1 0
Read Time12 Minute, 59 Second

প্রথম পর্বদ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব

রাতে আড্ডা মারতে মারতে কখন যে রাত বারোটা বেজে গেছে, খেয়াল করিনি। একসময় মনে হল, অনেক হয়েছে। এবার বিশ্রাম নেওয়া দরকার। সকালে উঠে প্রচুর হাঁটাহাঁটি আছে। আমাদের পরিকল্পনা হল পরদিন পায়ে হেঁটে স্টেট পার্ক ঘুরব। এখানে শয়তানের গর্ত নামে একটা জায়গা আছে, সেখানে যাব। তাছাড়া বেশ কিছু ট্রেইল আছে যেগুলো ধরে হাঁটতে থাকলে পার্কের সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলোতে যাওয়া যায়। সেসব ট্রেইল ধরে হাঁটব। কিন্তু এত ঝকঝকে রাতের আকাশ পেয়ে আমার মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি বা আকাশগঙ্গা দেখার ইচ্ছে চাগিয়ে উঠল। আকাশগঙ্গা পরিপূর্ণভাবে ফুটে উঠে রাত দেড়টা থেকে চারটার ভেতর। অত রাত পর্যন্ত জেগে থাকলে কালকে আর উঠতে হবে না। তাই ঠিক করলাম এখন ঘুমিয়ে পড়ব। দেড়টার দিকে উঠে আকাশগঙ্গা দেখে আবার ঘুমাব। একটা পঁচিশের দিকে দুশ্চিন্তায় নাকি উত্তেজনায় কে জানে, এলার্ম বাজার আগেই আমার ঘুম ভেঙে গেল। প্রিন্সকেও ঠ্যালা দিলাম। ও ঘুমের ঘোরে বলল, ‘একা একা দেখে আস।’ কিন্তু একা বাইরে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে গিয়ে রাতের বেলা হিসু চাপলে যেমন কাউকে না কাউকে নিয়ে টাট্টিখানায় যেতাম, সেরকম প্রিন্সকে নিয়ে বাইরে যেতে হবে। বাইরে যদি ভূত থাকে? ভূত না হোক, ভালুক? কয়েকবার ঠ্যালা দেওয়ার পর প্রিন্স উঠল। দুজনে চোখ কচলে বাইরে বের হলাম। যেমনটা ভেবেছিলাম, তেমন ঘুরঘুট্টি অন্ধকার নয়। একটু দূরে টাট্টিখানার মাথায় হলুদ বাতি জ্বলছে। সেখান থেকে ম্রিয়মাণ আলো আসছে। কিন্তু আকাশের দিকে তাকিয়ে হতাশ হলাম। ইয়া বড় একটা চাঁদ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। নিশ্চয় ব্যঙ্গ করছে, ‘হাঁদারাম! অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফি মারানোর সময় খেয়াল করিসনি আমি উঠেছি? আমার আলোর চোটে আকাশগঙ্গা দেখা যাবে?’ প্রিন্স কিছুক্ষণ এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করে এসে বলল, ‘নাহ, কোনোভাবেই আকাশগঙ্গা দেখা যাচ্ছে না। অমাবস্যার সময় এলে দেখতে পারবা।’ মন খারাপ করে বাসায় ঢুকতে যাব, এমন সময় কী যেন একটা সরসর করে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। অনেক কষ্টে চিৎকার চেপে দেখি একটা পিঁপড়েভুক (anteater)। ওটার দিকে তাকিয়ে আছি এমন সময় প্রিন্সের চাপা গলা শুনলাম, ‘দেখ, একটা হরিণ!’ ঘুরে তাকাতেই হরিণ লাপাত্তা। দেখতে পেলাম না। প্রিন্সের সাথে চোখাচোখি হতেই নাকি ঘুরে দৌড় মেরেছে।

