হিসেব করে দেখলাম, এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের এগারোটা অঙ্গরাজ্যে ভ্রমণ করেছি। পঞ্চাশটার মধ্যে এগারোটা। তিন বছরের আমেরিকান জীবনে সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। ভ্রমণ বলতে বুঝাচ্ছি একটা স্টেটের নির্দিষ্ট এলাকায় গিয়ে ঘোরাঘুরি করা। অঙ্গরাজ্যের এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরতে গেলে ঝোলায় হয়ত তিন বছরে তিনটা অঙ্গরাজ্য থাকত। এগারোটার মধ্যে তিনটেতে (মিজৌরি, পেন্সিলভেনিয়া, আর টেক্সাস) থাকা হয়েছে বা হচ্ছে, বাকিগুলোতে গিয়েছি ঘুরতে। ওহাইও, নেভাদা, নিউইয়র্ক, ইলিনয়, মেরিল্যান্ড, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ভার্জিনিয়া, আর অ্যারিজোনা। এভাবে চলতে থাকলে আগামী বারো বছরে বাকি ঊনচল্লিশ স্টেট ঘুরে ফেলার কথা। দেখি, খায়েশের কতখানি পূরণ করতে পারি। তবে শুধু স্টেট না, আমার ইচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সবগুলো জাতীয় উদ্যানও ঘুরে দেখা। ৬৩টা জাতীয় উদ্যান আছে এখানে। এর মধ্যে ঘুরেছি মাত্র তিনটা। ভার্জিনিয়ার শিনান্ডোয়া, মিজৌরির গেটওয়ে আর্চ, অ্যারিজোনার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। ভাবলে আফসোস হয়, দশ মাস পেন্সিল্ভেনিয়ায় থেকেও পাশের স্টেট ওহাইওর একমাত্র ন্যাশনাল পার্ক কায়াহোগা উপত্যকা দেখে আসিনি। বা ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার নিউ রিভার গর্জ। তবে মন খারাপ কোনো সমাধান নয়। আপনার দুঃখকে শক্তিতে রূপান্তরিত করুন। আমিও তাই পরিকল্পনা করছি টেক্সাসে থাকতে থাকতে ইউটাহ আর ওয়াইওমিংয়ের পার্কগুলো ঘুরে ফেলার। সাথে টেক্সাসের দুটো জাতীয় উদ্যান তো আছেই। সমস্যা হল, ছোট বোন স্বর্ণা কিছুদিন আগে নরওয়ে গেছে মাস্টার্স করতে। ওখানকার যেসব ছবি ও আপলোড দেয়, সেগুলো দেখে আমার মাথার তার ছিঁড়ে যায়। এমনিতেই গোটা ইউরোপের প্রতি আমার তীব্র ফ্যাসিনেশন। নর্ডিক পুরাণ পড়তে পড়তে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চল, ড্যান ব্রাউনের বদৌলতে ইতালি আর রোম, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ দিয়ে প্রিয় মারগারিতের ফরাসী দেশ। সবকিছুতেই আমার তুমুল আগ্রহ। তাই হঠাৎ হঠাৎ বিগার উঠে যুক্তরাষ্ট্র বাদ দিয়ে ইউরোপ ভ্রমণে যাওয়ার। নরওয়ের অতীব সুন্দর ফিওর্ডের কিনারে বসে জীবন যৌবন নিরর্থক ভাবার। ভাবছেন আমি মাতাল? এই নিন ফিওর্ডের নমুনা। আপনিও মাতাল হউন হে পাঠক!

