বাংলাদেশে ‘খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান’ বা ‘পুষ্টি ও খাদ্য প্রকৌশল’ বিষয়ে যারা পড়ছেন বা পড়েছেন, তাদের অনেকের স্বপ্ন হয়ত বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার। ফেসবুকের উচ্চশিক্ষা সম্পর্কিত বিভিন্ন গ্রুপে (NexTop USA, HigherStudyAbroad – Global Hub of Bangladeshis) যথেষ্ট উপাদান আছে কীভাবে আপনি বিদেশে আসতে পারবেন, কী কী লাগবে সে ব্যাপারে (গ্রুপের পোস্ট, ফাইল সেকশনের ডকুমেন্ট, পোস্টের নিচে করা মন্তব্য ইত্যাদি পড়ুন)। আমি সেদিকে যাচ্ছি না। আমি কথা বলব বাংলাদেশ থেকে এই বিষয়গুলোতে পড়ার পর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র/কানাডায় উচ্চশিক্ষার জন্য আসতে চাইলে সেখানে কী ধরনের সুযোগ আছে, সে ব্যাপারে।
মোটা দাগে, পুষ্টি থেকে অনার্স বা মাস্টার্স শেষ করলে যুক্তরাষ্ট্র/কানাডায় আপনার সামনে দুটো সুযোগ আছেঃ
১) মাস্টার্সে বা পিএইচডিতে ভর্তি হওয়া
২) ডায়েটিটিক ইন্টার্নশিপে ভর্তি হওয়া
১) মাস্টার্সে বা পিএইচডিতে ভর্তি হওয়াঃ
অনার্স পাশ করার পর মাস্টার্স বা পিএইচডির জন্য সরাসরি আবেদন করা যায়, আবার দেশ থেকে মাস্টার্স শেষ করেও আবেদন করা যায়। মাস্টার্স শেষ করে পিএইচডির জন্য আবেদন করাটা স্বাভাবিক লাগলেও মাস্টার্স শেষ করে দ্বিতীয় মাস্টার্সের জন্য আবেদন করাটা অনেকের কাছে অস্বাভাবিক লাগে। কিন্তু এটা কোনো সমস্যা নয়। আমি ঢাকার আজিমপুরে অবস্থিত গার্হস্থ্য অর্থনীতি মহাবিদ্যালয় থেকে ২০১৩ সালে মাস্টার্স পাশ করেছিলাম। এরপর তিন বছর পিএইচডিতে ভর্তি হওয়ার জন্য চেষ্টা করেছি, ফান্ড পাইনি। কিন্তু মাস্টার্সে ফান্ডসহ ভর্তির সুযোগ পেয়েছি। ফলে পুষ্টির উপর এখন আমার দ্বিতীয় মাস্টার্স করছি। স্টেটমেন্ট অফ পারপাসে যৌক্তিকভাবে উল্লেখ করে দেবেন কেন দ্বিতীয় মাস্টার্স করতে চাচ্ছেন, সমস্যা হবে না।
যদি জিজ্ঞেস করেন মাস্টার্স শেষ করে কোনো চাকরি করতে পারবেন কিনা, আমার অভিজ্ঞতা বলবে, “খুব একটা সুবিধা করতে পারবেন না”। কারণ মাস্টার্স পাশ করার পর আপনি হবেন একজন পুষ্টিবিদ (নিউট্রিশনিস্ট), যার কোনো লাইসেন্স নেই। লাইসেন্স না থাকলে খুচরো চাকরি করা যায় যেগুলো করে হয়ত আপনার সন্তুষ্টি আসবে না। আবার লাইসেন্সধারী পথ্যবিদ (ডায়েটিশিয়ান) হতে চাইলে আপনাকে ডায়েটিটিক ইন্টার্নশিপ শেষ করে ডায়েটিটিক রেজিস্ট্রেশন পরীক্ষায় (আরডি এক্সাম নামে পরিচিত) পাশ করতে হবে। এখানে পুষ্টি নিয়ে যারা লেখাপড়া করে, তারা মূলত রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ান (আরডি) হওয়ার জন্য পড়ে। খুব কম সংখ্যকই পিএইচডির দিকে যায়। কিন্তু আপনি যেহেতু আরডি হওয়ার রাস্তায় হাঁটছেন না, তাই ভাল চাকরি পাওয়ার জন্য আপনার সামনে খোলা আছে পিএইচডিতে ঢুকার রাস্তা। পিএইচডি শেষ করে ইন্ডাস্ট্রি বা একাডেমিয়ায় গবেষণার কাজে যুক্ত হতে পারেন, পোস্ট ডকও করতে পারেন। আর যদি রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ান হওয়ার রাস্তায় হাঁটতে চান, তাহলে দুই নাম্বার পয়েন্ট পড়ুন।
