তুষারপাত কিংবা তুষার নিয়ে আদিখ্যেতা আমার ছোটবেলা থেকেই। যারা তুষারহীন দেশে বাস করে, তাদের মধ্যে এই আদিখ্যেতা থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্রকৃতির এত সুন্দর একটা ঘটনা নিয়ে আদিখ্যেতা না থাকলেই বরং অস্বাভাবিক। জানি না হুমায়ূন আহমেদ তুষারপাতের সাথে বৃষ্টির তুলনা কীভাবে করেছিলেন। আমার কাছে দুটো ভিন্ন সৌন্দর্য। সম্পূর্ণ ভিন্ন। যারা ভাবছেন হুমায়ূনের নামে আজেবাজে বকছি, তারা আয়নাঘর উপন্যাসটা পড়ে দেখুন। বাঙালি নায়ক তুষারপাত দেখতে দেখতে পশ্চিমা নায়িকাকে বলে, আমাদের দেশের বৃষ্টি এরচেয়েও সুন্দর। কোন মাপকাঠিতে মেপে বলে, বুঝি না। দেশের প্রতি টান থেকে হতে পারে! অভ্যস্ততা বলেও একটা কথা আছে। সারাজীবন বৃষ্টি দেখে তুষার ভাল নাও লাগতে পারে। আবার বছরের পর বছর পশ্চিমে থাকলে তুষারকেই বেশি সুন্দর লাগতে পারে। কে জানে! আমার অবশ্য যেদিন কাজে যেতে হয়, সেদিন বৃষ্টি-তুষার কিছুই ভাল লাগে না। পেইন ইন দি অ্যাস মনে হয়। বাসায় বসে গরম কোকো খেতে খেতে কিংবা অফিসে কাজের ফাঁকে জানালা দিয়ে তুষারাবৃত প্রকৃতি দেখতে ভাল লাগে। কিন্তু রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়ার সময়টুকু খুব বিরক্তিকর। দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেড়ে যায় কারণ তুষারে গাড়ির চাকা পিছলে যায়। স্বাভাবিক দিনে যেখানে চল্লিশ মাইল বেগে গাড়ি চালাতে পারবেন, তুষারের মধ্যে চালাতে হবে বিশে। তাছাড়া ব্ল্যাক আইস নামে ভয়ংকর একটা ব্যাপার আছে এখানে। স্বচ্ছ বরফ জমে থাকে রাস্তায়। বুঝা যায় না যে, বরফ আছে। সেটার উপর দিয়ে গাড়ি চললে পিছলা খাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ইউটিউব খুঁজলে অদ্ভুত সব ভিডিও পাবেন। তবে ব্ল্যাক আইস শুনে কালো রঙের বরফ ভাবার কিছু নেই। বরফ স্বচ্ছ রঙাই। কালো পিচের রাস্তায় জমে থাকে বলে কালো মনে হয়। প্রথমে শুনে তো আমি সেই উত্তেজিত! কালো রঙের বরফ দেখব। পরে দেখি এই অবস্থা।
যুক্তরাষ্ট্রে আছি আড়াই বছর। এর মধ্যে দুই বছর একমাস ছিলাম মিডওয়েস্টে, চারমাস ধরে আছি নর্থইস্টে। বিভিন্ন সময় যুক্তরাষ্ট্রের অঞ্চলগুলোকে এরকম নামে ডাকতে শুনবেন। এরা বিভিন্ন উপায়ে ভাগ করে রেখেছে পুরো দেশ। একটা ভাগ হয়ত করা হল বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের ভৌগলিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে, তো আরেকটা ভাগ করবে অর্থনীতির উপর ভিত্তি করে। আরেকটা হয়ত করল কৃষি গবেষণার উপর ভিত্তি করে, আরেকটা করল আদমশুমারির জন্য। যেমন, আদমশুমারি অধিদপ্তর যুক্তরাষ্ট্রকে চারটা অঞ্চলে ভাগ করেছে। নর্থইস্ট, মিডওয়েস্ট, সাউথ, আর ওয়েস্ট। সাউথের দুটো বিখ্যাত অঙ্গরাজ্য হল টেক্সাস আর ফ্লোরিডা। আরও পনেরটা অঙ্গরাজ্য আছে এখানে, কিন্তু সাউথ বললেই আমার খালি এদের কথা মনে আসে। আবার মিডওয়েস্টের কিছু বিখ্যাত অঙ্গরাজ্য হল মিজৌরি, ওহায়ো, মিশিগান, ক্যানসাস। নর্থইস্টে আছে নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, পেন্সিল্ভেনিয়া। ওয়েস্টে পাবেন আলাস্কা, ক্যালিফোর্নিয়া, হাওয়াই, ইত্যাদিকে।