২০১৮ সালে আমরা যুক্তরাষ্ট্রে আসার অনুমতি পেয়েছিলাম। এখনও ভিসা ইন্টার্ভিউ মোকাবেলার দম আটকানো স্মৃতির প্রতিটা মুহূর্ত অনুভব করতে পারি। ভিসা পাওয়ার পর হু হু করে কেঁদে দিয়েছিলাম। আহা, সেই নির্ঝরের জন্য আমার অনেক মায়া। পাঁচ বছরের চেষ্টা শেষে যখন বেচারার যুক্তরাষ্ট্রে আসার ব্যাপারটা সত্যি হয়ে গেল, তখন সে ঘোরের মধ্যে চলে গেল। আসলেই সে যেতে পারবে যুক্তরাষ্ট্রে? পাশে প্রিন্স না থাকলে হয়ত বিশ্বাসই হত না ওর। প্রিন্স আশ্বাস দিল, ‘হ্যাঁ, আমরা আম্রিকা যাচ্ছি!’ মিজৌরির সেন্ট লুইস শহরে ছিল আমাদের আমেরিকান জীবনের শুরু। বাংলাদেশ থেকে সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলাম মাস্টার্স করতে। শাওন ভাই আমাদের বিমানবন্দর থেকে উনাদের বাসায় নিয়ে এসেছিলেন। উবারে করে আসার পথে বারবার মিলাতে চাচ্ছিলাম সিনেমায় দেখা আমেরিকার সাথে চর্মচক্ষে দেখা আমেরিকাকে। কোথায় সেই উঁচু উঁচু দালান, রংচঙা শপিংমল, ছোট ছোট পোশাক পরা ছেলেমেয়ে? কী এক ফালতু জায়গায় এসে পড়লাম যেখানে বেশীরভাগই দালানকোটাহীন সমতলভূমি? শাওন ভাই হাসতে হাসতে বললেন, ‘এটাই মূল আমেরিকা। আপনি যেগুলোর কথা বলছেন, সেগুলো শুধু বড় শহরে পাবেন।’ শুনে হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল। তবে পরদিন সকালবেলা হাঁটতে বের হয়ে আমেরিকার রাস্তাঘাট দেখে কি উত্তেজনা আমাদের! কী পরিষ্কার, ঝকঝকে! প্রতিটা বাসার সামনে দুই ধরনের ডাস্টবিন। এরা বলে ট্র্যাশক্যান। একটা পচনশীল জিনিসপাতির জন্য, আরেকটা অপচশীলের। ফুটপাথে আমি আর প্রিন্স ছাড়া কেউ নেই। সবাই গাড়ি হাঁকিয়ে রাজপথ দিয়ে যাওয়া আসা করছে। একটু পর একজন কৃষ্ণাঙ্গ বুড়োকে দেখলাম ফুটপাথ ধরে হাঁটছেন। আমাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মাথা ঝাঁকিয়ে ‘হ্যালো’ বললেন। আমরা থতমত খেলেও পাল্টা হ্যালো বলতে ভুললাম না। প্রথম কালচারাল শক। পরে টের পেলাম রাস্তাঘাটে হাই হ্যালো বলা এদের সংস্কৃতি। একদম অচেনা মানুষকেও হাই হ্যালো বলতে এদের দ্বিধা নেই। কিছু না বলুক, অন্তত একটা হাসি দেবে। একদম গাড়ল না হলে কেউ চোখাচোখির পর হাসি না দিয়ে যায় না। খুব সুন্দর!