ডিসেম্বরের ২৩ তারিখ সকালবেলা ঘুম থেকে উঠলাম সকাল নয়টায়। দাঁত মেজে, প্রকৃতির ডাকে সারা দিয়ে, নাশতা করে প্রস্তুত হলাম ঘুরতে বের হওয়ার জন্য। তার আগে পার্কের ভেতরে অবস্থিত একটা দোকান থেকে দুই ব্যাগ কাঠ কিনে আনলাম। এগুলো দিয়ে আজকে ক্যাম্পফায়ার হবে। এখানে যেসব পার্কে ক্যাম্পিঙয়ের ব্যবস্থা আছে, সেসব পার্কে সাধারণত একটা হলেও দোকান থাকে ক্যাম্পিঙয়ের জিনিসপত্র কেনার জন্য। কাঠ, কয়লা, গরম জামা, ফায়ার স্টার্টার, যা চান সব পাবেন। ব্যাগ দুটো কেবিনে রেখে আমরা ম্যাপ অনুযায়ী হাঁটতে শুরু করলাম। যখন চেকইন করেছিলাম, তখন পুরো পার্কের একটা ম্যাপ ধরিয়ে দিয়েছিল অফিসার। সে ম্যাপ দেখে শয়তানের গর্তের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। আধা কিলোমিটার পর পর ফলক দিয়ে রেখেছে কোনদিকে গেলে গর্তটা পাব। একবার বামদিক, একবার ডানদিক করতে করতে আধা ঘণ্টা পার হয়ে গেল, গর্ত আর আসে না। যে রাস্তা ধরে হাঁটছি, সেটা কোনো ট্রেইল নয়, গাড়ি চালানোর পাকা রাস্তা। দুইপাশে আরভি ক্যাম্পিঙয়ের জায়গা। তাবু, আরভি কিংবা কেবিন – নির্দিষ্ট ধরনের ক্যাম্পিঙয়ের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা আছে। সবাই যে সবখানে ইচ্ছেমত ক্যাম্পিং করতে পারবে, তা নয়। আরেকটা জিনিস জেনে মজা লাগল। টেক্সাসের স্টেট পার্কগুলোতে পার্ক হোস্ট প্রোগ্রাম নামে স্বেচ্ছাসেবী প্রোগ্রাম আছে। আপনি হোস্ট হিসেবে পার্কে থাকতে পারবেন অর্থাৎ পার্কে বেড়াতে আসা লোকজনকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করা, তাদের বিপদে এগিয়ে আসা ইত্যাদি কাজ করার বিনিময়ে পার্কে বসবাস করতে পারবেন। হোস্টরা সাধারণত একমাস থেকে ছয়মাস পর্যন্ত পার্কে থাকতে পারে। আমরা বেশ কিছু হোস্ট আরভি দেখলাম। গাড়ির সামনে লেখা ‘হোস্ট’। বেশ মজার জীবন, বলুন?

ভ্যালি স্প্রিং ট্রেইল

একসময় পৌঁছলাম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। কিন্তু গর্ত কোথায়? এ তো হ্রদের একটা কোণা! আমি ভেবেছিলাম গর্ত মানে বিশাল আকারের ডেবে যাওয়া আকৃতি। অ্যারিজোনায় উল্কার আঘাতে যেরকম বিশালাকায় গর্ত তৈরি হয়েছিল, সেরকম। কিন্তু এরা হ্রদের একটা অংশকেই ডেভিলস হোল বলছে। সাইনবোর্ডে লেখা, এখানে কোনো লাইফ গার্ড নেই। নিজের ঝুঁকিতে সাঁতার কাটুন। কিছুক্ষণ সেখানে বসে বসে চিন্তা করলাম এরপর কোথায় যাওয়া যায়। খেয়াল করলাম মানুষজন ডেভিলস হোল দেখা শেষ করে সামনের দিকে হাঁটছে। সবার পিছু পিছু আমরাও জুড়ে গেলাম। কাফেলা নিশ্চয় কোনো দর্শনীয় স্থানে যাচ্ছে! একটু পর দেখি, ঠিক। সবাই এসে থামল একটা টিলার গোড়ায়। এখান থেকে ভ্যালি স্প্রিং ট্রেইল শুরু হয়েছে। ট্রেইলটা একটা চক্রের মত। দু’দিকে দুটো রাস্তা চলে গেছে। যেকোনো একটা ধরে হাঁটা শুরু করলে বনের ভেতর দিয়ে ঘুরে আপনি আবার এখানেই ফেরত আসবেন। ডানে যে ছবিটা দিয়েছি, এবার সেদিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ছবিটার বিশেষত্ব হল, এখানে যে পাথরগুলো দেখা যাচ্ছে, সেগুলো আজ থেকে এক বিলিয়ন বছর আগে তৈরি হয়েছিল। এক বিলিয়ন মানে একশো কোটি বছর। ভাবা যায় একশো কোটি বছরের পুরনো পাথরের উপর দিয়ে আমরা হাঁটাহাঁটি করছি? কত ইতিহাসই না রচিত হয়েছে এই পাথরগুলোর উপর! আগে এসব এলাকায় আমেরিকান আদিবাসীরা থাকত। এখন সে দিন নেই, কিন্তু রয়ে গেছে তাদের স্মৃতি। সামনে আরও কিছু ছবি দেব ট্রেইলের। সেখানে যেসব পাথর দেখবেন, সবই একশো কোটি বছর আগেকার ‘gneiss (উচ্চারণঃ নাইস)’ পাথর।

