0 0
Read Time12 Minute, 9 Second

প্রথম পর্ব

যারা এক বছরের মধ্যে একাধিকবার যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্থানগুলোতে (উদ্যান, স্মৃতিস্তম্ভ, তৃণভূমি, অরণ্য, বিনোদন এলাকা, সংরক্ষিত এলাকা ইত্যাদি) যেতে চান, তাদের জন্য ভালো একটা বুদ্ধি হলো আশি ডলার দিয়ে বাৎসরিক পাস কিনে ফেলা। পাসের মেয়াদ এক বছর। যে মাসে কিনবেন, সে মাস থেকে এক বছর গোনা শুরু হবে। এক বছরের মধ্যে ওই পাস দিয়ে যত ইচ্ছে জাতীয় স্থানে প্রবেশ করতে পারবেন। যদিও ক্যাম্পিং করতে চাইলে আলাদা পয়সা দিতে হবে, কিন্তু জায়গাগুলোতে প্রবেশ করার খরচ বেঁচে গেলে আপনারই লাভ। কীভাবে? বেশীরভাগ জাতীয় উদ্যানে প্রবেশ করতে হলে গাড়ি প্রতি বিশ ডলার গুনতে হয়। এখন যদি আপনার কাছে বার্ষিক পাস না থাকে, তাহলে এক বছরের মধ্যে দশটা জাতীয় স্থানে ঘুরতে গেলে প্রবেশ মূল্য বাবদ খরচ হবে একশো বিশ ডলার। কিন্তু পাস থাকলে (মেয়াদোত্তীর্ণ নয়) আশি ডলার দিয়ে এক বছরের মধ্যে তেষট্টিটা উদ্যানেই যেতে পারবেন। সময়ে কুলাবে কিনা, সেটা অন্য হিসেব। তবে এই পাস শুধু একটা গাড়ির জন্য প্রযোজ্য হবে। এক গাড়ির ভেতর কয়জন যাত্রী আছে, সেটা ব্যাপার নয়। আপনি এক গাড়িতে দশজন নিয়ে উদ্যানে যান, আপনাকে ঢুকতে দেওয়া হবে। কিন্তু আপনি যদি দুটো গাড়ি নিয়ে যান এবং একটা পাস দেখিয়ে দুটো গাড়ি ঢুকাতে চান, পারবেন না। আবার একটা পাসে দুইজনের স্বাক্ষর দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। চাইলে দুজন ব্যক্তি মিলে একটা পাস একসাথে এবং আলাদাভাবে ব্যবহার করতে পারবে। ধরুন, আপনি এবং আপনার চেনাজানা একজন মিলে একটা ন্যাশনাল পার্ক পাস কিনলেন, কিনে দুজনেই স্বাক্ষর করলেন। মানে দুজনেই এই পাসের মালিক হলেন। গ্রীষ্মের ছুটিতে আপনারা ওই পাস নিয়ে মন্টানার গ্লেসিয়ার জাতীয় উদ্যানে ঘুরতে গেলেন একসাথে। আবার থ্যাংসগিভিংয়ের ছুটিতে আপনি ওই পাস নিয়ে একাই ঘুরতে গেলেন ফ্লোরিডার এভারগ্লেডস জাতীয় উদ্যানে। একইভাবে দ্বিতীয় মালিকও ওই পাস নিয়ে বড়দিনের ছুটিতে একা ঘুরতে গেলেন ক্যালিফোর্নিয়ার ইওসেমিতি জাতীয় উদ্যানে। বেশ না, ব্যাপারটা? আমরাও তাই অনলাইনে একটা পাস অর্ডার দিয়ে দিলাম। শিপিং খরচ পাঁচ ডলারসহ মোট পঁচাশি ডলার লাগলো। অর্ডার দেওয়ার পর সেটা হাতে আসতে লাগলো চারদিন। পাওয়ার সাথে সাথে দুজনে মিলে স্বাক্ষর করে সেটার মালিক হয়ে গেলাম।