আবার প্রথম ছবিটার দিকে তাকালে দেখতে পাবেন ভৌগলিক এলাকাভেদে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলকে। যেমন, লাল অংশটা পরিচিত ওয়েস্ট হিসেবে কারণ এটা মানচিত্রের পশ্চিম দিকে অবস্থিত। হলুদ অংশটা পরিচিত সাউথওয়েস্ট হিসেবে কারণ এই অঞ্চলের বেশ কিছু অঙ্গরাজ্য পড়েছে পশ্চিমে, কিছু দক্ষিণে। দুইয়ে মিলে সাউথওয়েস্ট। একইভাবে কমলাটা সাউথইস্ট আর নীলটা নর্থইস্ট। সবুজ অংশটা পরিচিত মিডওয়েস্ট নামে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম আর পূর্ব অংশের মাঝে অবস্থিত। তাহলে নামের মধ্যে ওয়েস্ট আছে অথচ ইস্ট নেই কেন? ইতিহাস ঘেঁটে বুঝলাম, ঊনিশ’শো শতাব্দীতে অ্যাপালেচা (Appalachia) পর্বতশ্রেণীর পশ্চিমে যে অঞ্চল পড়ত, তাকেই পশ্চিমী অঞ্চল ধরা হত। ধীরে ধীরে সীমানাটা অ্যাপালেচা থেকে মিসিসিপি নদীতে সরে আসে। অর্থাৎ মিসিসিপি নদীর পশ্চিমে যেসব এলাকা অবস্থিত, তারা পশ্চিমী এলাকা হিসেবে পরিচিতি পায়। সে সূত্রে এই এলাকাকে ওয়েস্ট বলা হচ্ছিল, আর সেই সাথে এটা মানচিত্রের মধ্যিখানে অবস্থিত বলে মিড (মিডলের সংক্ষিপ্ত রূপ) শব্দটা জুড়ে যায় ওয়েস্টের সাথে। নাম হয় মিডওয়েস্ট।

আরেকটু ঘাঁটলে এখানে একটা প্যাঁচ দেখতে পাবেন। দ্বিতীয় ছবিতে মিডওয়েস্টের বিভিন্ন এলাকার নাম দেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবুজরঙা যেগুলো, সেগুলো মিসিসিপি নদীর পশ্চিমে অবস্থিত, আর কমলা রঙেরগুলো নদীর পূর্ব দিকে। তাহলে কমলারঙা অঙ্গরাজ্যগুলো কেন মিডওয়েস্টে পড়বে? এরা তো নদীর পশ্চিমে পড়েনি! উত্তর জানলে দিয়ে যাবেন। মজার ব্যাপার হল, আদমশুমারি অধিদপ্তর মিডওয়েস্টের দাপ্তরিক নাম দিয়েছিল “নর্থ সেন্ট্রাল রিজন” বা পূর্ব-মধ্য অঞ্চল। নামটা বেশ যৌক্তিক ছিল, কী বলেন? কিন্তু ১৯৮৪ সালে তারা এই নাম বাতিল করে “মিডওয়েস্ট” গ্রহণ করে।
যাক গে, কথা বলছিলাম তুষারপাত নিয়ে। যখন মিডওয়েস্টে থাকতাম, তখন মিডওয়েস্টের একেবারে পেটের ভিতর থাকতাম। বলা যায়, পুরো যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যখান বরাবর থাকতাম। সেখানকার তুষারপাত আমার মত নাদানের জন্য ছিল বিশাল কিছু। কিন্তু সেটা যে আসলে তেমন কিছু নয় সেটা টের পেলাম কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ড অ্যান্ড ল্যাব্রাডর প্রভিন্সের এক খবর দেখে। সেখানে তুষার ঝড়ের পর দরজা সমান উঁচু বরফ জমেছে। মানুষ ঘরের ভিতর আটকা পড়েছে। যতক্ষণ না পর্যন্ত সিটি কর্পোরেশন এসে বরফ সরাচ্ছে, মানুষের বের হওয়ার উপায় নেই। অবিশ্বাস্য! কিন্তু