের সুবাদে জানতাম ঐ জাতি প্রচণ্ড কফি নির্ভর। দিনে ছয় সাতবার কফি খেতে হয় ওদের। আমরা যেমন ইনস্ট্যান্ট কফিকেই কফি বলে জানি, ইতালিয়ানরা খায় এস্প্রেসো কফি। এস্প্রেসো কফি বানানোর জন্য কফির বীজ মিহি গুঁড়ো করে ব্যবহার কড়া হয়। গুঁড়ো কফি বীজকে বলে ground coffee। আপনি যদি সাধারণ কফি খেতে চান, তাহলে মিহি গুঁড়ো করা বীজের দরকার পড়ে না। দানা দানা ground coffee হলেই চলে।
এস্প্রেসো কফি বানানোর জন্য আলাদা যন্ত্র আছে। সে যন্ত্র হতে পারে বৈদ্যুতিক, হতে পারে চুলায় চালানো। আমাদের অফিসে ব্যবহার করা হত অবৈদ্যুতিক যন্ত্র। সেটার কারবার দেখে দারুণ বিস্মিত হয়েছিলাম। ধাতব কেতলি টাইপ জিনিস। সেখানে তিনটা অংশ আছে। নিচের নিচের অংশে ঢালা হয় পানি, মাঝের অংশে একটা ছাঁকনি থাকে যার মধ্যে রাখা হয় কফির মিহি গুঁড়ো বীজ, উপরের অংশ থাকে খালি। এরপর যন্ত্রটা চুলায় বসানো হয়। তাপ পেয়ে পানি যখন বাষ্প হয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করে, তখন ছাঁকনির ভিতর দিয়ে কফির গুঁড়োর মধ্যে পরিবাহিত হয়। এতে করে গুঁড়োর মধ্যে থাকা সব রাসায়নিক (ক্যাফেইন-সহ অন্যান্য পদার্থ) বাষ্পের সাথে মিশ্রিত হয়ে সরু নলের মাধ্যমে যন্ত্রের সবচেয়ে উপরের অংশে পরিবাহিত হয়। সেখানে জমা হয়। এটাই এস্প্রেসো কফি কারণ আপনি এক্সপ্রেস বা বাষ্পের চাপ ব্যবহার করে কফিটা বানাচ্ছেন। এই কফি আবার ইতালিয়ানরা খেত দুধ ছাড়া। প্রচণ্ড কড়া এই কফি কিছুটা টক স্বাদ যুক্তও। এমন স্বাদের জন্য ইতালিয়ান কফি সারা বিশ্বে নামকরা। এই কফি পরিবেশন করা হয় খুব ছোট পেয়ালায়। ওইটুক কফি খেলেই আপনি পাঁচটা ইনস্ট্যান্ট কফির ডোজ পেয়ে যাবেন। প্রথমবার খেয়ে আমার বমি চলে এসেছিল। তারপর সেটা এক বালতি পানি দিয়ে পাতলা করে, দুধ আর চিনি মিশিয়ে খেয়েছিলাম।
আমরা চা-পাগল জাতি। কফি টফি আমাদের দেশে চালু হয়েছে ক’দিন হল। তাই আমরা নেস্ক্যাফের ইনস্ট্যান্ট কফিতেই সন্তুষ্ট। এর বাইরে কফির যে একটা বিশাল দুনিয়া আছে, সেটা ক’জনই বা জানি? ইতালিয়ানদের সাথে কাজ না করলে আমারও জানা হত না এস্প্রেসো কফি দিয়েই বানানো হয় ক্যাফে লাত্তে, কাপুচিনো, ক্যাফে মাক্কিয়াতো, ক্যাফে মোকা। দামী রেস্তোরাঁয় গিয়ে ইতালিয়ান কফি খাওয়া মধ্যবিত্তদের পোষায় না, কিন্তু আমেরিকায় এলে একটু শৌখিন হওয়াই যায়। এখানে কফি বানানোর যন্ত্র, ground coffee সবকিছুর দাম হাতের নাগালে। ফলে ইনস্ট্যান্ট কফির চক্র থেকে বের হওয়া যায়। আমরা প্রথমবার ইনস্ট্যান্ট কফি কিনতে গিয়ে ভুল করে ground coffee কিনে ফেলেছিলাম। সেই ground coffee খাওয়ার জন্য কিনতে হল কফি মেকার। এখন ground coffee খেতে খেতে ইনস্ট্যান্ট কফি ভাল লাগে না।
আমেরিকানদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল স্টারবাক্সের কফি। যেখানে সেখানে ব্যাঙের ছাতার মত স্টারবাক্স কফি শপ দেখা যায়। জ্যাকি নামের আমার এক কলিগ আছে। ভার্সিটির ক্যাফে থেকে ওর বিনামূল্যে কফি খাওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু সে কফি তার চাই না, তার চাই স্টারবাক্সের কফি। সে কিনে খাবে সমস্যা নেই, কিন্তু খাবে স্টারবাক্সের কফি। এই ব্র্যান্ডের সাথে আমার সম্পর্ক খুব একটা ভাল না। দেশে থাকতে স্টারবাক্সের নাম এত শুনেছি যে, ইতালি যাওয়ার পথে কামাল আতাতুর্ক বিমান বন্দরে নেমে ঢুকেছিলাম এই শপে। সবকিছুর অনেক দাম, কিন্তু অফিস খাওয়াবে। তাই চার ডলার দিয়ে ক্যাফে লাত্তে অর্ডার দিলাম। খেয়ে একটুও ভাল লাগল না। সাধারণ স্বাদের কফি। সমস্যা কি আমার, না কফির? এরপর থেকে নিজের খরচে স্টারবাক্স থেকে কফি কিনে খাইনি। চার ডলারে গ্রাউন্ড কফি কিনে আনি, সেটায় কফি ক্রিমার মিশিয়ে ইচ্ছামত স্বাদের কফি বানিয়ে খাই। কিছুদিন আগে আনজাম ভাই ‘ফ্রাপুচিনো’ নামের একটা কোল্ড কফি খাওয়ালেন। গ্রিসের ফ্রাপে আর ইতালির কাপুচিনো কফি মিশিয়ে স্টারবাক্স এই কফি বানিয়েছে। ভালই লেগেছে।
কার্ড
আমেরিকায় মানুষজন নগদ টাকা নিয়ে খুব একটা চলাফেরা করে না। ক্রেডিট কার্ডই টাকা পরিশোধের মূল হাতিয়ার। একেকজনের তিন, চারটা ক্রেডিট থাকা আশ্চর্যজনক কিছু নয়। তবে ক্রেডিট কার্ড বেশি থাকলে ঝামেলা। ক্রেডিট স্কোর কমে যায়। আমেরিকা এমন এক দেশ, যেখানে প্রতি পদে আপনার ক্রেডিট স্কোর পরীক্ষা করা হবে। বাড়ি ভাড়া নেবেন? ক্রেডিট স্কোর দেখবে। গাড়ি কিনবেন? ক্রেডিট স্কোর দেখতে চাইবে। বাড়ি কিনবেন? ক্রেডিট স্কোর লাগবে। যত ভাল স্কোর, তত সহজ সবকিছু করা। এই স্কোর নির্ভর করে আপনি কত ডলার ঋণ করছেন প্রতি মাসে, আর কতটা সফলভাবে সে ঋণ শোধ করছেন তার উপর। তবে ক্রেডিট স্কোর না থাকলে যে রাস্তায় বসতে হবে, তাও না। আমরা যখন প্রথম বাসা নিয়েছিলাম, ক্রেডিট স্কোর ছাড়াই নিয়েছিলাম। এক বন্ধুর বদৌলতে বাসাটা পেয়েছিলাম। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী সমাজে ক্রেডিট স্কোরের গুরুত্ব ভয়ানক। ক্রেডিট মানে ঋণ। বাংলাদেশে যেখানে না পারতে মানুষ ঋণ নেয়, আমেরিকায় আপনাকে দিয়ে জোর করে ঋণ নেওয়াবে। জোর বলছি কারণ ক্রেডিট স্কোর একটা না একটা সময় লাগবেই। কেন এরকম সিস্টেম চালু হল, জানি না। আমরাও ক্রেডিট কার্ড নিতে বাধ্য হলাম। দেশে থাকতে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, জীবনেও ক্রেডিট কার্ড নেব না। ক্রেডিট কার্ড মানেই অতিরিক্ত খরচ করে ফেলার ভয়। কিন্তু আমেরিকায় পা রাখার দেড় মাসের মাথায় আমি ক্রেডিট কার্ডের মালিক হয়ে গেলাম।
এদেশে প্রায় সবকিছুই অনলাইনে করা যায়। টাকা পরিশোধ করা, রেজিস্ট্রেশন করা, পরীক্ষা দেওয়া। জীবন খুব সহজ করে দিয়েছে প্রযুক্তির প্রয়োগ। আমরা বাসার এপ্লিকেশন ফি অনলাইনে দিয়েছি। টাকা নিয়ে অফিসে অফিসে দৌড়াতে হয়নি। ইলেকট্রিক বিল, ইন্টারনেট বিল অনলাইনে পরিশোধ করি। অনলাইনে জিনিসপত্র কেনাকাটা করা তো আছেই। এভাবে কেনাকাটা করা প্রচণ্ড সহজ। আগে যেখানে আমি মার্কেটে গিয়ে দশটা জিনিস দেখে একটা কিনতাম, এখন একই কাজ করি ওয়েবসাইট ঘেঁটে। কষ্ট করে মার্কেটে যেতে হয় না। বাসায় বসে, আরও কম সময়ে অর্ডার দিয়ে দিই। এসব কাজ আপনি ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড বাদে নগদ টাকা দিয়েও করতে পারবেন, তবে ঝামেলা বেশি। নগদ টাকা প্রাপকের হাতে সরাসরি দিতে হবে, অথবা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাতে হবে। এত ঝামেলায় কে যেতে চায়? অবশ্য আমাদের বাসা ভাড়া ক্যাশেও না, কার্ডেও না, চেকে নেওয়া হয়। তাই ডেবিট কার্ডের সাথে সাথে চেক বইও তুলতে হয়েছে। আমাদের আপাতত বড় কিছু কেনার পরিকল্পনা নেই। তাই শপিংমলে টাকা দেওয়ার সময় ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে ক্রেডিট স্কোর বানানোর চেষ্টা করছি। বড় অংকের টাকা ঋণ নিয়ে সেটা ঠিকমত পরিশোধ করলে ক্রেডিট স্কোর এক লাফে অনেকখানি বেড়ে যায়। আমাদের মত গরিবী হাল হলে স্কোর বাড়তে দশ বছর লেগে যাবে।
স্টুডেন্টদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে ডিস্কোভার ক্রেডিট কার্ড। সহজে এটার মালিক হওয়া যায়। তবে অসুবিধা হল, ক্রেডিট লিমিট খুব কম। প্রাথমিকভাবে দেয় মাত্র ১৫০০ ডলার। এরপর গ্রাহকের কাজকর্ম অনুযায়ী লিমিট বাড়ায়। গ্রাহক নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করলে তিন মাসের মাথায় লিমিট বাড়িয়ে দিতে পারে, আবার অনিয়মিত গ্রাহকের বেলায় ক্রেডিট রিপোর্টে লাল দাগ বসে যেতে পারে। এই লাল দাগ দেখলে কেউ আপনাকে সহজে বিশ্বাস করতে চাইবে না। কিছু বিক্রি করতে চাইবে না, ভাড়া দিতে চাইবে না। বড় কঠিন দুষ্টচক্র। ছোটখাট ক্রেডিট কার্ড দিয়ে যাত্রা শুরু করে, ভাল ক্রেডিট স্কোর বানিয়ে বড় লিমিটওয়ালা কার্ডের জন্য আবেদন করা যায়।
