1 0
Read Time12 Minute, 15 Second

প্রথম পর্ব

আজ ঠা ঠা গরম পড়েনি, কিন্তু পরিবেশ ঠাণ্ডাও নয়। বনের ভেতর হাঁটতে বেশ গরম লাগছে। যেখানে গাছপালা কম, সেখানে খাড়া সূর্যের আলো পড়ে তেঁতে আছে। তবে বেশীরভাগ এলাকাই গাছের ছায়ায় ঢাকা। হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে সরু একটা খাঁড়ি। এটার নামই ‘বিগ ক্রিক’। নিশ্চিত গাঁজা খেয়ে নাম রেখেছে। দুই হাত প্রশস্ত একটা খাঁড়ির নাম বিগ ক্রিক। বেচারা টেক্সাস! কিছু না পেয়ে এসব ছোটো ছোটো খাঁড়িকেই মহিমান্বিত করে রেখেছে। যারা কখনো টেক্সাসের বাইরে পা রাখেনি, তারা হয়তো এগুলো দেখেই কাৎ হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞ চোখ। হিমালয় দেখে এখন উইয়ের ঢিবিতে মন ভরে না। মাঝে মধ্যে ট্রেইলের মধ্যে বিগ ক্রিকের বাচ্চাকাচ্চার দেখা পাচ্ছি। মানে বিগ ক্রিক থেকে ছোটো ছোটো শাখা প্রশাখা বের হয়েছে। সেগুলোর উপর কাঠের টুকরো ফেলে রাখা হয়েছে পারাপারের জন্য। দেখে দেশের কথা মনে পড়ে গেলো। গ্রীষ্মকালে শুকিয়ে যাওয়া লৌহজং নদীর উপর বাঁশের তৈরি সাঁকো বসানো হতো। সেটার বেড়া ধরে ধরে সাঁকো পার হওয়া উৎসবের মতো ছিলো।

লোন স্টার হাইকিং ট্রেইল, টেক্সাস

আধা ঘণ্টা হাঁটার পর মনে হলো, কী ব্যাপার? আমরা তো ট্রেইলের অর্ধেক পথ এসে পড়েছি। একটু পর পার্কিং লট চলে আসবে। এখনো সিনিক এরিয়া চোখে পড়লো না। সেটা কোথায়? প্রিন্স সন্দেহ প্রকাশ করলো, ‘এই ট্রেইলই সিনিক এরিয়া নয় তো?’ তা কী করে হয়? আমার মাথায় ঘুরছে সিনিক এরিয়া মানে উঁচু জায়গা থেকে আশেপাশের প্রকৃতি দেখার উপায়। কিন্তু আরও মিনিট দশেক হাঁটার পর প্রিন্সের সন্দেহ আমার মনেও ঢুকে পড়লো। আসলেই… ট্রেইলটাকেই মনে হয় সিনিক এরিয়া বলছে। কী অদ্ভুত! প্রিন্স ক্ষেপে গিয়ে বললো, ‘পূর্ব উপকূলের অঙ্গরাজ্যগুলোর কাছ থেকে টেক্সাসের শেখা উচিৎ সিনিক এরিয়া কাকে বলে।’ এই বনকে সৌন্দর্যের খনি বলছে। অথচ অন্যান্য বনের চেয়ে এটা আলাদা কিছু না। নিজেকে রীতিমত প্রতারিত মনে হচ্ছে। পঁয়তাল্লিশ মিনিট ড্রাইভ করে এই কচু দেখতে এলাম। পাঠক, ভুল বুঝবেন না। হাইকিং করতে আমাদের সমস্যা নেই। আমরা হাইকিং পছন্দ করি। কিন্তু এখানে আসার পেছনে মূল উদ্দেশ্য হাইকিং ছিলো না। থাকলে এটা সাধারণ বন নাকি অসাধারণ, সেদিকে নজর দিতাম না। কিন্তু যেহেতু সিনিক এরিয়া দেখতে এসেছি, তাই মেজাজ বিগড়ে গেলো। শেষমেশ সান্ত্বনা নিলাম এই বলে, ঘণ্টাখানিক হেঁটে ভুঁড়ি কমেছে।

