1 0
Read Time30 Minute, 12 Second
“ওযার্ক” নামের ক্রাইম থ্রিলার টেলিভিশন সিরিজটি অনেকের দেখা। এই সিরিজ যে এলাকার উপর নির্মিত, সেই এলাকার একটা অংশ ঘুরে এলাম ২৩ ডিসেম্বর। ওযার্ক হলো আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের চারটি অঙ্গরাজ্য – আরকান্সা, মিজৌরি, ক্যান্সাস আর ওকলাহোমার উপর অবস্থিত পর্বতশ্রেণী এবং মালভূমি। আমরা যেহেতু মিজৌরিতে থাকি, তাই ঘুরে এসেছি মিজৌরিতে অবস্থিত “লেইক অফ দা ওযার্কস” স্টেট পার্কে, যেটা মিজৌরির সবচেয়ে বড় স্টেট পার্ক।
.
প্রথম সেমিস্টার শেষে বিশাল একটা ছুটি পেয়েছি। কিন্তু এই ছুটি কীভাবে কাজে লাগাব, বুঝতে পারছিলাম না। চেনাজানা ভাইয়েরা কেউ বাংলাদেশে গেছেন বিয়ে সারতে, কেউ ফ্লোরিডা যাচ্ছেন মায়ামি বিচে ঘুরতে। আমি আর প্রিন্স টাকার অভাবে বাসায় বসে ঝিমুচ্ছি আর ভাবছি সাইকেল দিয়ে যদ্দূর পারা যায়, সেন্ট লুইস শহরটা ঘুরে দেখব। এখানকার সব দর্শনীয় স্থানই ফ্রি। বিজ্ঞান জাদুঘর, ইতিহাস জাদুঘর, চিড়িয়াখানা। আবার সবগুলো জায়গাই বিখ্যাত। এরকম বিখ্যাত জায়গা সব স্টেটে ফ্রি হয় না। তাও আমাদের এগুলো দেখা হয়নি। লজ্জা, লজ্জা! ২২ ডিসেম্বর রাতে হঠাৎ আনজাম ভাই কল দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা আগামীকাল “লেইক অফ দা ওযার্কস” স্টেট পার্কে যেতে চাই কিনা। আনজাম ভাইদের ফ্লোরিডা যাওয়ার কথা ডিসেম্বরের ২১ তারিখে। যাননি নাকি? বললাম, ‘অবশ্যই যেতে চাই। আমাদের হাতে অফুরন্ত অবসর।’ ঠিক হল, ২৩ তারিখ সকাল সাতটায় আমরা রওনা দেব, যেতে লাগবে তিন থেকে চার ঘণ্টা। সারাদিন পার্কে কাটিয়ে বিকেল নাগাদ রওনা দেব, রাস্তায় ডিনার সেরে বাসায় ফিরব। ‘শাওন চে’ ভাই তার গাড়িতে করে আমাদের নিয়ে যাবেন। শাওন ভাইয়েরও ফ্লোরিডা যাওয়ার কথা। উনিও তাহলে সটকে পড়েছেন? আমাদের এখানে দু’দুটো শাওন ভাই আছেন। দুজনই রসায়নে পিএইচডি করছেন, দুজনই সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। যেন গুলিয়ে না ফেলি, সেজন্য একজনকে শুধু শাওন, আরেকজনকে শাওন চে (Che) ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। “শাওন চে” নামটা উনার নিজের দেওয়া। এই Che কি কেমিস্ট্রি থেকে এসেছে, নাকি চে গুয়েভারা থেকে, সে এক রহস্য। উনিও ভাঙতে চান না।
.