উচ্চারণ
আমেরিকায় আসার পর নন ইংলিশ স্পিকারদের উচ্চারণ বিভ্রাট ঘটা বেশ স্বাভাবিক। এখানে থাকতে থাকতে হয়ত আপনার উচ্চারণ আমেরিকানদের মত হয়ে যাবে কিন্তু প্রথমদিককার অভিজ্ঞতাগুলো তুলনাহীন! একদিন বাগানে কাজ করতে গিয়ে কমলা রঙের বড়ই আকৃতির টমেটো আবিষ্কার করে বাঙালি উচ্চারণে বললাম, “আমাদের দেশে এরকম ‘টমেটো’ হয় না। আমাদেরগুলো লাল লাল আর বড় বড়।” সহকর্মী চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। সে বুঝেনি আমি কী নিয়ে কথা বলছি। আবার জিজ্ঞেস করল। বললাম। এবারও বুঝল না। শেষে বললাম, “ইউ নো… ঠোমাঠো…!” সহকর্মী হাঁফ ছেড়ে বলল, “ওহ! ইউ মিন ঠোমেইডো?”
লে হালুয়া!
আরেকদিন ক্যাফের ম্যানেজার বলল কোল্ড স্টোরেজ থেকে “ল্যাডাস” নিয়ে আসতে। আমি দুইবার জিজ্ঞেস করেও বুঝতে পারলাম না জিনিসটা কী। তবুও স্টোরেজে গেলাম, হালকা পাতলা খুঁজে ফিরে এলাম। বললাম, “ল্যাডাস” নেই। ম্যানেজার তো অবাক! গতকাল মাত্র এক কার্টন ল্যাডাস কিনেছে। নেই মানে কী? আমাকে নিয়ে সে আবার স্টোরেজে গেল। একদম সামনেই রাখা কার্টন থেকে লেটুস পাতা বের করে বলল, “এটা কী?”
আরেকদিন লাঞ্চ আওয়ার শেষে এক বাক্স ডাম্পলিং প্লাস্টিক দিয়ে মুড়িয়ে (pack করে) ক্যাফেটেরিয়ার ফ্রিজে রেখেছি। যদি কর্মীদের মধ্যে কেউ নিতে চায়, নিতে পারে। এলেইন নামের এক সহকর্মী এসে ফ্রিজ পরিষ্কার করার সময় পুরনো খাবার মনে করে সেটা ফেলে দিতে উদ্যত হল। আমি হা হা করে উঠলাম।
“দেখো না তারিখ দেওয়া আছে? আই প্যাকড ইট টুডে। ফেলে দিও না।”
মেয়েটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। “ওহ, ইউ মেইড ইট টুডে! আমি খেয়াল করিনি।”
আমি বললাম, “ডিডেন্ট মেইক ইট টুডে, জাস্ট ‘প্যাকড’ ইট টুডে।”
মেয়েটা দুই পলক তাকিয়ে থাকল। “ওহ, গচা। ইউ বেকড ইট টুডে!”
পাশে দাঁড়িয়ে শিয়াও তামাশা দেখছিল। এবার বলল, “রুথ phacked ইট।” এলেইন যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। “ওহ, ইউ phacked ইট!”
সামান্য প্যা (pa) আর ফ্যা (pha) নিয়ে এত ক্যাচাল লাগবে, কে জানত! আর আমারও বালাই ষাট। ‘র্যাপড ইট’ বললেই হয়ে যেত অথচ শব্দটা মনেই আসল না।