Read Time16 Minute, 23 Second
অনেকদিন ধরে পরিবার আর জ্ঞাতিগোষ্ঠী মিলে দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হচ্ছিলো না। তাই ঠিক করলাম, রোজার ঈদের ছুটিতে এমন কোনো জায়গায় যাবো, যেখানে বেশিরভাগ সদস্যেরই কখনও যাওয়া হয়নি। সেই মতো জায়গা ঠিক করা হলো শ্রীমঙ্গলের মাধবপুর লেক, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, আর হামহাম ঝর্না (পরে এই ঝর্না ভ্রমণ বাতিল হয়ে বিছনাকান্দি যোগ হয়েছিলো)। তবে নির্দিষ্ট করে চা-বাগানকে ভ্রমণের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, কারণ পুরো শ্রীমঙ্গল জুড়েই চা বাগানের ছড়াছড়ি। যাওয়া আসার পথে প্রচুর চোখে পড়বে। পরিকল্পনা অনুযায়ী পহেলা জুলাই ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে দুটো ভাড়া করা মাইক্রোবাসে চড়ে বসলাম আমরা ১৬ জন সদস্য। তাড়াহুড়ার জন্য সকালের নাস্তা করার সুযোগ হবে না বলে নুডুলস বানিয়ে নেওয়া হয়েছিলো। তিনশো ফিটের রাস্তা ধরে ঢাকা থেকে বেরিয়ে, ঘণ্টা দুয়েক যাওয়ার পর আমরা পৌঁছলাম নরসিংদীতে। সেখানে একটা ছায়াঘেরা গ্রামে গাড়ি থামিয়ে পাটি বিছিয়ে বসে পড়লাম নাস্তা খেতে। “আধা” বনভোজন ধরনের অবস্থা। কারণ জায়গায় গিয়ে রান্না না করে আমরা আগে থেকেই তৈরি খাবার নিয়ে গিয়েছি।
.
খাওয়া সেরে আবার উঠে বসলাম গাড়িতে। এবার একটানে “চা-কন্যার দেশে”, মানে সিলেট বিভাগে অবস্থিত মৌলভীবাজার জেলার অভ্যন্তরে শ্রীমঙ্গল উপজেলায়। এখানে প্রবেশ করার সময় বেশ বড়সড় একটা ভাস্কর্য আপনাকে স্বাগতম জানাবে। এই ভাস্কর্যের নাম “চা-কন্যা”। এমন সংবর্ধনা পেয়ে সেখানে কিছু ছবি তোলার লোভ সামলানো গেলো না। সেই সাথে জীবনের প্রথম চা বাগানও দেখলাম। প্রথম দফায় চা বাগানকে তেমন আহামরি কিছু মনে হলো না। ছোট ছোট গাছ, উঁচুনিচু টিলার গা বেয়ে সারির পর সারি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ধীরে ধীরে পুরো ব্যাপারটার সৌন্দর্য আমার চোখে ধরা পড়তে লাগলো। আর চলে আসার দিন আমি চা বাগানের সর্বোচ্চ সৌন্দর্যটা উপভোগ করতে পেরেছি। কীভাবে, সে বয়ানে পরে আসছি। ছবি তোলা শেষে রওনা দিলাম শ্রীমঙ্গল শহরের দিকে। যতই শ্রীমঙ্গলের দিকে যাচ্ছি, ততই আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখতে পাচ্ছি। শ্রীমঙ্গলে নেমে আগে থেকে বুক করে রাখা হোটেলে মালপত্র রেখে, দুপুরের খাওয়া সেরে, খানিক বিশ্রাম নিয়ে তিনটার মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম মাধবপুর লেকের উদ্দেশ্যে। কারণ বিকেল চারটায় এই লেকে নাকি জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
.