মাত্র কয়েক ঘণ্টার নোটিশে পরিকল্পনা হয়ে গেল। এ ধরনের পরিকল্পনাগুলোই টিকে যায়। যেগুলো অনেকদিন ধরে করা হয়, সেগুলো বেশিরভাগই শেষ মুহূর্তে এসে বানচাল হয়ে যায়, যেমন ফ্লোরিডা ভ্রমণ। আনজাম আর শাওন চে ভাই না গেলেও বাকি পরিকল্পনাকারীরা ঠিকই গেছেন ফ্লোরিডায়। উনারা না যাওয়ায় টরে টক্কা হল আমার আর প্রিন্সের। সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ আমাদের এপার্টমেন্টের সামনে শাওন ভাইয়ের গাড়ি উপস্থিত। মাত্র পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়ে আমার অবস্থা কাহিল। প্রিন্স ঘুমিয়েছে আরও কম। আমরা রাত জাগা পাখি। শত চেষ্টা করেও তাড়াতাড়ি ঘুমাতে পারিনি। ভেবেছি, গাড়িতে যেতে যেতে ঘুমাব। শহর থেকে বের হওয়ার আগে শাওন ভাই ম্যাকডোনাল্ডসে থামলেন। উনার কফি খাওয়া প্রয়োজন। বাকিরা কেউ কিছু কিনলাম না। শহর থেকে বের হয়ে যখন প্রকৃতির কোলে গিয়ে পড়লাম, ঘুম টুটে গেল। এ কী! পাহাড়ি এলাকা কেটে রাস্তা তৈরি হয়েছে মিজৌরিতে। পুরো রাস্তাই উঁচুনিচু, আঁকাবাঁকা তবে ভাঙাচুরা নেই। মসৃণ পিচঢালা রাস্তা ধরে গাড়ি সাঁই সাঁই করে ছুটতে লাগল। রাস্তার দুই ধারে সবুজ তৃণভূমি, কিন্তু শীতের কারণে ঘাসগুলো মরে যেতে শুরু করেছে। তার উপরেই চরে বেড়াচ্ছে গরুর পাল। গরুগুলোর চেহারা বাংলাদেশের গরুর চেয়ে আলাদা। একটাই রঙ দেখলাম এদের, কালো। আর অনেক বেশি মাংসল।
.
শুধু গরুই না, চারণভূমিতে আরও আছে ঘোড়ার দল। এত ঘোড়া আমি দেশের চিড়িয়াখানাতেও দেখিনি। আমেরিকানদের শখের বলিহারি যাই। এরা নাকি শখের বশে সিরিয়াল কিলিং করে, সেখানে ঘোড়া পোষা তো নিরীহ কাজ। গরু, ঘোড়া যারা পালে, তাদের বাড়ির আশেপাশে দেখলাম বিশাল বিশাল গোলাঘর। গোলাঘরের সামনে দাঁড়ানো এক বা একাধিক পিক-আপ ভ্যান। প্রতিটা বাড়িতেই, সেডান না থাকুক, পিক-আপ আছে। ক্ষেত খামারে কাজ করতে হলে জিনিসপাতি বয়ে নিয়ে যেতে হয়। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার নেই। সেগুলো কেনার জন্য ঘন ঘন শহরে যাওয়ার সময়ও গ্রামবাসীদের নেই। তাই একমাসের যোগান একেবারে কিনে আনার জন্য দরকার পিক-আপ ভ্যান। ক্ষেত খামারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গোলাকার খড়ের গাদা (Hay Bale)। এগুলো শুকিয়ে গবাদি পশুর খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি যে, আমরা গ্রামের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। গ্রাম বলতে আমার চোখে ভাসে মাটির ঘর, গোবর ছড়ানো গোয়ালঘর, কলাগাছ দিয়ে ঘেরা স্নানঘর আর পুস্কুনি (পুকুরের আঞ্চলিক নাম)। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আমেরিকায় আছি। আমেরিকার মত উন্নত দেশে মাটির ঘর খুঁজলে হাসির পাত্র হতে হবে। হলামও তাই। আমার অর্বাচীনতা দেখে সবাই একচোট হেসে নিলো।
.