এরপরের চিন্তা হলো খাবার দাবার নিয়ে। আমরা যেহেতু দিনের অধিকাংশ সময় হাইকিং করবো, তাই রান্নাবান্নায় বেশি সময় দেওয়া যাবে না। ব্যাকপ্যাকে শুকনো খাবার নিয়ে হাইকিংয়ে যেতে হবে। সেজন্য একগাদা প্রস্তুতকৃত খাবার কিনলাম। ওয়ালমার্টে একটা সেকশনই আছে ‘ক্যানড মিট অ্যান্ড টুনা’ নামে। সেখানে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের রেডিমেড মাছ আর মাংস পাওয়া যায়। রেডিমেড মানে আমেরিকান কায়দায় হালকা কিছু মশলা দিয়ে রান্না করা গরু, মুরগী আর শূকর। মাছ হিসেবে শুধু টুনা আর স্যামন পেলাম। দামী, কম দামী সব ধরনের প্যাকেটই পাবেন। এসব খাবার সরাসরি প্যাকেট খুলে খেয়ে ফেলা যায়। শুয়ে, বসে (খাঁটি বাংলায় ‘চেগিয়ে’) ক্যাম্পিং করতে গেলে যত ইচ্ছে কাঁচা মাংস নিয়ে যেতে পারেন, গ্রিল করে খেতে পারেন। কিন্তু হাইকিং যদি প্রধান লক্ষ্য হয়, তাহলে খাবার নিয়ে যথাসম্ভব কম ঝামেলা করা উচিৎ। আমরাও তাই মাছ, মাংস মিলিয়ে কমদামী কিছু খাবারের প্যাকেট কিনলাম। কেনার সময় মারুচানের ইনস্ট্যান্ট রামেন নুডুলসের কাপ চোখে পড়লো। সেগুলোও চিকেন, বিফ আর শ্রিম্প ফ্লেভার মিলিয়ে কয়েক প্যাকেট কিনলাম। আমাদের ফ্লাস্ক আছে। সেটায় গরম পানি নিয়ে হাইকিংয়ে গেলে নুডুলস সিদ্ধ করে খাওয়া যাবে। সাথে এক টিন প্যাটিস কিনলাম। ক্যাম্পে ফিরে প্যাটিস গরম করে বনরুটি দিয়ে খাবো।

কথা হলো, প্যাটিস আর পানি গরম করবো কীভাবে? শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে গরমকাল আসতে না আসতেই বনে বাদাড়ে আগুন জ্বালানোর উপর নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়ে গেছে। পশ্চিমা মুভি, টিভি সিরিজ দেখে দেখে আমার ধারণা হয়েছিলো যেকোনো সময় বনে বাদাড়ে গিয়ে আগুন জ্বালিয়ে বনফায়ার করা যায়। অথচ এটা যে কী পরিমাণ ভুয়া একটা ধারণা! আবহাওয়ার গতিবিধি দেখে বন অধিদপ্তর যেকোনো সময় আপনার পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দিতে পারে। যেমন, গত বছর ডিসেম্বরে আমরা গ্ল্যাম্পিং করতে গিয়ে ফায়ার পিটে আগুন জ্বালিয়ে মুরগী গ্রিল করেছিলাম, কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিলো না। কিন্তু কিছুদিন আগে টেক্সাসের স্যাম হিউস্টন জাতীয় অরণ্যে ক্যাম্পিং করতে গিয়ে ফায়ার ব্যানের কবলে পড়েছিলাম। ফায়ার ব্যান মানে বনের ভিতর রাখা ফায়ার পিটে বা খোলা জায়গায় শুকনো পাতা, কাঠ, কয়লা জড়ো করে আগুন জ্বালানো নিষেধ। এমন নিষেধাজ্ঞা জারি হলে রান্নার জন্য গ্যাস স্টোভ ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়। কলোরাডোতে গিয়েও ফায়ার ব্যানের মুখোমুখি হতে হয় কিনা, কে জানে। ঝুঁকি এড়ানোর জন্য একটা বহনযোগ্য চুলা কিনে ফেললাম। খুব হালকা আর কাজের জিনিস। চুলায় রান্না করলে সেটা সমস্যা ধরা হয় না কারণ এক্ষেত্রে আগুন খুব অল্প জায়গা জুড়ে জ্বলে যেটা সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু শুধু চুলা কিনলে হবে না, সেটার জন্য জ্বালানীও লাগবে। তাই কয়েকটা বিউটেন ক্যানিস্টার অর্ডার করলাম। ক্যাম্পে জ্বালানী হিসেবে বিউটেন আর প্রপেনই জনপ্রিয়। তবে প্রপেনের চেয়ে বিউটেন বেশি সাশ্রয়ী। তাই আমরাও বিউটেন ব্যবহার করা যায় এমন চুলাই কিনেছি। ঝামেলা শুরু হলো অ্যামাজনের ডেলিভারি নিয়ে। অর্ডার করার সময় দেখিয়েছিলো তিনদিনের মধ্যে চলে আসবে। অথচ তিনদিনের মাথায় জানতে পারলাম অর্ডার আসতে অপ্রত্যাশিতভাবে দেরি হচ্ছে। এখন এস্টিমেটেড অ্যারাইভাল টাইম দাঁড়িয়েছে দশদিন। দশদিনের মধ্যে আমরাই চলে যাচ্ছি ট্যুরে। কীভাবে কী? দৌড় দিলাম ওয়ালমার্টে। বিধি বাম! তাক ভর্তি শুধু প্রপেনের ক্যানিস্টার, বিউটেনের জায়গা খালি পড়ে আছে। গ্রীষ্মকালে সবাই ক্যাম্পিংয়ে যাচ্ছে। ফলে দোকান ভর্তি যেমন তাঁবু, চেয়ার, বঁড়শির ছড়াছড়ি, তেমনি প্রয়োজনীয় অনেক জিনিসের অভাবও। দৌড়ালাম পাশের শহর ব্রায়ানে। সেখানকার ওয়ালমার্টে মাত্র চারটা বিউটেন ক্যানিস্টার অবশিষ্ট আছে। দুটো কিনে নিয়ে এলাম।

এরপর ভাবনা শুরু হলো পরিব্রাজন বা হাইকিং নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র আর কানাডায় হাইকিং বলতে গ্রামাঞ্চল বা বনাঞ্চলের মধ্যে দিয়ে পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়াকে বুঝায়। ওয়াকিং বলতে শহরাঞ্চলের ভেতর সংক্ষিপ্ত হাঁটাচলাকে বুঝায়। যখন গাড়ি-ঘোড়ার ব্যবহার ছিলো না, তখন মানুষ জীবনের প্রয়োজনে পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতো। কিন্তু সেটার সাথে আধুনিককালের পরিব্রাজনের পার্থক্য হলো, এখন মানুষ হাঁটে আনন্দ পাওয়ার জন্য। উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্যে ‘ওয়াকিং’ দিয়েই সব কাজ সেরে ফেলা হয়। মানে এই শব্দ দিয়ে হাইকিং, ওয়াকিং সবকিছু বুঝায়। আমি আর প্রিন্স হাইকিং শুরু করেছি বছর দুয়েক হলো। পেন্সিল্ভেনিয়ায় যখন ছিলাম, তখন প্রতি মাসে হাইকিংয়ে যাওয়া হতো। কয়েক ঘণ্টা ড্রাইভ করলেই ওহাইও, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া কিংবা ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্য পড়তো। পা বাড়ালেই সুন্দর সুন্দর বনাঞ্চল ছিলো, পাহাড় পর্বত ছিলো। সেসব জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার নাম করে হাইকিং হয়ে যেতো। কিন্তু কলেজ স্টেশনে আসার পর গত আট মাসে তেমন কোথাও যাওয়া হয়নি। হবে কীভাবে? পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ যেদিকেই ড্রাইভ করি, সেদিকেই পাঁচ-ছয় ঘণ্টা শুধু সমতল টেক্সাসই দেখি। সাথে আছে টেক্সাসের অসহ্য গরম। এই গরমে বাসার বাইরে কিছু ভালোও লাগে না। তাই হাইকিংও করা হয় না। তারপরও শুধু কলোরাডো ভ্রমণের কথা মাথায় রেখে দুই জোড়া ট্রেকিং পোল বা ছড়ি কিনলাম। হাইকিং করতে গিয়ে কেনো ট্রেকিং পোল কিনলাম? কারণ এগুলো অতিরিক্ত হাত-পা হিসেবে কাজ করে। বিশেষ করে উপরের দিকে উঠার সময় ছড়িতে ভর দিয়ে উঠতে পারলে কম আয়াসে কাজ সারা যায়। তাছাড়া পাহাড়ি বা মেঠো পথে ভারসাম্য বজায় রাখতেও সাহায্য করে ছড়ি। অন্তর্জাল ঘেঁটে মনে হলো ক্যাসকেড কোম্পানির অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি ছড়িটাই আমাদের বাজেটের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অপশন। এরচেয়ে সস্তা কিংবা দামীও অনেক কিছু আছে। সামর্থ্য অনুযায়ী কিনে নিতে পারেন।

পর্ব তিন, চার, পাঁচ

Happy
Happy
100 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post ছবি ব্লগঃ রকি পর্বতমালা, গ্রেট স্যান্ড ডিউন এবং অন্যান্য (পর্ব ১)
Next post ছবি ব্লগঃ রকি পর্বতমালা, গ্রেট স্যান্ড ডিউন এবং অন্যান্য (পর্ব ৩)