লেকের কাছে পৌঁছানোর আয়োজন বিশাল! প্রথমেই একটা গেট পড়লো, যেখানে আমাদের মাইক্রোবাস রেখে তারপর ঢুকতে হলো ভিতরে। ঢুকার পর বেশ সুন্দর একটা পরিকল্পিত উদ্যান পেলাম। দু’পাশে গাছপালা, মাঝ দিয়ে চলে গেছে পাকা রাস্তা। এই রাস্তারই শেষ মাথায় কয়েক ধাপের সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলে চোখে পড়বে আয়নার মতো স্বচ্ছ আর টলটলে জলের লেক! সেই লেক ছেয়ে আছে বেগুনি রঙের শাপলায়। লেকের চারপাশে ছোট বড় অনেক টিলা, আর টিলা মানেই চা গাছ। খাবলা খাবলা হোক, আর সুন্দরভাবে গোছানো চা-বাগানই হোক, টিলামাত্রই চা গাছ দেখেছি। আর এবার চা-গাছ দেখে বেশ মুগ্ধ হলাম। টিলার উপরে উঠে যে পাশেই তাকাই, উঁচুনিচু ঢালু জমিতে শুধু সবুজ চা-বাগান। কলাপাতা রঙের কচি পাতা, কিংবা গাঢ় সবুজ পাতা – সবগুলোই চোখ-মনের জন্য শান্তিদায়ক। টিলার একপাশ দিয়ে সিঁড়ি চলে গেছে উপরে উঠার জন্য। সে সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম। আহ! বড় শ্রমসাধ্য কাজ… (মোটেই না। একদম কষ্ট হয়নি)। তাই নামার সময় বেছে নিলাম এবড়ো খেবড়ো পাহাড়ি রাস্তা। সবই যদি অনায়াসে হয়ে যায়, তবে আর পাহাড়ি অঞ্চলের মজা কী? বেশ আয়াস করেই নামলাম সমতল ভূমিতে। তারপর লেকের বেশ খানিকটা অংশ চক্কর মেরে শেষ করলাম আমাদের মাধবপুর লেক ভ্রমণ। তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হবে হবে করছে। একটা কথা না বললেই নয়। সারাদিন ধরে শ্রীমঙ্গলের আকাশ দেখে আমি মুগ্ধ! ক্ষণে ক্ষণে রোদ বৃষ্টির খেলা। সাধে কি আর বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃষ্টি প্রবণ এলাকা? এরপর আমাদের গন্তব্য বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত। সীমান্তের কাছাকাছি বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের স্মৃতিস্তম্ভ দেখা হল। আরও দেখলাম কাঁটাতারের বেড়া, যেটা দিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে দুই দেশের সীমান্ত। সীমান্ত দেখা শেষে যখন ফিরে আসছি শ্রীমঙ্গল শহরে, তখন গ্র্যান্ড সুলতান রিসোর্টের ঠিক বিপরীত পাশে অবস্থিত “রংধনু সাতরং রেস্টুরেন্ট”-এ গিয়ে সাত স্তরের চা পানের খায়েশ হলো। রেস্তোরাঁয় বসার পর দেখি শুধু সাত স্তর নয়, দশ স্তরেরও চা বিক্রি করেন উনারা। ফলে দুই ধরনের চায়েরই অর্ডার পড়লো। অবাক চা-পান শেষে ফেরা হল নীরে (মানে শ্রীমঙ্গল শহরের হোটেলে)।
.
পরের দিন, অর্থাৎ ২ জুলাই আমাদের যাওয়ার কথা ছিলো হামহাম ঝর্নায়। কিন্তু এলাকাবাসীদের কাছ থেকে শুনলাম, বৃষ্টি পড়ে পাহাড়ি রাস্তার অবস্থা নাকি খুব খারাপ হয়ে আছে! আবার আমাদের দলে যেহেতু সব বয়সী ভ্রমণকারী আছেন, তাই সকলের কথা চিন্তা করে “হামহাম ফল্স” বাতিল করা হলো। সেখানে যোগ হলো “বিছনাকান্দি”। জায়গাটা শ্রীমঙ্গল থেকে বেশ দূরে অবস্থিত। সিলেট শহর পার হয়ে, গোয়াইনঘাট উপজেলায় গিয়ে, হাঁদারপাড় ঘাট থেকে ট্রলার নিয়ে, পিয়াইন নদীর বুক চিড়ে তারপর পৌঁছতে হয়। তবে কিনা, কিছু পেতে হলে কিছু দেওয়া আবশ্যক। বিছনাকান্দির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে আপনাকে খারাপ রাস্তার কষ্ট সহ্য করতেই হবে। রাস্তা যে এক আমলে পাকাপোক্ত ছিলো, বুঝা যায়। কিন্তু পাথরবাহী ট্রাক চলাচলের কারণে জায়গায় জায়গায় ভেঙে গেছে। এজন্য যদি কেউ মাইক্রোবাস বা প্রাইভেট কার নিয়ে যান, একটু সমস্যায় পড়তে পারেন। তবে বিছানাকান্দি যাওয়ার জন্য লোকাল সিএনজি ভাড়া করতে পারেন, যেগুলো ভালো সেবা দিয়ে থাকে। যাওয়ার পথে সবারই ঝাঁকি খেতে খেতে ছোট বাথরুম চেপে গিয়েছিল। এক বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম সাহায্যের আশায়। বাড়ির লোকজন নিরাশ করলেন না। তবে টয়লেটের নকশা আমাদের থেকে আলাদা। বসতে আর কাজ সারতে একটু বেগই পেতে হল।
.