এখানকার গ্রামের চেহারা পুরোপুরি ভিন্ন। শহরের মত পাকা বাড়ি, একাধিক গাড়ি (কোনো বাড়িতেই ‘মাত্র’ একটা গাড়ি দেখিনি), আস্তাবল (গরু বা ঘোড়ার জন্য হতে পারে, অথবা দুটোর জন্যই), বিশাল ক্ষেত, গোলাঘর। মাঝে মাঝে কিছু টলটলে পরিষ্কার পানির জলাশয় চোখে পড়ে। চারজন মিলে আমেরিকার প্রাকৃতিক সরলতার সাথে দেশের তুলনা লাগিয়ে দিলাম। চারজনেরই মনে কষ্ট, কেন আমাদের দেশ এমন ঝকঝকে তকতকে হতে পারে না। দেশের বাইরে বাঙালিদের আড্ডার মূল বিষয় থাকে দেশ নিয়ে হাহাকার আর হতাশা। খুব স্বাভাবিক। তুলনা করার মানদণ্ড হাতে থাকলে তুলনা চলে আসবেই। কিন্তু কেন আমাদের দেশ আমেরিকার মত হতে পারছে না, সে ব্যাপারেও সবাই জানে। যা হোক, সেটা অন্য বিষয়। আজ সেটা নিয়ে কথা বলব না, আজ বলব ভ্রমণ নিয়ে। গ্রাম পার হয়ে কিছুদূর এগোনোর পর বরফ পড়া শুরু হল। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে দেখেছি সারাদিন মেঘাচ্ছন্ন থাকবে। তাই বলে বরফ পড়বে, এটা দেখায়নি। হঠাৎ আনজাম ভাইয়ের মনে পড়ল, পূর্বাভাস দেখায় যিপ কোড অনুযায়ী। আমরা দেখেছি সেন্ট লুইস শহরের ৬৩১০৮ যিপ কোডের পূর্বাভাস। অথচ এটা সেন্ট লুইসের বাইরের এলাকা। এখানকার পূর্বাভাস স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন হবে। উনি সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘১৭১ মাইল রাস্তা যেতে হবে। এর মধ্যে বরফ, বৃষ্টি, মেঘ, রোদ সবই পাব আশা করি।’ সত্যিই, একটু পর দেখি বরফ কেটে গিয়ে রোদ উঁকি মারছে। কী যে ভাল লাগল! এখনও শীতে অভ্যস্ত হতে পারিনি, বিরক্ত লাগে। সূর্য দেখলে ধড়ে পানি আসে।
.
একটু পর দেখি হাতের ডানে সিক্স ফ্ল্যাগস থিম পার্কের সাইন দেখাচ্ছে। আনজাম ভাই এখানে এসেছিলেন। জানালেন, রাইডগুলো চরম। তবে সবগুলো রাইডই উচ্চতা সংক্রান্ত, যেটা আমার জন্য ভয়াবহ (আমি Acrophobia বা উচ্চতাভীতির রোগী, এজন্য রাইডে তেমন চড়ি না। ভীতু বলে অপমান করলেও না)। এরপর আবার গ্রাম। একসময় হাতের বামে পড়ল মিরামেক গুহা। এটা মিজৌরির অন্যতম আকর্ষণ। ৭.৪ কিলোমিটার লম্বা গুহায় আপনাকে নিয়ে গাইড ঘুরে বেড়াবে, দেখাবে মিলিয়ন বছরের পুরানো চুনাপাথরের সৌন্দর্য। পুরানো জিনিস আমাকে সবসময় টানে। তাই এখানে আসার ইচ্ছে আছে। তাছাড়া স্ট্যালাক্‌টাইট (খনিজ পদার্থের তৈরি ছাদ থেকে পানি চুইয়ে তৈরি হওয়া খনিজ দণ্ড) আর স্ট্যালাগ্‌মাইট (খনিজ পদার্থের তৈরি ছাদ থেকে পানি চুইয়ে মেঝেতে পড়ে মেঝে থেকে তৈরি হওয়া খনিজ দণ্ড) দেখার ইচ্ছে বহু বছরের। গুহার ভেতর এসব জমে তৈরি করে অদ্ভুত সৌন্দর্য।
.
