বড়দিন বৃক্ষ আমার খুবই পছন্দের একটা জিনিস। আপনারা হয়ত একে ক্রিসমাস ট্রি হিসেবে চেনেন। বাংলায় এর কোনো নাম নেই। তাই আমি ডাকলাম ‘বড়দিন বৃক্ষ’ বলে। বড়দিনের গাছ বললে ছন্দ আসে না। ছোটবেলায় পশ্চিমা চলচ্চিত্র বা টিভি সিরিজগুলোতে দেখতাম বড়দিন এলে সবাই বড়দিন বৃক্ষ দিয়ে ঘরবাড়ি, গির্জা (চার্চ), রাস্তাঘাট সাজায়। অথচ আমাদের বাসায় এই গাছ দিয়ে সাজানো হত না। এমনকি গির্জায়ও এই জিনিস দেখতাম না। এত সুন্দর একটা জিনিস অথচ আমাদের দেশের বড়দিনে সেটা অনুপস্থিত। কেন? হালকা বড় হওয়ার পর বুঝলাম, এটা পশ্চিমা সংস্কৃতি। দেশীয় ঐতিহ্য নয়। তাই নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে বড়দিন বৃক্ষের আনাগোনা ছিল না। কিন্তু এটার প্রতি আমার অমোঘ আকর্ষণ তৈরি হল। সবসময় আফসোস হত, কেন এই ব্যাপারটা আমাদের উৎসবে ঢুকানো হচ্ছে না।
কিশোর বয়সে একদিন ইত্তেফাক পত্রিকায় দেখলাম, হোটেল সোনারগাঁ আর শেরাটনে বড়দিন উপলক্ষ্যে ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয়েছে। বাচ্চাদের জন্য বড়দিনের দিন সান্তা ক্লজ আসবেন। ঐ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার টিকেট মাথাপিছু পাঁচশো টাকা। দেখে তো চক্ষু চড়কগাছ! তবে কি দেশেও বড়দিন বৃক্ষের ঐতিহ্য চালু হয়েছে? পাঁচশো টাকার কারণে ঐ অনুষ্ঠানে যেতে পারব না বটে, কিন্তু যে শহরে বড়দিন বৃক্ষ চলে এসেছে, সেই ঢাকার তুলনায় মির্জাপুর নামের মফঃস্বলটা আর

সহ্য হচ্ছে না। কবে ঢাকায় যাব? কবে দেখব মরিচবাতি আর রঙিন বল দিয়ে সাজানো ক্রিসমাস ট্রি? একবার কি ‘চোখের দেখা’ দেখা যাবে না হোটেলের বাইরে থেকে?
এসএসসি পাশের পর ঢাকায় আসার অনুমতি মিলল। ভর্তি হলাম হলি ক্রস কলেজে। উঠলাম ফার্মগেটের এক ছাত্রীনিবাসে। ততদিনে ক্রিসমাস ট্রি নিয়ে ছোটবেলার পাগলামি আর নেই, কিন্তু অমোঘ আকর্ষণটা রয়ে গেছে। মির্জাপুর কিংবা গ্রামের বাড়ির তুলনায় ঢাকার বড়দিন অন্যরকম। এখানে সবাই আলাদা আলাদা বড়দিন করে। যদিও খ্রিস্টান পাড়াগুলোয় চাঁদা উঠিয়ে পুরো পাড়া সাজানো, ম্যাগাজিন বের করা, কীর্তন করা, ইত্যাদি চলে। কিন্তু গ্রামে যেমন সবাই সবাইকে চিনে, সবাই মিলে মজা করে, ঢাকায় কেমন যেন ছাড়া ছাড়া। যা হোক, একটা জিনিস দেখে ঢাকার বড়দিনকে ভাল লেগে গেল। সেটা হল, বড়দিন বৃক্ষ।
তেজগাঁ গির্জার সামনে ছোট ছোট ক্রিসমাস ট্রি বিক্রি করছে। সবুজ কাগজ দিয়ে পাতার মত কেটে গাছ বানিয়েছে। কিন্তু দেখতে টিভিতে দেখা গাছগুলোর মত সুন্দর নয়। গির্জার ভিতরে কিছু পাইন গাছ আছে। সেগুলোকে মরিচবাতি দিয়ে সাজিয়েছে। ফলে বড়দিন বৃক্ষের আমেজ চলে এসেছে। কয়েকজনের বাসায়ও দেখলাম দুই বা তিন ফুট লম্বা ক্রিসমাস ট্রি। বিদেশের মত আকাশছোঁয়া উচ্চতা নয়, কিন্তু নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। ভাবলাম, আমাদের বাসার জন্যও একটা কেনা যায় কিনা। দোকানদারকে যখন দাম জিজ্ঞেস করলাম, ঢোকের সাথে কেনার ইচ্ছেটাও গিলে ফেললাম। এইটুকুন একটা গাছের দাম বারো’শ, তেরো’শ টাকা। বলছি ২০০৫ সালের কথা। তখন আমার কলেজের বেতন ছিল তেরো’শর মত। অবশ্য বৃত্তি পেয়েছিলাম বলে রক্ষা। নতুবা আরও বেশি দিতে হত। তো, এরকম দামের কথা মধ্যবিত্ত বাপ-মাকে বলার সাহস আমার ছিল না।