নদীর নাম “পিয়াইন”। “হাঁদার পাড়” ঘাটে নেমে, ট্রলারে চড়ে পিয়াইন নদীর বুক চিড়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। যাচ্ছি বিছনাকান্দির দিকে। ট্রলারে উঠার পর থেকেই পরিবেশের সৌন্দর্য দেখে মাথা নষ্ট হয়ে যেতে লাগলো। বেশ কিছু দূরে সবুজ পাহাড়, তারচেয়ে আরেকটু দূরে নীল পাহাড়, তারচেয়েও দূরে ধূসর পাহাড়। দূরত্বের উপর নির্ভর করে আমাদের চোখে পাহাড়ের রঙও পাল্টে যাচ্ছে। সেই সাথে নদীর দুই পাড়ে সবুজ ঘাস কিংবা বড় বড় গাছ অথবা নিস্তব্ধ গ্রাম দেখে অদ্ভুত একটা শান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে, শহরের কোলাহল থেকে একদণ্ডে চলে এসেছি স্বর্গে। পিয়াইন নদীর দুইপাশে অপূর্ব সবুজ প্রকৃতি! বিছনাকান্দি দেখার আগেই আপনি মুগ্ধতায় মরে যাবেন এইসব সৌন্দর্য দেখতে দেখতে। বিশ/পঁচিশ মিনিট পর আমরা আগের সৌন্দর্যগুলোকে পেছনে ফেলে যে অপ্রাকৃত জায়গাটিতে এলাম, সেটাই বিছনাকান্দি। ট্রলার ভিড়াচ্ছে পিয়াইন নদীর পাড়ে। সারা আকাশ তখন মেঘে মেঘাচ্ছন্ন। তীরে নামার আগেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, “ওয়াও!” আর নামার পর বিশ্বাসই হতে চাইলো না, আমি এই ভূস্বর্গে দাঁড়িয়ে আছি! কিছুক্ষণ বোকার মতো স্থাণু হয়ে থেকে তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম নদীর বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট-বড় পাথরখণ্ডের দিকে। পুরো নদী জুড়েই অসংখ্য পাথর বিছানো। নদীর একপাশ থেকে যন্ত্র দিয়ে পাথর উঠানো হচ্ছে, আরেক পাশ যান্ত্রিক কলুষতা থেকে মুক্ত হয়ে পর্যটকদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আশা করি, পুরো নদীকেই মানুষ পাথর উত্তোলনের উৎস বানিয়ে ফেলবে না। যদি ফেলে, তাহলে আমরা হারাবো একটা অপরূপ ঐন্দ্রজালিক পর্যটন কেন্দ্র। ব্লগের ছবিটাও বিছনাকান্দির। সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ছবি তোলার কথা তেমন মনে ছিল না। যখন মনে পড়ল, চট করে তুলে ফেললাম অসাধারণ দৃশ্যটি।
.