ছবি ২

বামে যে ছবি (২) দেখছেন, সেটা ট্রেইলের চূড়ায় বসে তোলা। দুই পাশে পায়ে হাঁটার রাস্তা, মাঝে হ্রদের সরু একটা অংশ। খাদও বলা চলে কারণ নিচে পানি তেমন নেই, কিন্তু চূড়া থেকে খাড়া নেমে গেছে অংশটা। আমি উচ্চতাভীতির রোগী। কিন্তু এত সুন্দর জায়গা দেখে পা ঝুলিয়ে বসার লোভ সামলাতে পারলাম না। পিছলে পড়লে কয়েকশো ফুট নিচে চলে যাব। তারপরও সাহস করে বসলাম। যখন আপনার সামনে আঁকড়ে ধরার কিছু থাকবে না, শুধু থাকবে শূন্যতা, তখন যে অনুভূতি হয়, সেটা বড় অদ্ভুত! ভয়ডর যেন চলে যায়। মনে হয় ঝাঁপ দিয়ে পড়ি চূড়া থেকে, বা সাগরের সামনে দাঁড়ালে মনে হয় ঝাঁপ দিই পানিতে, তলিয়ে যাই চিরতরে। সবার এমন দার্শনিক ভাব নাও আসতে পারে। কিন্তু আমার আসে। বালি দ্বীপে গিয়ে যখন নুসা দুয়ার নীল সমুদ্রে ভাসছিলাম, মাথার উপরে ছিল নীলাকাশ আর চারপাশে পানি, কানও ডুবে ছিল পানিতে, তখন নিজের সাথে বোঝাপড়ার একটা মুহূর্ত এসেছিল। কিছু শুনতে পাই না সাগরের শো শো ছাড়া, কিছু দেখতে পাই না অসীম মহাশূন্য ছাড়া, কিছু অনুভব করতে পারি না শীতল পানি ছাড়া। কয়েক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, অনন্ত নক্ষত্র বীথির কাছে এই জীবনের মানে কী? ডুবে গেলেও বা মহাকালের কী আসে যায়?

ছবি ৩

যা হোক, ফিরে আসি ট্রেইলের গল্পে। মাটি আর পাথরের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল নিচে নেমে দেখে আসি কী আছে। কয়েকজন উৎসাহী পর্যটক চূড়া থেকে চড়াই উৎরাই পার হয়ে নিচে নামছে। একজনকে দেখলাম পিছলা খেয়ে হড়হড় করে নেমে গেল। আমিও নামব। প্রথমে প্রিন্সের খুব একটা ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আমার আগ্রহ দেখে ও-ও নামা শুরু করল। দুনিয়ার ঝোপঝাড়, কাঁটাগাছ, ক্যাকটাস আর বিপদজনক পিচ্ছিল রাস্তা পার হয়ে আমরা নেমে এলাম খাদে (ছবি ৩)। এখানে পানির স্রোত একেক জায়গায় একেক রকম। এক জায়গায় দেখলাম ঝর্ণার মত কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে, আরেক জায়গায় শুকনো। আমরা শুকনো অংশ ধরে এক পাড় থেকে আরেক পাড়ে গেলাম। হাঁচড়ে পাচড়ে উপরে উঠলাম। তারপর ঐ পাড়ের ট্রেইল ধরে হাঁটা শুরু করলাম। কিছুদূর গিয়ে মনে হল বনের ভেতর হারিয়ে যাচ্ছি। বেশ কয়েকটা রাস্তা চলে গেছে একেক দিকে। কোনটা মূল রাস্তা, বুঝতে পারছি না। মাথার উপর গনগনে রোদে পুড়তে পুড়তে এডভেঞ্চার করার ইচ্ছে নেই। ফলে বেরসিকের মত দুজনই ব্যাক টু দি প্যাভিলিয়ন, মানে খাদের যে অংশ দিয়ে নতুন পাড়ে এসেছি, সে অংশে ফেরত এলাম (ছবি ৩ যেখানে তুলেছি, সেখানে)। সাবধানে নিচে নেমে আবার টিলার প্রথম অংশে চলে এলাম। তবে অপর পাড়ে যাওয়ার পর খুব সুন্দর একটা দৃশ্য দেখেছিলাম (ছবি ৪)। ইংক্স লেক আর নাইস পাথর মিলে অপূর্ব এক দৃশ্য তৈরি করেছে। সবুজ রঙের পানি আর বাদামী পাহাড় একাকার হয়ে তৈরি করেছে অদ্ভুত শান্ত এক পরিবেশ। কর্তৃপক্ষ একটা বেঞ্চি দিয়ে রেখেছে আরাম করে বসে সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। কিন্তু আমরা মাটিতেই বসলাম (চলবে)।

ছবি ৪
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
100 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post প্রথম গ্ল্যাম্পিং এবং দীর্ঘশৃঙ্গ গুহা (পর্ব ৩)
Next post পিএইচডি দিনলিপি – ৮