২) ডায়েটিটিক ইন্টার্নশিপে ভর্তি হওয়া
যতদূর জানি, বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে পুষ্টিবিদ (নিউট্রিশনিস্ট) হিসেবে কাজ করার সুযোগ আছে কিন্তু পথ্যবিদ (ডায়েটিশিয়ান) হিসেবে নেই। কারণ আমাদের দেশে পথ্যবিদ তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রোগ্রাম, যা ডায়েটিটিক ইন্টার্নশিপ নামে পরিচিত, নেই। জিজ্ঞেস করতে পারেন নিউট্রিশনিস্ট আর রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ানের (আরডি) মধ্যে পার্থক্য কী? সবচেয়ে বড় পার্থক্য হল, একজন পুষ্টিবিদ তার অনার্স বা মাস্টার্স ডিগ্রির পড়াশোনার উপর ভিত্তি করে লোকজনকে কাউন্সেলিং দিয়ে থাকেন। কিন্তু একজনকে পথ্যবিদ হওয়ার জন্য অনার্স পাশ করার পর ১২০০ ঘণ্টার ডায়েটিটিক ইন্টার্নশিপের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। ইন্টার্নশিপের সময় প্রিসেপ্টরদের অধীনে থেকে বিভিন্ন শারীরিক অবস্থাবিশিষ্ট রোগীদের সাথে নির্দিষ্ট সময় ব্যয় করতে হয়। যেমন, হেপাটোবিলিয়ারি, ক্যান্সার, গ্যাস্ট্রোইন্টেস্টাইনাল, পিডিয়াট্রিক, জেরিয়াট্রিক, ইটিং ডিজঅর্ডার, রেনাল, নিউট্রিশন সাপোর্ট, কার্ডিওভাস্কুলার, ডায়াবেটিস ইত্যাদি। শুধু রোগী নয়, খাদ্য ব্যবস্থাপনা, ক্যাফেটেরিয়া ম্যানেজমেন্ট, পাবলিক হেলথ ইত্যাদি বিষয়েও সময় দিতে হয়। ইন্টার্নশিপ শেষ করার পর আরডি এক্সাম দিতে হয়। সেটায় পাশ করলে সরকারীভাবে আপনাকে রেজিস্টার্ড ঘোষণা করা হবে। তখন আপনি হবেন একজন রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ান। এজন্য যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডায় পুষ্টিবিদ এবং পথ্যবিদ – এই দুই পেশার মধ্যে মানুষ পথ্যবিদ তথা আরডিদেরই প্রাধান্য দেয়। তাদের কাছেই যায় কাউন্সেলিংয়ের জন্য কারণ আরডিরা সরকারীভাবে রেজিস্টার্ড।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় নামের পাশে টাইটেল হিসেবে RD না লিখে RDN লেখা থাকে। এর মানে হল রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ান নিউট্রিশনিস্ট। যারা পুষ্টির উপর ব্যাচেলর ডিগ্রি নিয়েছে এবং রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ান হয়েছে, তাদের জন্য এই টাইটেল। RD এবং RDN টার্ম দুটো interchangeable। ডাক্তাররা যেমন নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর স্পেশালাইজ করেন, একজন পুষ্টিবিদও Pediatric, Renal, Gerontological, Pediatric Critical Care, Oncology Nutrition, Sports Dietetics, Obesity and Weight Management ইত্যাদি যেকোনো বিষয়ের উপর স্পেশালাইজ করতে পারেন।