নদীর ঠাণ্ডা পানিতে পা রাখার কিছুক্ষণ পরই আকাশ কালো করে দুদ্দাড় বৃষ্টি নামলো। একে তো পাহাড়ি ঝর্না থেকে সৃষ্টি হওয়া নদী এই “পিয়াইন”, তার উপর বৃষ্টি নেমে পুরো নদীকে করে দিলো উন্মাতাল। সে এক দেখার মতো দৃশ্য বটে! আমরা বাদে দর্শনার্থী ছিলো আর মাত্র জনা পনেরো। তাই পুরোদমে হই হুল্লোড় করে, বৃষ্টিতে ভিজে, বিছনাকান্দির সৌন্দর্য উপভোগ করতে সুবিধাই হলো। বেশি মানুষ থাকলে মন ভরে কিছু দেখার সুযোগ পাওয়া যায় না। আবার বৃষ্টির পর দেখা গেলো আরেক দৃশ্য। বিভিন্ন পাহাড়ের মাঝে মাঝে মেঘ আটকা পড়ে গেলো। সবুজ পাহাড়ের মাঝে সাদা মেঘ বন্দী হয়ে সৃষ্টি করলো অলৌকিক সৌন্দর্য। সাথে পাহাড়ের চূড়ায় কুয়াশার রহস্যময় চাদর তো আছেই! চোখে না দেখলে ব্যাপারটা অনুভব করা সম্ভব নয়। বৃষ্টি যেমন আমাদেরকে চরম একটা পরিবেশ দিলো উপভোগ করার, তেমনি যাওয়ার পথের জন্য একরাশ চিন্তাও এনে দিলো। একে তো পথ ভাঙাচুরা, তার উপর বর্ষণের ফলে রাস্তায় পানি জমে সেটা যাতায়াতের জন্য কয়েক ডিগ্রি অনুপযুক্ত হয়ে গেলো কিনা, কে জানে! তাই বেশিক্ষণ থাকা হলো না বিছনাকান্দিতে, আশ মিটিয়ে ভেজা হলো না কুলকুল শব্দে বয়ে চলা পিয়াইনের জলে। উঠে এলাম ট্রলারে। তবে আশ্চর্য এক অনুভূতি হল বৃষ্টির মাঝে নদীতে স্নান করে। মনে হল যেন শুদ্ধ হলাম। মানুষের জিনে যে প্রকৃতির কাছাকাছি যাওয়ার ব্যাকুল আগ্রহ, সেটা আরেকবার টের পেলাম।
.
পরের দিন, অর্থাৎ ৩ জুলাই গেলাম লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। সেখানে পায়ে হাঁটার রাস্তা ঠিক করে দেওয়া আছে, আছে মানচিত্র। আপনি সেই ট্রেইল ধরে হেঁটে গেলে না হারিয়েই ঘুরে আসতে পারবেন উদ্যানটা। আমরা ভেবেছিলাম, বেশ কিছু বন্য প্রাণী দেখতে পারবো। কিন্তু আমাদের হতাশ করে পাখি আর পশুগুলো শুধু ডেকেই গেলো, দেখা আর দিলো না। তবে ডাক অনুসরণ করে করে বেশ গভীর বনে গিয়ে আমরা উল্লুকের নিতম্ব দেখেছি! মানে আমি শুধু নিতম্ব দেখেছি, অন্যরা নাকি চেহারাও দেখেছে। আরেকটা মজার জিনিস জানলাম। সেগুন গাছের পাতা ঘষে নাকি গাঢ় মেরুন রঙ তৈরি করা যায়। হাতের তেলোয় ঘষে হাতেনাতে প্রমাণও পেলাম। এছাড়া লাউয়াছড়ার বিখ্যাত ট্রেন লাইনে পোজ মেরে কিছু ছবিও তোলা হল। এখন ফেরার পালা। তবে ফেরার আগে আবারও চা বাগান দর্শন করে ফেরার পরিকল্পনা হলো। শ্রীমঙ্গল ভ্রমণ শুরুও হয়েছিলো চা বাগান দিয়ে, শেষও হোক চা বাগান দিয়েই। তাই গ্র্যান্ড সুলতান রিসোর্টের পাশ দিয়ে বয়ে চলা আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে আমরা ভাইবোনেরা হাঁটা শুরু করলাম। কিছুদূর গিয়ে চোখে পড়লো বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত চা বাগান। এবার আমার চোখ উপলব্ধি করতে পারলো চা-বাগানের আসল সৌন্দর্য। বড় বড় টিলা আর উঁচুনিচু জমিতে জন্মে থাকা সবুজ শ্যামল চা গাছ, ফাঁকে ফাঁকে ছায়াদানকারী গাছ, উপরে তুলোর মতো সাদা মেঘযুক্ত নীলাকাশ, আর চা-পাতা তুলতে থাকা শ্রমিক মিলে ছবির মতো দৃশ্য। নীরব নিস্তব্ধ পাহাড়ি পথের পাশে এই দৃশ্য দেখে মনে হয় না, পৃথিবীতে আছি। কিন্তু সুখের দিন শেষ হয় দ্রুত, অন্তত আপেক্ষিকতা তাই বলে। ফলে একটু পরই এসব সৌন্দর্যকে পেছনে ফেলে ছুটে আসতে হলো ইট পাথরের ঢাকা শহরে। সম্পন্ন হলো অতি আকাঙ্ক্ষিত সিলেট ভ্রমণ, যা হয়ে থাকবে আমার জীবনের স্মরণীয় কিছু মুহূর্তের সাক্ষী।