সেন্ট লুইসের সীমান্ত ঘেঁষে বয়ে চলেছে মিসিসিপি নদী। সমাজ বইয়ে পড়া বিখ্যাত মিসিসিপি-মিজৌরি নদীর একাংশ। সে নদী পার হলেই ইলিনয়। কোনো এক শীতের দুপুরে সেন্ট লুইস থেকে ট্রেন ধরে আমরা চলে গিয়েছিলাম ইলিনয়ের এক গ্রামে। ওটাই ছিল আমাদের প্রথম মিজৌরির বাইরে বের হওয়া। এখনও মনে পড়ে ইলিনয়ের ট্রেন স্টেশনে নেমে সে কি খুশি আমরা! চারপাশে হু হু শূন্যতা, মরা গাছপালা, আর একটা দুটো দালান। তাতেই আমাদের বিশ্বজয়ের অনুভূতি। এসেছি নতুন একটা অঙ্গরাজ্যে। কম কথা? এরপর একটু টাকাপয়সা জমিয়ে উড়াল মেরেছিলাম নেভাদার লাস ভেগাসে। পাপের শহর বলে পরিচিত ভেগাসে গিয়ে কোনো পাপ করতে না পারার রেকর্ড আছে আমাদের। না খেলেছি জুয়া, না গিয়েছি নাইটক্লাবে, না পান করেছি মদ, না সেবন করেছি গঞ্জিকা। জুয়াতে বিগিনারস লাক বলে একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু সেটা পরীক্ষা করার সাহস পাইনি। হোয়াট হ্যাপেন্স ইন ভেগাস, স্টেইস ইন ভেগাস জানার পরও কোনোপ্রকার দুষ্টুমি করতে মন চায়নি। দুষ্টুমির জন্য সাথে পুংটা বন্ধুবান্ধব থাকা লাগে। আমরা গিয়েছি দুই সাধু সন্ত, দা স্ট্রিপ আর ফ্রেমন্ট স্ট্রিটে হেঁটেই যারা খুশি। আরেকবার যদি যাওয়া হয়, দলবল নিয়ে যাব। ‘ভেগাস, ভেইবে!’ চিক্কুরের সাথে দুনিয়াবি মাস্তি সেরে আসব।
এরপর এল চাকরিজীবন। চলে গেলাম পেন্সিল্ভেনিয়া। চাকরিটা পছন্দ ছিল না আমার। কিন্তু যেখানে থাকতাম, সেই গ্রামটা এখনও পর্যন্ত আমাদের সবচেয়ে পছন্দের বাসস্থান। পাহাড়ের উপর ছিল বাসা। চারদিকে তাকালে শুধু সবুজ আর সবুজ। শীতকালে যখন বরফ পড়ত, গাড়ি চালানোটা একটু কষ্ট হয়ে যেত। কিন্তু বরফ দিয়ে যখন পাহাড়গুলো ঢেকে যেত, সাদা ধবধবে হয়ে উইন্টার ওয়ান্ডারল্যান্ড তৈরি করত, ঐ দৃশ্য দেখে সব কষ্ট ভুলে যেতাম। একবার দশ ইঞ্চি বরফ পড়ল বাটলারে। আমাদের গাড়ি থাকত খোলা পারকিং লটে। গিয়ে দেখি গাড়ি ডেবে গেছে বরফের নিচে। তাও বেলচা দিয়ে বরফ সরিয়ে গাড়ি বের করা যেত। কিন্তু পুরো লটই তো দশ ইঞ্চি বরফের নিচে! এত বড় লট কি আর আমরা পরিষ্কার করব? তাই কল দিলাম লিন্ডাকে। বুড়ি ছিল আমার বস। সে অফিসে যাওয়ার পথে আমাকে তুলে নিল। বলল, ভোর পাঁচটায় উঠে নাকি তাকে গ্যারাজের সামনে থেকে বরফ পরিষ্কার করতে হয়েছে গাড়ি বের করার জন্য! এই এক হাঙ্গামা শীতবহুল স্টেটে থাকার। তাই আমাদের পরবর্তী গন্তব্য যখন টেক্সাস হল, নতুন রোমাঞ্চের আশায় বুক বাঁধলাম। গরম প্রধান এই অঙ্গরাজ্যে থেকে দেখি কেমন লাগে। আমেরিকা জীবন শুরু হয়েছিল মিডওয়েস্ট অঞ্চলে, মাঝামাঝি ধরনের আবহাওয়া দিয়ে। মাঝখানে থাকলাম নর্থইস্টার্ন অঞ্চলের চরম ঠাণ্ডায়। বর্তমানে আছি সাউথের চরম গরমে। দেখি, ভবিষ্যতে কোথায় যাই। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল খুঁজে বের করতে হবে। নতুবা মনের দুঃখে ইউরোপ চলে যাব। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মাছ ধরব, ওয়াইন খাব আর সমুদ্র স্নান করব। মজাই মজা!