এইচএসসি পাশের পর ভর্তি হলাম আজিমপুরের গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে। ফার্মগেটকে বিদায় জানাতে হল। চলে এলাম মোহাম্মদপুরের এক ছাত্রীনিবাসে। ফার্মগেটটার মত এটাও ছিল খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসিনীদের দিয়ে পরিচালিত এক হোস্টেল। যারা আসাদ এভিনিউ চেনেন, তারা জানেন এখানে পরপর অনেকগুলো খ্রিস্টা

ন প্রতিষ্ঠান আছে। মোহাম্মদপুর চার্চ, সেন্ট জোসেফ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, গ্রিন হেরাল্ড স্কুল। এসব প্রতিষ্ঠান দেশীয় ঐতিহ্যের পাশাপাশি পাশ্চাত্য ঘরানায়ও বড়দিন পালন করে। সে সুবাদে আমাদের হোস্টেলটাও দেশীয় ঐতিহ্যের সাথে পশ্চিমা ঐতিহ্য মিলিয়ে বড়দিনের সাজসজ্জা করত। এখানে এসে প্রথমবারের মত আমি বড়দিন বৃক্ষ সাজিয়েছি। সেটা সাজানোর পাশাপাশি রঙিন কাগজের শিকল লাগানো হত দেওয়ালে। বেলুন দিয়ে সাজানো হত খাওয়ার ঘর। চ্যাপেলের (প্রার্থনা করার জায়গা) কথা নাই বা বললাম। কিন্তু এতকিছুর পরও সন্তুষ্টি আসছিল না। আমার নিজের যে একটা ক্রিসমাস ট্রি নেই!
আমি বড় হয়েছি এমন একটা অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে, যেখানে ঈদ-পূজা-বৌদ্ধ পূর্ণিমা-বড়দিন সব উৎসবই সবাই মিলে পালন করতাম। মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বন্ধুবান্ধবরা পূজায় প্রসাদ খেতে যেত হিন্দু বন্ধুদের বাসায়। ঈদে অন্য ধর্মের বন্ধুরা আসত মুসলিম বন্ধুদের বাসায়। এমন পরিবেশে থাকলে প্রতিটা ধর্মের উৎসব পালন করাটা মোটামুটি অভ্যাসে পরিণত হয়। বাবা-মাকে দেখেছি ঈদের দিন বাসায় পোলাও আর ঝাল গরু রান্না করতে; পূজার সময় নিরামিষ খিচুড়ি, লাবড়া করতে। ফলে ধর্ম অন্যের হলেও উৎসব সবার দেখেই আমি বড় হয়েছি। যদিও কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের বেড়াজালে আমাকে বাঁধা যাবে না, তবুও বিভিন্ন ধর্মের উৎসবে শামিল হতে আমার ভালো লাগে। ঈদের সময় দাওয়াত খাওয়ার জন্য আমি মুখিয়ে থাকি, দুর্গা পূজার সময় লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরে মণ্ডপে ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করে, পূজার প্রসাদ হিসেবে যে নিরামিষ খিচুড়ি-পায়েস-লাবড়া খেতে দেয়, সে অমৃত খাওয়ার জন্য লোভাতুর জিভ নিয়ে বসে থাকি। আবার বড়দিন এলে ঘর সাজাতে ইচ্ছে করে, ঐতিহ্যবাহী কেক বানাতে ইচ্ছে করে, ক্রিসমাস ট্রি সাজাতে মন চায়। এতে আমি প্রচুর আনন্দ পাই। ধর্ম পালন করি না বলে ঐতিহ্যবাহী উৎসবেও অংশগ্রহণ করব না, এতটা কঠোর এখনো হতে পারিনি। সেজন্যেই একটা বড়দিন বৃক্ষের জন্য আমার আকুলতা।
ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সাধ্য ছিল না ক্রিসমাস ট্রি কিনে দেওয়ার। যতদিনে তাদের মোটামুটি সাধ্য হল, ততদিনে আমি বড় হয়ে গিয়েছি। বুঝতে শিখেছি, এসব বিলাসিতা ঠিক যায় না আমাদের সাথে। এরপর আরেকটু সাধ্য বাড়ল, আর সাহস করে কিনতে গেলাম বিলাস দ্রব্য। নিউ মার্কেট, চকবাজার সব জায়গা ঘুরে ফেললাম সস্তা গাছের জন্য, পেলাম না। পুঁচকে গাছটার বিশাল দাম দেখে খালি হাতে ফেরত আসতে হল। বড়দিনের ঋতু ছাড়া এটা পাওয়া যায় না, আর এই ঋতুতে এর দাম হয়ে যায় উচ্চতা ভেদে দুই থেকে আট হাজার টাকা। দুই ফুট গাছের জন্য দুই হাজার টাকা বিলানোর মত সামর্থ্য নেই। তাই জিদের ঠ্যালায় কেনা হচ্ছিল না। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিয়ে করলাম, শুরু হল নিজের সংসার। চিন্তা করলাম এই বড়দিনে একটা গাছ কিনেই ছাড়ব। সেদিন ছিল নভেম্বরের ২৭ তারিখ। কী যেন কেনার জন্য যমুনা ফিউচার পার্কে গিয়েছি। এই দোকান সেই দোকান ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ চোখ আটকে গেল ছোট একটা দোকানে। সেখানে একটা ক্রিসমাস ট্রি সাজিয়ে রাখা। বুঝতে পারছিলাম না এটা বিক্রির জন্য, নাকি দোকানের সাজসজ্জা হিসেবে রাখা।
দোকানদারকে জিজ্ঞেস করার পর বললেন বিক্রির জন্য রাখা। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ শুরু হল। জানতে চাইলাম দাম কত। দোকানদার

বললেন, সব ডেকোরেশনসহ একদাম বারো’শ। আমি চোখ পিটপিট করলাম। চার ফুট গাছটার দাম বারো’শ, তাও আবার মরিচবাতি আর টুকিটাকি জিনিসসহ? এ তো পুরো উইন-উইন সিচুয়েশন! দরদামের ঝামেলায় না গিয়ে সাথে সাথে কিনে ফেললাম। কেনার পর যে প্রশ্নটা মাথায় ঘুরছিল সেটা করে ফেললাম, “আপনি এত সস্তায় ক্রিসমাস ট্রি দিচ্ছেন কীভাবে?” দোকানদার জানালেন, এটা গত বছরের লট। এই বছরের লট আসলে দাম বেড়ে যাবে। তাছাড়া এখনো ডিসেম্বর মাস শুরু হয়নি। ডিসেম্বরে সবাই কিনতে আসে বলে দাম বেড়ে যায়। নভেম্বর বলে আমরা বেঁচে গিয়েছি। কানের পাশ দিয়ে গুলি গিয়েছে।
এটাই ছিল আমার কেনা প্রথম বড়দিন বৃক্ষ। একদম নিজের ক্রিসমাস ট্রি। বাসায় এনে সাজানোর পর খুশিতে চোখে পানি এসে গেল। নভেম্বর শেষ না হতেই আমার বাসায় ক্রিসমাসের ছোঁয়া লেগেছে। অথচ পশ্চিমা রীতি অনুযায়ী, বড়দিনের আগের দিন নাকি এই বৃক্ষ সাজানোর কথা! আবার খুলে ফেলার কথা বড়দিন শেষ হওয়ার বারোদিন পর। কে শোনে এসব? আমি যতদিন দেশে ছিলাম, সবসময় জ্বালিয়ে রেখেছিলাম বড়দিন বৃক্ষ। এটা আমার কাছে বড়দিনের কোনো সজ্জা ছিল না, ছিল ছোটবেলা থেকে পালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন। আসার আগে বাবা-মায়ের কাছে জমা দিয়ে এসেছিলাম গাছটা। এখন উনারাই সাজান।

য়ে লম্বা গাছের রূপ দেওয়া হয়। ঐ কার্টনে পাঁচটা অংশ রাখা আছে। আমি চারপাশে তাকালাম। বিশ্বাস হচ্ছিল না একটা আস্ত গাছ পেয়ে গেছি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। কার্টনটা এত ভারী যে আলগাতে পারছি না। তাই ঠেলে ঠেলে ঘষটাতে ঘষটাতে এলিভেটরে উঠালাম। বাসায় এনে যখন জোড়া লাগালাম, ছয় ফুট লম্বা বড়দিন বৃক্ষ তৈরি হল। আমার চোয়াল ঝুলে পড়ল। কতটা বেপরোয়া হলে এই জিনিস কেউ ফেলে যায়?