ফেসবুকে ছবি দেখে বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম। এই যদি হয় বরফের নমুনা, আমাদের সেন্ট লুইসের কথা না তোলাই ভাল। মাঝে মাঝে মনে হত, কী একটা জায়গায় এসে পড়েছি! না আছে সাগর, না আছে পাহাড়, না আছে বরফ। আমার সেই আফসোসে পানি ঢেলে জীবন আমাকে নিয়ে এল এমন এক অঙ্গরাজ্যে যেখানে পাহাড় আছে, বরফ আছে, পাঁচ ঘণ্টা গাড়ি চালালে সাগরও আছে। ঘণ্টা দুই দূরত্বে আছে বিশাল সব হ্রদ। মোট কথা, প্রকৃতির খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। থাকিও পাহাড়ে ঘেরা এলাকায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আমাদের এলাকার উচ্চতা ১,০৪০ ফিট। অথচ সেন্ট লুইসের উচ্চতা ছিল মাত্র ৪৬৬ ফিট।
এলাম তো পাহাড় আর হ্রদের মাঝে। কিন্তু এগুলোর সাথে কী পরিমাণ শীত আর বরফ আসবে, সেটা বুঝতে পারিনি। বুঝিয়ে দিল ঝপ করে নামা শীতকাল। গত ষোল ডিসেম্বর অফিসে পৌঁছানোর পর এক সহকর্মী জিজ্ঞেস করল, “আজকে যে তুষার ঝড় হবে, শুনেছ?” আমি আমেরিকানদের মত আবহাওয়া সম্পর্কে এত খবর রাখি না। রাখা উচিৎ কিন্তু অভ্যাস হয়ে উঠেনি। বললাম, “না তো!” সে কিম্ভূত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। এত বড় একটা খবর অথচ আমি জানি না! তড়িঘড়ি মোবাইলের ওয়েদার অ্যাপ খুললাম। বিশাল সতর্কতা এসে বসে আছে। সকাল নয়টা থেকে তুষার পড়া শুরু হবে, চলবে আগামীকাল সকাল পর্যন্ত। আশংকা করা হচ্ছে পাঁচ থেকে সাত ইঞ্চি তুষার জমবে সবখানে। একান্ত বাধ্য না হলে যেন গাড়ি নিয়ে কেউ রাস্তায় না নামে। নামলেও যেন বাড়তি সতর্ক থাকে। প্রিন্সকে কল দিয়ে বললাম ঝড়ের কথা। সেও মাত্র দেখেছে এই খবর। চিন্তায় পড়ে গেলাম বাসায় যাব কীভাবে সেটা নিয়ে। অফিস ছুটি হতে হতে রাস্তায় অনেকখানি বরফ জমে যাবে। বরফের মধ্যে গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা আমাদের তেমন নেই। তাই আতংকে পড়ে গেলাম।
একটু পর শুরু হল গুঁড়ি গুঁড়ি তুষারপাত। প্রথম দফায় এমনই হয়। বৃষ্টির সাথে মিল আছে। প্রথম ফোঁটাগুলো ছোট ছোট, এরপর তুমুল বর্ষণ। এখানেও দেখি গুঁড়ি গুঁড়ি তুষারের পর শুরু হল মধ্যম আকৃতির তুষারপাত। এবারের তুষারগুলো ড্যান্ডালায়নের টুকরো উড়লে যেমন লাগে, তেমন লাগছে। গুঁড়িগুঁড়ি তুষার মাটিতে পড়ে মিলিয়ে যায়। পানি হয়ে যায়। কিন্তু ড্যান্ডালায়নের মতগুলো গলে যায় না, জমতে শুরু করে। কিছুক্ষণ ড্যান্ডালায়ন দেখে মনোযোগ দিতে হল কাজে। কোন ফাঁক দিয়ে ঘণ্টাখানিক সময় চলে গেল টের পাইনি। হঠাৎ বাইরে চোখ পড়তে দেখি তুষারগুলো হয়ে গেছে তুলোর টুকরো আকৃতির। বাতাসে ভাসতে ভাসতে নেমে আসছে মাটিতে। ইতোমধ্যে মাটি ঢেকে গেছে তুষারে। কী দ্রুত চোখের পলকে তুষার জমে যায়! ঘণ্টা তিনেকের ভেতর যদি এই অবস্থা হয়, সারাদিন সারারাত তুষারঝড় চললে কী অবস্থা হবে?