১৭১ মাইল মানে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে চট্টগ্রাম পার হয়ে আরো ১৯ মাইল। বুঝুন ঠ্যালা! কিন্তু ফাঁকা রাস্তায় আমরা রাজা। কিছু সময় তো মাইলের পর মাইল শুধু আমাদের গাড়িই ছিল। হঠাৎ ঘটল দুর্ঘটনা। পাহাড়ি রাস্তার দোলায় অনেকক্ষণ ধরেই খারাপ লাগছিল। একসময় পেটের ভিতর প্রচণ্ড জোরে পাঁক দিয়ে উঠল। আমি কোনোমতে প্রিন্সকে বললাম, ‘বমি আসছে।’ শাওন ভাই হাইওয়ের কোথায় গাড়ি পার্ক করবেন ঠিক করতে পারছেন না। আনজাম ভাই বললেন, ইমারজেন্সি সাইন দিয়ে রাস্তার ধারে পার্ক করে ফেলতে। এখানে রাস্তাঘাটের আইন বড় কড়া। শাওন ভাই রাস্তার ধারে পার্ক করলে তার গাড়ির পেছনে দীর্ঘ লাইন বসে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কেউ তার গাড়ি ওভারটেক করে আগাবে না, কারণ রাস্তায় দুটো হলুদ দাগ সোজা চলে গেছে। এটাকে বলে ডাবল সলিড লাইন, মানে ওভারটেক নিষেধ। কিছু জায়গায় আবার একটা সলিড লাইন আর একটা ভাঙ্গা লাইন আঁকা থাকে, যার মানে আপনি ওভারটেক করতে পারবেন। এত কিছু চিন্তা করার ধৈর্য আমার নেই। আমি জানালা খুলে হড়হড় করে বমি করে দিলাম। বাতাসের চোটে সেই বমি উড়ে গিয়ে ভাসিয়ে দিল গাড়ির দরজা। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে ঠোঁট আর গাল জমে বরফ হয়ে গেল, কিন্তু ভাল লাগছিল ভীষণ। অনেকক্ষণ পর মুক্ত বাতাসে দম নিলাম। একটু পর শাওন ভাই একটা ডলার জেনারেল স্টোর পেলেন। সেখানে গাড়ি পার্ক করলেন যেন আমি ওয়াশরুমে গিয়ে তরতাজা হতে পারি। গাড়ি থেকে বের হয়ে দেখলাম, সকালে খাওয়া পাউরুটি আর লাল রঙের জ্যাম লেগে আছে দরজায়। বড় একটা পানির বোতল কিনে আনলাম। তারপর দরজাটা ধুয়ে টিসু দিয়ে মুছলাম। আপাতত এভাবে চলুক, ভ্রমণ শেষে গাড়ি ওয়াশ করতে হবে।
.
একাউন্টসে যে মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন, তার ডান হাত প্লাস্টার করা। বাম হাত দিয়েই সব কাজ সারছেন। জিজ্ঞেস করলাম, উনাদের এখানে ওয়াশরুমের ব্যবস্থা আছে কিনা। মহিলা একটা চাবি দিয়ে বললেন, দোকানের শেষ মাথায় ওয়াশরুম আছে। আমি আর শাওন ভাই হাতমুখ ধুয়ে এলাম। একটা বড় দেখে Fritos Corn Chips কিনলাম যেন বমি ভাবটা দূর করতে পারি। এই চিপ্স দারুণ জনপ্রিয় হল সবার কাছে। এত মজা করে সবাই খাবে জানলে আরও কয়েক প্যাকেট কেনা যেত। একটু পর আসলাম একটা মফস্বলে। এখানে কিছু দোকানপাট দেখা গেল, তারপরও খুব শান্ত, নীরব। এত নীরবতা কেমন যেন অদ্ভুত লাগে। আমরা যে এতদূর গেলাম আর এলাম, রাস্তায় একটাও মানুষ দেখিনি। শুধু গাড়ি আর গাড়ি। শাওন ভাই ঘোষণা দিলেন, পার্কে পৌঁছাতে আরও এক ঘণ্টা লাগবে। কীভাবে কী? এক ঘণ্টা আগে বললেন, এক ঘণ্টা পর পৌঁছে যাব… এখন এক ঘণ্টা বাড়ল কী করে? গাড়িতে বসে অসহ্য লাগছে। এই ঘোষণায় অসহ্য ভাব সীমা অতিক্রম করল। শাওন ভাইয়ের জিপিএস কোনো কারণে হাইওয়ে দিয়ে পথ না দেখিয়ে পার্শ্ব রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে হাইওয়েতে উঠারও উপায় নেই, তাই যাত্রাপথ এক ঘণ্টা বেড়ে গেছে।
.