পার্কিং লটে ফিরে এসে ঢকঢক করে পানি খেলাম। হাইকিং বা ট্রেকিং যাই করেন না কেনো, পানির বোতল সাথে রাখবেন। আমরা রাখতে ভুলে গিয়েছিলাম। তাই ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত হয়ে গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে ফিরে এসেই একগাদা বিস্কুট আর পানি খেয়ে ফেললাম। এরপর রওনা দিলাম কেগল ক্যাম্পগ্রাউন্ডের দিকে। যাওয়ার সময় দুটো গাড়িকে দেখলাম সিনিক এরিয়ার দিকে আসছে। আমাদের বের হতে দেখে চালকেরা হাত নাড়ালো। মানে বিদায়। আমরাও পাল্টা হাত নাড়ালাম। মানে স্বাগতম। মনে মনে একচোট হেসেও নিলাম। যা শালা, গিয়ে দ্যাখ কী জিনিস! পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর ঢুকলাম ক্যাম্পগ্রাউন্ডে। আজ রবিবার বলে রেঞ্জার অফিস বন্ধ। রেঞ্জারদের বদলে আজ পার্ক হোস্টরা ক্যাম্পারদের চেক-ইন করাবে। আমরা ভাড়া নিয়েছি আটাশ নাম্বার ক্যাম্পসাইট। সেখানে তাঁবু খাটানোর জন্য নির্দিষ্ট এরিয়া, পার্কিং স্পট, চেয়ার, বেঞ্চি, ফায়ার পিট, গ্রিল, আর পানির কল আছে। গণ টাট্টিখানায় যেতে হলে হাঁটতে হবে মিনিট তিনেক।

আমরা তাঁবু খাটানো শুরু করলাম। দিনের আলো থাকতে থাকতে এসব কাজ করা উচিৎ। তাঁবু খাটিয়ে এয়ার ম্যাট্রেস ফুলিয়ে শোবার বন্দোবস্ত করতে ঘণ্টাখানিক লাগলো। এরপর চিপস আর হাওয়াই মিঠাই দিয়ে হালকা নাস্তা সারলাম। এমন সময় হাসিখুশি চেহারার এক হোস্ট তার এক হাত লম্বা কুকুর লুসিকে নিয়ে তাঁবুর সামনে এলেন। সত্তরের উপর হবে বয়স। কিন্তু কী ফিট! জিজ্ঞেস করলেন ভাড়া নেওয়ার রিসিট আছে কিনা। আমরা অনলাইন রিসিট দেখালাম। উনি একটা কাগজে খসখস করে চেক-ইন আর চেক-আউটের সময় লিখলেন। এটা গাড়ির কাঁচে ঝুলিয়ে রাখতে হবে যেন সহজে চোখে পড়ে। তারপর একটা ম্যাপ দিলেন আশেপাশের ট্রেইলের। তিনটা ট্রেইল আছে ক্যাম্পগ্রাউন্ড ঘিরে। এর মধ্যে একটা পড়েছে জলাভূমির মতো জায়গায়। সেখানে গেলে নাকি কুমির দেখা যায়! ক্যাম্পগ্রাউন্ডের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে  কনরো হ্রদ। সেখানে প্রচুর কুমিরের বাস। ওখান থেকেই রোদ পোহানোর জন্য কুমির উঠে আসে ট্রেইলে। ক্যাম্পারদের জন্য নির্দেশনা আছে যেন কুমির দেখলে অযথা খোঁচাখুঁচি না করে। কুমির এমনিতে মানুষ দেখলে ভয় পায়। কিন্তু সেটাকে উত্যক্ত করলে ছেড়ে কথা কইবে না। শুনে আমার চোখ উত্তেজনায় চকচক করে উঠলো। ঠিক করলাম জলাভূমির ট্রেইলেই আগে যাবো।

গাছের আড়ালে পার্কের বেঞ্চি আর টেবিলটা ঢাকা পড়ে গেছে। ফায়ার পিট কাম গ্রিলের সামনে নীল আর লাল চেয়ার দুটো আমাদের। তাঁবুটাও।