অফিস ছুটির পর প্রিন্স এল আমাকে নিতে। বলল, আসার সময় রাস্তায় বেশ ক’বার গাড়ি পিছলেছে। কার্বে উঠে যেতে যেতে প্রিন্স সামলে নিয়েছে। যাওয়ার সময়ও এমন ঘটতে পারে। আমি যেন মাথা ঠাণ্ডা রাখি। রাখলাম। পুরো রাস্তা প্রিন্স বিশ মাইল বেগে চালানোর পরও আমার ভয় ভয় লাগছিল। সামনের গাড়িটা দুইবার পিছলে যেতে যেতে সামলে নিয়েছে। বরফের মধ্যে ব্রেক করা সহজ নয় বলে সামনের গাড়ি পিছলালে আমরা থেমে দুর্ঘটনা এড়াতে পারব কিনা, তার নিশ্চয়তা নেই। যা হোক, প্রিন্সের দক্ষ চালনার বদৌলতে বাসা পর্যন্ত এলাম। এখন উঠতে হবে পার্কিংলটে। সেটা দুইতলায়। উঠতে হলে উঁচু ঢাল বেয়ে উঠতে হয়। সে ঢাল আজকে বরফে ঢাকা। প্রিন্স ধীরে ধীরে গাড়ি নিয়ে ঢালে উঠল। কিছুদূর উঠার পর পর গাড়ি কেমন পিছলে যায়। আমার তো হৃদপিণ্ড গলা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসছে প্রায়! একবার পিছলে গেলে আর দেখতে হবে না। মূল রাস্তায় গিয়ে থামবে। ততক্ষণে আমাদের উপর ট্রাক, পিকআপ সবকিছু উঠে যাবে। পত্রিকায় শিরোনাম হবে “দুজন মেধাবী শিক্ষার্থীর মৃত্যু”। কিন্তু না, প্রিন্স সামলে নিল। পিছলা খেতে খেতেই উঠল পার্কিংলটে।
পরদিন সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে দেখি তুষারপাত শেষ হয়েছে। অন্যসময় পনেরো মিনিট হাতে নিয়ে অফিসে রওনা দিই। যেতে লাগে দশ বারো মিনিট। আজকে ত্রিশ মিনিট আগে নামলাম। গাড়ির বরফ পরিষ্কার করতে হবে। সময় লাগবে। দালান থেকে বের হয়ে দেখি ঘুটঘুটে না হলেও ভালই অন্ধকার চারপাশ। গাড়ির কাছে যাওয়ার জন্য বরফে পা রাখতেই দেখি পা ছয়-সাত ইঞ্চি দেবে গেল। আমাদের গাড়িরও এক তৃতীয়াংশ বরফের ভেতর ঢুকে আছে। দশ পা এগিয়েছি কি আগাইনি, প্রিন্স বলল, “এত বরফ কেটে গাড়ি চালানো অসম্ভব। গাড়ি বের করব কীভাবে আর চালাবই বা কীভাবে? তোমার বসকে কল করে জিজ্ঞেস কর রাইড দেবে কিনা। আমার সাহস হচ্ছে না গাড়ি চালানোর।” আমি সাথে সাথে কল দিলাম। প্রিন্স আমার মনের কথাই বলেছে। বস সাথে সাথে ধরল। সমস্যা খুলে বললাম। সে রাজি হল রাইড দিতে। আমাদের বাসা থেকে মিনিট দুই দূরত্বে আছে তার গাড়ি। আমি যেন মূল রাস্তায় দাঁড়াই। ওখান থেকে আমাকে উঠিয়ে নেবে। তাই করলাম। দুই মিনিটের মাথায় বসের গাড়ি চলে এলো। আমাকে উঠানোর পর বলল, দশ ইঞ্চি পুরু বরফ জমেছে বাটলার কাউন্টিতে।
অফিসে যাওয়ার পর এক সহকর্মী জানতে চাইল আজকের সূর্যোদয় দেখেছি কিনা। উঁহু, দেখিনি। দেখার মত অবস্থা ছিল না। কিন্তু তার উচ্ছ্বাস দেখে আফসোসই হল কেন দেখিনি। অবাস্তব সুন্দর ছিল নাকি! তারপর একটা ছবি দেখাল। দেখে তো আমি হতভম্ব! এই জিনিস মিস করলাম? একটু পর প্রিন্সও ছবি পাঠাল। সেও অভিভূত আজকের সূর্যোদয় দেখে। সারা আকাশে নাকি আগুন লেগে গেছে। বাসার বারান্দা থেকে কিছু ছবিও তুলে রেখেছে আগুনের। দেখে কান্না চলে এল। এরকম সৌন্দর্য যদি আর কখনো দেখতে না পাই?