মফস্বল পার হয়ে আরও কয়েক মাইল চালানোর পর এল কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যস্থল “লেইক অফ দা ওযার্কস স্টেট পার্ক”। এখানে কোনো প্রবেশ মূল্য নেই, নেই গাড়ি পার্কিং ফি। আমরা পার্কে ঢুকে নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি পার্ক করে নেমে পড়লাম। শাওন ভাইকে দেখলাম পার্কিং স্পট নিয়ে বেশ সাবধান। উল্টোপাল্টা জায়গায় পার্ক করলে গাড়ি উঠিয়ে নিয়ে যায়, জরিমানা দিতে হয়। আমি আর প্রিন্স সবই নতুন শিখছি। যে তথ্যই পাই, আশ্চর্য হই। পুরো পার্কে আমরা চারজন ছাড়া কেউ নেই। পার্কের অফিসও রবিবার উপলক্ষ্যে বন্ধ। উল্টোপাল্টা জায়গায় পার্ক করলে হয়ত কারো দেখার সম্ভাবনা নেই। তাও ভাই পার্কিং নিয়ে এত সাবধান। সাবধান কারণ বেশিরভাগ আমেরিকানই ‘বাই দা বুক’ চলে। এরা ক্যামেরা না থাকলেও স্পিড লিমিট মেনে চলে, পুলিশ না থাকলেও আইন মেনে চলে। তাই আমাদেরও এভাবেই নিয়ম মেনে চলতে হবে। যস্মিন দেশে যদাচার।মানুষের নিরাপত্তার ব্যাপারে এদের কাণ্ডজ্ঞান দেখে আশ্চর্য হলাম। হাইওয়েতে দেখেছি রাস্তার দুই ধারে খাঁজ কাটা, খাঁজ কাটা। এগুলোর উপর গাড়ির চাকা পড়লে বিচ্ছিরি “ভোঁ ভোঁ” শব্দ করে। কয়েকবার এমন হওয়ার পর জিজ্ঞেস করলাম, কাহিনী কী। আনজাম ভাই বললেন, এগুলো দেওয়া হয় যেন লেইন থেকে গাড়ি বের হয়ে না যায়, সেজন্য। এক প্রকার সতর্কবাণী। পার্কের ভেতর শিশুদের জন্য যে রাইডগুলো দেওয়া আছে, সে জায়গার মাটিতে গাছের নরম ছাল (shredded bark) বিছিয়ে রেখেছে যেন পড়ে গেলে ব্যথা না পায়।
.
পার্কিং স্পট থেকে কয়েক কদম এগুলেই ওযার্ক হ্রদ। হ্রদে নৌকা নিয়ে ঘুরা যায়। যে জেটি থেকে নৌকা ছাড়ে, সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা কিছুক্ষণ হাওয়া খেলাম, বিস্ময় নিয়ে চারিদিক দেখলাম, ছবি তুললাম। জেটিতে দাঁড়িয়ে সবাই কেমন যেন আনমনা হয়ে গেল। চারপাশে পাহাড়, মাঝে এই হ্রদ। এক আমলে এই অঞ্চলে আমেরিকান আদিবাসীদের বাস ছিল। তাদের প্রাণচাঞ্চল্যে মুখরিত হত ওযার্ক হ্রদ। আনজাম ভাই উদাস হয়ে বললেন, ‘এই হ্রদে হয়ত কোনো নেটিভ আমেরিকান এসে ঘোড়াকে পানি খাওয়াত! অথচ সেটলাররা কী করেছে জায়গাটাকে। দখলে নিয়ে জেটি বানিয়েছে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করেছে।’ নষ্ট করার পরও যা আছে, সেটা দেখে দম বন্ধ হওয়ার দশা। হয়ত আধুনিক জনগণ পার্কের ভেতর ক্যাম্প সাইট বানিয়েছে, বসার বেঞ্চি দিয়েছে, ছোট ছোট কেবিন বসিয়েছে, কিন্তু প্রকৃতির বিশালত্ব আটকাতে পারেনি। চারদিকে তাকিয়ে মনে হল, আমি এত ক্ষুদ্র কেন? জেটি থেকে নেমে আমরা গেলাম নৌকা ভাড়া করার অফিসে। কিন্তু আজ সবকিছু বন্ধ। সমস্যা নেই, নৌকায় করে না ঘুরেও হ্রদ আর পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। একটু পর দেখলাম আরেকটা ছেলে এসেছে। ভারতীয় হবে বোধহয়। একা একা ঘুরছে, ছবি তুলছে। বেশ খারাপ লাগল। একা একা ঘুরে বেড়ানো আমার ভাল লাগে না। অন্তত একজন সঙ্গী না হলে ঘুরা ঠিক জমে না। কার কাছে বিস্ময় প্রকাশ করব? কার সাথে ভাগ করব উচ্ছ্বাস?