প্রাথমিক ধারণা দেওয়া শেষ, এবার আসি মূল সমস্যায়।
যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডার বাইরে থেকে যারা অনার্স, মাস্টার্স পাশ করে, তাদের জন্য ডায়েটিটিক ইন্টার্নশিপে ঢুকা প্রায় অসম্ভব। বাইরের দেশের ব্যাচেলর কোর্সওয়ার্ককে এখানে ডায়েটিটিক ইন্টার্নশিপে ঢুকার জন্য গ্রহণযোগ্য ধরা হয় না। এখানে কেবল যুক্তরাষ্ট্র/কানাডার অ্যাক্রেডিটেড ভার্সিটি থেকে পুষ্টির উপর ব্যাচেলর পাশ করা ছাত্রছাত্রীকে ডায়েটিটিক ইন্টার্নশিপে ঢুকার সুযোগ দেওয়া হয়। আপনি যদি ডায়েটিটিক ইন্টার্নশিপে ঢুকতে চান, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র/কানাডায় এসে আপনাকে এদের ব্যাচেলর পর্যায়ের অনেকগুলো কোর্স শেষ করতে হবে। এরপর আপনাকে যোগ্য ধরা হবে। আমার এক কলিগ চীন থেকে অনার্স করে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে, এখানে এসে আবার তাকে অনার্সের অনেকগুলো কোর্স শেষ করতে হয়েছে, এরপর ডায়েটিটিক ইন্টার্নশিপে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। আর বাংলাদেশ থেকে আমরা যারা আসতে চাই, তারা বেশীরভাগই ফান্ডের উপর নির্ভরশীল। অথচ এসব কোর্স আপনাকে করতে হবে নিজের টাকায়। তাই ব্যাপারটা আমাদের জন্য বেশ কঠিন। কিন্তু যাদের খরচ করার সামর্থ্য আছে, তাদের জন্য সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
বিভিন্ন ভার্সিটি বিভিন্ন মেয়াদের মাস্টার্স কাম ডায়েটিটিক ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম অফার করে থাকে। টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয় যেমন বিশ মাসের প্রোগ্রাম অফার করে, সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয় অফার করে পনেরো মাসের প্রোগ্রাম। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও পথ্য অনুষদে দুই ধরনের প্রোগ্রাম চালু আছে। এক, যারা ডায়েটিটিক ইন্টার্নশিপ করতে চায় না তাদের জন্য দুই বছরের মাস্টার্স প্রোগ্রাম; দুই, যারা মাস্টার্স এবং ডায়েটিটিক ইন্টার্নশিপ দুটোই একসাথে করতে চায় তাদের জন্য পনেরো মাসের প্রোগ্রাম। আমি প্রথম দলে। দ্বিতীয় দলের স্টুডেন্টরা পনেরো মাসের ভেতর মাস্টার্স আর ডায়েটিটিক ইন্টার্নশিপ – দুটোই শেষ করে।
ডায়েটিটিক ইন্টার্নশিপ নিয়ে আমার জ্ঞান এই পর্যন্তই। এর বেশি জানতে চাইলে নিচের লিংকে ঢুঁ মারুন।
https://www.cdrnet.org/rd-eligibility
ডিস্ক্লেইমারঃ গত এক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে পোস্টটা লিখেছি। যদি তথ্যে ভুল থাকে, অভিজ্ঞদের কাছে অনুরোধ রইল সেগুলো ধরিয়ে দেওয়ার। সবাইকে ধন্যবাদ!