দুরুদুরু বুক নিয়ে ট্রেইলটা হেঁটে ফেললাম কিন্তু কুমির চোখে পড়লো না। কিছু লোক মাছ ধরছে হ্রদের পানিতে। এদের ভয়ডর বলে কিছু নেই? যদি কুমির টান দিয়ে নিয়ে যায়? এরপর শুরু করলাম আরেকটা ট্রেইল ধরে হাঁটা। এটা দিয়ে বনের বেশ গভীরে চলে গেলাম। বিশ মিনিট পর দেখি বন থেকে বের হয়ে হ্রদের পাড়ে চলে এসেছি। পাড় ধরে হাঁটার সময় হৃদপিণ্ডের ঢকঢক শব্দ শুনতে পেলাম। প্রতি মুহূর্তে মনে হতে লাগলো কুমির দৌড়ে আসছে। আমার আতঙ্ক দেখে প্রিন্স ফোঁড়ন কাটলো, ‘খুব তো নাচলে কুমির দেখবো, কুমির দেখবো বলে। এখন?’ হুহ! কোনোমতে ট্রেইলটা শেষ করে ফিরে এলাম তাঁবুতে। রাতে খাওয়ার জন্য কিছু কাঁচা সসেজ আর বান নিয়ে এসেছি। সসেজগুলো আগুনে ঝলসে নিতে হবে। সেজন্য ফায়ার পিটে কাঠ ফেলে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। একটু পর দেখি পাশের ক্যাম্পসাইটের দম্পতি এগিয়ে আসছে। এসে বললো, ‘শুকনো আবহাওয়ার জন্য স্যাম হিউস্টন অরণ্যে আপাতত ফায়ার পিট ব্যবহার করা নিষেধ।’ আমি আর প্রিন্স আকাশ থেকে পড়লাম। এরকম কোনো নির্দেশনা তো ওয়েবসাইটে দেখিনি! আমাদের চেহারা দেখে নারীটা বলল, ‘তোমরা এক ঘণ্টার মধ্যে রান্না শেষ করতে পারো কিনা দেখো। যদি না পারো, তাহলে বাইরে থেকে খেয়ে আসতে হবে। অথবা আমাদের স্টোভ ব্যবহার করে রান্না শেষ করতে পারো।’ পুরুষটা মাথা ঝাঁকালো। ধন্যবাদ জানিয়ে ওদের বিদায় করলাম। এরপর ফায়ার পিটের আগুন নেভালাম। যে বিস্কুট অবশিষ্ট ছিলো, সেগুলো খেয়ে ডিনার সারলাম। ঠিক করলাম, বাসায় পৌঁছেই একটা গ্যাস স্টোভ অর্ডার দেবো।

রাতে ঝড় হওয়ার পূর্বাভাস দিচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যে তাঁবুতে রাত কাটাবো ভেবে শিহরিত হচ্ছি। যদিও আমার ইচ্ছে ছিলো তাঁবুতে শুয়ে শুয়ে রাতের আকাশ দেখার। এরকম গভীর বনে নিশ্চয় হাজার হাজার তারা দেখা যাবে? কিন্তু বনের ভেতর বৃষ্টির অভিজ্ঞতাও অসাধারণ হওয়ার কথা। সন্ধ্যে নাগাদ ভ্যাপসা গরম পড়লো। কুমিরের ভয় ভুলে জামাকাপড় খুলে হ্রদের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করতে লাগলো। তীব্র গরমের ভেতর রাত দশটার দিকে ঘুমাতে গেলাম। আগামীকাল ভার্সিটি গিয়ে ক্লাস ধরতে হবে। একবার ভাবলাম তাঁবুর rain fly (বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁবুর উপরে লাগানোর আলগা পর্দা) লাগিয়ে ঘুমাই। কিন্তু সেটা লাগালে বাইরে থেকে হাওয়া ঢুকতে পারে না বলে প্রচণ্ড গরম লাগে। তাই ঝুঁকি নিয়ে সেটা ছাড়াই ঘুমিয়ে পড়লাম। মাঝ রাতে যদি বৃষ্টির ফোঁটায় ঘুম ভাঙ্গে, পর্দা লাগিয়ে নেবো। কিন্তু গরমে ঘুম বারবার চটে যাচ্ছে। বুঝলাম গরমকালে টেক্সাসে আর ক্যাম্পিং করা যাবে না। তারপরও প্রথম ক্যাম্পিং হিসেবে নেহাত মন্দ হলো না অভিজ্ঞতাটা।

সকালবেলা উঠে দেখি বৃষ্টির নামগন্ধ নেই। সারারাত আকাশ কেবল গুড়গুড় করে গেছে, এক ফোঁটা পানি ফেলেনি। দশটার মধ্যে বিছানা, তাঁবু গুছিয়ে রওনা দিলাম কলেজ স্টেশনের উদ্দেশ্যে। আসার পথে শুরু হলো ঝড়। সে কী তোড়! হাইওয়েতে ঝড়ের মুখে পড়লে জান গলায় উঠে আসে। আমাদের পিচ্চি গাড়ি একবার ডানে উড়ে যায়, একবার বামে। তার উপর পানির স্রোতের কারণে ওয়াইপার কাজ করতে পারছে না। উইন্ডশিল্ড একদম ঘোলাটে হয়ে আছে। এর মধ্যেই গাড়ি চালিয়ে চলে এলাম বাসায়। এবার দেখার বিষয় গ্রেট স্যান্ড ডুন আর রকি পর্বতে ক্যাম্পিং করতে কতোটা মজা লাগে।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
100 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post জীবন যাচ্ছে যেমনঃ স্যাম হিউস্টন জাতীয় অরণ্যে ক্যাম্পিং (প্রথম পর্ব)
Next post ছবি ব্লগঃ রকি পর্বতমালা, গ্রেট স্যান্ড ডিউন এবং অন্যান্য (পর্ব ১)