.
পার্কের গাছপালা প্রকট শীতে নগ্ন হয়ে পড়েছে। চারদিকে শুধু ধূসর রঙ। আফসোস হচ্ছিলো, ফল সিজনে কেন আসিনি। এলে কী চমৎকার দৃশ্য দেখা যেত, কল্পনা করে গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেল। লাল, হলুদ, সবুজ আর কমলা রঙয়ে চারদিক ভরা থাকত। প্রকৃতি তার যৌবন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। অবশ্য বার্ধক্যেরও আলাদা সৌন্দর্য আছে। তাই শুকনো বনজঙ্গল দেখতেও ভাল লাগল।
.
দুপুর আড়াইটা বাজে। সূর্য মোটামুটি হেলে পড়ার দিকে। চিন্তা করলাম, এখানে পুরো সময় না কাটিয়ে আশেপাশের আরও কিছু দর্শনীয় স্থান দেখে যাই। আবার এখানে আসা হবে কিনা, কে জানে। স্বল্প সময়ের ভেতর যতখানি দেখে নেওয়া যায়। এরকম ঘুরে বেড়ানো আমাদের পছন্দ নয়। আমার আর প্রিন্সের পছন্দ ‘চ্যাগানো ঘুরা’। কোথাও যাব, চ্যাগিয়ে চ্যাগিয়ে উপভোগ করব, তাড়া থাকবে না ফেরার। কিন্তু এটা একদিনের ভ্রমণ, চ্যাগানো সম্ভব না। তাই বেশ কিছু স্পট দেখার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হল। পার্ক থেকে কাছে পিঠে আছে “স্টার্ক ক্যাভার্ন” নামের গুহা আর “হা হা টংকা” নামের আরেকটা স্টেট পার্ক। এই পার্কের ভেতর আছে ‘ক্যাসেল রুইন্স’ নামের ঐতিহাসিক দালান। হা হা টংকা নামটা আমার ভীষণ পছন্দ হল। শুনেই মনে হল, আদিবাসীদের ভাষা থেকে উদ্ভূত নাম। গুগল ঘেঁটে দেখলাম, অনুমান ঠিক। এই এলাকায় আগে চেরোকি, ওসেজ এবং অন্যান্য নেটিভ আমেরিকান গোষ্ঠীর বাস ছিল। ওসেজদের ভাষায় ‘হা হা টংকা’ মানে হল ‘জলের হাসি’। এখানে বেশ কিছু ঝর্না আছে যেগুলোর কারণে জায়গাটার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘হা হা টংকা’। আমরা ওযার্কস স্টেট পার্ক থেকে বের হয়ে এগুলাম স্টার্ক ক্যাভার্নের দিকে। ভেবেছিলাম এটাও সরকারী সম্পত্তি, প্রবেশমূল্য নেই। কিন্তু যাওয়ার পথে জায়গায় জায়গায় বিলবোর্ড দেখে আনজাম ভাই সন্দেহ করলেন, এটা ব্যক্তি মালিকানাধীন। গিয়ে দেখলাম, সত্যি। গুহায় প্রবেশমূল্য প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ১৮ ডলার। চার বছর বয়স পর্যন্ত অবশ্য ফ্রি! আমাদের কোনোভাবে চার বছরের রেঞ্জে ঢুকানো যায় কিনা, ভাবতে ভাবতে সবাই ফিরে এলাম গাড়িতে। চললাম হা হা টংকার দিকে।
.
ওযার্কস পার্ক থেকে বের হওয়ার পর রাস্তাগুলো খুব বেশি খাড়া হয়ে গেল। আগে তাও রাস্তার দু’ধারে তৃণভূমি বা সমতল ভূমি ছিল। কিন্তু এখনকার রাস্তার ধারে খাড়া করে পাহাড় কাটা। পড়লে মরণ ছাড়া গতি নেই। কে যেন বলল, নিড ফর স্পিডের বাস্তব ভার্সন খেলা হচ্ছে। তবে ভার্চুয়াল খেলায় একটা সুবিধা ছিল – লাইফ পাওয়া যেত। হা হা টংকায় পৌঁছে গাড়ি পার্ক করে দেখলাম পায়ে হাঁটা পথ চলে গেছে বনের ভিতর দিয়ে। তীর চিহ্ন দিয়ে দেখানো হচ্ছে, এই পথ ধরে এগুলে ক্যাসেল রুইন্স বা দালানের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যাবে। চার পর্যটক হাঁটা শুরু করলাম। গাড়ির ভেতরে ছিলাম বলে উঁচুনিচু রাস্তা অতটা টের পাইনি, হাঁটতে গিয়ে টের পেলাম। মিনিট দশেক হাঁটার পর হাতের বাম পাশে দেখলাম ছোট্ট একটা দালানের ধ্বংসস্তূপ। চরম হতাশ হলাম। এই জিনিস দেখার জন্য এত কষ্ট করেছি? হঠাৎ আনজাম ভাই চেঁচিয়ে উঠলেন, “হাতের ডানদিকে আসল দালান!” বামদিকে দাঁড়িয়ে আছে আঠার’শ শতাব্দীর ডাকঘর, আর ডানদিকের পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়ানো উনিশ’শ শতাব্দীর এক দুর্গ। এটাই ক্যাসেল রুইন্স।
.
ডাকঘরের দিকে তাকিয়ে সুদূর অতীতে চলে গেলাম। আজ থেকে দুইশ বছর আগে এই গহীন জঙ্গলে কে চিঠি পাঠাত? কাকে পাঠাত? নিশ্চয় মাত্র একটা দুর্গের বাসিন্দাদের জন্য ডাকঘর বানানো হয়নি! নিশ্চয় আরও সেটলার বাস করত এখানে। কিন্তু সেসবের চিহ্ন নেই এখন। এখন শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। ডাকঘর থেকে দুর্গ পর্যন্ত উঠার পথে বেশ কিছু অব্জারভেশন ডেক চোখে পড়ল। এসব ডেকে দাঁড়িয়ে হা হা টংকার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। আমরা ডেকে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এত অপার্থিব সৌন্দর্য! এত নীরব, শান্ত, বিশাল আর চোখ ধাঁধানো প্রকৃতি! শাওন ভাই বারবার বলতে লাগলেন, ‘মইরা যাইতে ইচ্ছা করতেছে। এই দৃশ্য দেখার পর মানুষ বাঁইচা থাকে কেম্নে?’ এক অর্থে সত্যি। এরকম দৃশ্য দেখলে বুকের ভিতর হাহাকার তৈরি হয়। যেন সবটুকু দিয়েও এই সৌন্দর্য আমি নিজের ভেতর ধারণ করতে পারছি না, উপভোগ করতে পারছি না, দেখে তৃপ্তি আসছে না। বিস্ময়কর এক অনুভূতি।
.
ডেকের ঠিক নিচেই খাড়া পাহাড় নেমে গেছে। সেই পাহাড়ের গাছপালার ভেতর দশ বারোটা চিল অথবা ঈগল বাসা বেঁধেছে। তারা হ্রদের উপর টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে, আর একটু পরপর এসে বাসা দেখে যাচ্ছে। বাসায় ছানাপোনা আছে কিনা, কে জানে! নাকি বিশ্রাম নেওয়ার জন্য আসছে? ওদের দেখতে দেখতেও উদাস হয়ে গেলাম। সবসময় বিবিসির ডকুমেন্টারি অথবা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে এসব দৃশ্য দেখেছি। আজ স্বচক্ষে দেখে হারিয়ে গেলাম। পাহাড়ের নিচে যে হ্রদ আছে, সেটার চারপাশে ট্রেইল আছে। কিন্তু হাতে সময় নেই বলে ট্রেইল ধরে হাঁটতে পারলাম না। এমনকি যেসব ঝর্নার কারণে নাম হা হা টংকা হয়েছে, সেসব ঝর্না দেখারও সময় পেলাম না। যে উঁচুনিচু রাস্তা, সূর্যের আলো থাকতে থাকতে রওনা দিতে হবে। নতুবা দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা অনেক বেশি। দ্রুত ক্যাসেল রুইন্স দেখে আমরা রওনা দিলাম গাড়ির দিকে। বনের ভিতর দিয়ে হাঁটার সময় রোমাঞ্চ হচ্ছিলো খুব। এই পথ ধরে হয়ত কোনো একসময় আমেরিকান কোনো আদিবাসী শিকারি হেঁটে বেড়িয়েছে, শিকার ধরেছে। প্রতি পদে এখানে অতীতের হাতছানি।
.
গাড়িতে উঠে প্রথম কথাই হল, খিদে পেয়েছে। দ্রুত কোনো রেস্তোরাঁয় খুঁটি গাঁড়তে হবে। আনজাম ভাই রেস্তোরাঁ খুঁজতে ওস্তাদ। তিনি সস্তা দেখে একটা চৈনিক বুফে রেস্তোরাঁ বের করলেন। পার্ক থেকে বেরিয়ে এক ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে এলাম সেখানে। ঘড়িতে তখন ছয়টা বাজে। বুফের মূল্য এগারো ডলার, ট্যাক্স-সহ তের। আমরা হামলে পড়লাম খাবারের উপর। শাওন ভাই সব খাবার এক পিস করে নিয়ে এলেন। এর মধ্যে অনেক খাবারই চেখে দেখলেন না। আমিও মেইন ডিশগুলো থেকে এক পিস করে নিয়ে এলাম। এনে আর খেতে পারি না। চোখের ক্ষুধা দিয়ে পেটের ক্ষুধা বিচার করেছি, ফল তো ভোগ করতেই হবে। তবে Clam (ভেনাস ঝিনুক) আর Mussel দেখে খুশি হলাম। ইতালিতে গিয়ে এসব জিনিস খাওয়া শিখেছি। আজ চীনাদের রান্না খেয়ে দেখি!
.
ধীরে সুস্থে খাওয়া শেষ করলাম। বিল মিটিয়ে বের হয়ে এলাম। সেন্ট লুইসের দিকে আসতে আসতে আকাশে উঠল এক বিশাল চাঁদ। আজকের সবকিছুই বিশালত্ব দিয়ে ঘেরা। পূর্ণিমা নাকি? ঝলসানো রুটির মত চাঁদটাকে হয়ত খেতে ইচ্ছে করত পেট খালি থাকলে! কিন্তু ভুঁড়িভোজ শেষে এখন শুধু সৌন্দর্য অবলোকনের পালা। শহর থেকে অনেক দূরে আছি বলে তেমন আলোক দূষণ নেই। গাড়ির হেডলাইটের আলো বাদ দিলে চারদিক বেশ অন্ধকার। তাই আকাশ ভর্তি নক্ষত্র দেখা গেল। চাঁদের কারণে যদিও নক্ষত্রগুলো ফুটে উঠতে পারছে না, কিন্তু যা দেখলাম সেটাই অনেক। এমন নক্ষত্র আরেকবার দেখেছিলাম শ্রীনগর গ্রামে গিয়ে। আবারও অতীতে ফিরে গেলাম। হাজার বছর আগে নিশ্চয় আমাদের পূর্বসূরিরা রাতের আকাশের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকত! নিশ্চয় ভাবত, ওগুলো কী? অপার বিস্ময় নিয়ে দেখত এই সৌন্দর্য। হাজার বছর পর আমি জানি, ওগুলো কী। তাও পূর্বসূরির মতই বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকি, হাঁ করে দেখেও তৃপ্তি মেটে না…
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post প্রথম গাড়ি কেনা আর চাউ মাই টায়ের গল্প
Next post সিলেট ভ্রমণ (মাধবপুর লেক, বিছনাকান্দি, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান)