2 0
Read Time9 Minute, 21 Second
টেক্সাসে মুভ করার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এক জায়গা থেকে তল্পিতল্পাসহ আরেক জায়গায় চলে যাওয়া এখানে ‘মুভ’ নামে পরিচিত। মুভ করা মানে বিশাল কিছু। এখানে এলে দেখবেন মুভের আগে আগে মানুষ দেদারসে জিনিসপত্র বিক্রি করছে। বিক্রি করার সময় না থাকলে বা কোনোকিছু বিক্রি না হলে সেগুলো ফেলে যাচ্ছে। এর মধ্যে সুন্দর সুন্দর জিনিসও থাকে। সেন্ট লুইসে থাকতে আমরা বেশ কিছু আসবাবপত্র এভাবে টুকিয়ে এনেছিলাম। আমেরিকান পরিবারের মুভ করা মানে ইউহল (U-Haul) ভাড়া করে দামী দামী জিনিসপাতি টেনে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু আমাদের মত আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা সাধারণত লাইট ট্রাভেল করে। তাদের জিনিস থাকে কম। গ্র্যাজুয়েট জীবনটা কোনোমতে পার করার জন্য যা যা দরকার আর কি। তাই অন্য কোথাও চলে যাওয়ার সময় সেসব জিনিস হয় ফেলে যায়, নয় বিক্রি করে দেয়। নতুন জায়গায় গিয়ে আবার নতুন করে কেনে। কিন্তু আমরা দুজন ছিলাম চরম নাদান। মিজৌরি থেকে পেন্সিল্ভেনিয়া মুভ করার সময় প্রচুর জিনিস নিয়ে এসেছিলাম। আমাদের এত জিনিস ছিল যে, প্রথম দফায় কিছু এনেছি; দ্বিতীয় দফায় আবার সেন্ট লুইসে গিয়ে বাকিগুলো নিয়ে এসেছি। তখন সেন্ট লুইসে পরিচিত ভাইবেরাদররা ছিলেন। তাদের কারো বাসায় এক সুটকেস ভর্তি কাপড়, কারো বাসায় এক কার্টন বই রেখে এসেছিলাম।
.
মাস দুয়েক পর যখন পেন্সিল্ভেনিয়ায় থিতু হলাম, তখন আবার সেন্ট লুইসে ফেরত গেলাম। নিয়ে গেলাম বিশাল এক পিকআপ। এখানে অবশ্য পিকআপ বলে কোনো বস্তু নেই। সবই ট্রাক নামে পরিচিত। দেশে জিনিসপত্তর টানাটানি করার গাড়িকে আকার ভেদে ভ্যান, পিকআপ, ট্রাক, নানা কিসিমের নামে ডাকা হয়। কিন্তু এখানে এরকম গাড়ি মানেই ট্রাক। তো, আটশো ডলার দিয়ে একটা ফোর বাই ফোর ভাড়া করে আমরা সেন্ট লুইসে গেলাম। শাওন ভাই গাড়ির ভাড়া শুনে জায়গায় দাঁড়িয়ে বোবা হয়ে গেলেন। অনেকক্ষণ পর জবান ফিরে পেয়ে বললেন, “আপনারা কি আটশো ডলারের জিনিস সেন্ট লুইসে রেখে গেছেন? সাকুল্যে তিনশো! এই তিনশো ডলারের জিনিস নেওয়ার জন্য ষোল ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে এসেছেন, তাও আবার আটশো ডলার ভাড়া দিয়ে?” ভাইকে কীভাবে বুঝাই আমাদের হিসেবে গণ্ডগোল হয়েছিল? আমরা চিন্তাই করিনি গাড়ি ভাড়া করতে এত টাকা লাগবে। জানলে কোন জিনিস নেব, কোনটা ফেলব, কোনটা বিক্রি করব, সেটা আরেকবার ভাবতাম। তবে সমস্ত দোষ যে আমারই ছিল, স্বীকার করে নিচ্ছি। প্রিন্স বারবার বলছিল, “আলতু ফালতু সব জিনিস ফেলে যাও। এত জামাকাপড় দিয়ে কী হবে? বেশিরভাগ জামাই তুমি পরনি। পরবাও না। হুদাই টেনে লাভ কী?” কিন্তু কোনো কাপড়ই আমার ফালতু লাগছিল না। সবকিছুই মনে হচ্ছিল জানের জান, প্রাণের প্রাণ। দেশে থাকতে যেহেতু বায়িং হাউজে কাজ করতাম, প্রচুর জামা উপহার পেয়েছিলাম আমেরিকায় আনার জন্য। সেগুলো সবই তিন সুটকেস ভর্তি করে এনেছিলাম। কিন্তু আনার পর দেখি ঘুরেফিরে চার, পাঁচটা জামাই কেবল পরা হচ্ছে। বাকিগুলো ভাল লাগছে না। কিন্তু তারপরও কোনোটাই ফেলতে মন চাচ্ছিল না। তাই সবকিছুই বস্তাবন্দী করলাম। দুই দফা টানাটানিও হল। পরে খেয়াল করলাম, বাটলারে এসেও আমি চার, পাঁচটা কাপড়ই পরছি। বাকিগুলো যেভাবে সুটকেসে করে এসেছিল, সেভাবেই পড়ে আছে। তখন বুঝলাম, ওগুলো ফালতুই ছিল।
 .
যা হোক, মানুষ ঠেকে শেখে। আমরাও শিখলাম। এবার টেক্সাসে যাওয়ার আগে তাই ধুমিয়ে সবকিছু গুডউইলে দিয়ে যাচ্ছি। এটা একটা দাতব্য সংস্থা। অন্যদের দান করা জিনিস এরা স্বল্প দামে বেচে থাকে। যদি আপনার কাছে ব্যবহারযোগ্য কোনো জিনিস থাকে (জামাকাপড়, বাসনকোসন, টিভি, আসবাবসহ যেকোনো কিছু), আপনি সেটা দান করতে পারেন। শুধু গুডউইল না, আরও অনেকগুলো দাতব্য সংস্থা আছে। সেন্ট ভিন্সেন্ট পলস, স্যাল্ভেশন আর্মি। যেকোনোটায় গিয়েই দান করতে পারেন। সেন্ট লুইসে থাকতে গুডউইল থেকে অনেক কিছু কিনেছিলাম। মানুষের দান করা মানেই যে ছেঁড়া, ফাটা, রঙচটা জিনিস, তা নয়। ভালমানের জিনিসই পাবেন। অনেকবার আমি ট্যাগসহ দামী ব্র্যান্ডের জিনিস পেয়েছি। কেউ হয়ত কিনেছিল, আর ব্যবহার করেনি। আমার বর্তমান ওয়ালেটটাও এভাবেই কেনা। DKNY ব্র্যান্ডের লাল রঙা ওয়ালেট, একদম ট্যাগসহ মোড়কজাত অবস্থায় পেয়েছিলাম গুডউইলে। দাম লেখা ছিল আড়াই ডলার। মাথা নষ্ট!
.
যা হোক, কথা হচ্ছিল মুভ করা নিয়ে। আমরা যেহেতু এবার পুরোপুরি হালকা হয়ে মুভ করব, তাই হিসেব করতে বসলাম বাসায় কী কী শুকনো আর পচনশীল খাবার আছে। ডাল, চটপটি, মশলা, গুঁড়োদুধ ইত্যাদি শুকনো খাবার নতুন করে কিনব না ঠিক করলাম। যা আছে, সেগুলো এমনভাবে শেষ করতে হবে যেন শেষ হতে হতে আমাদের যাওয়ার সময় হয়ে যায়। আবার পচনশীল খাবার যেগুলো বড় বড় প্যাকেট কিনতাম অনেকদিন যাবে বলে, সেগুলোর ছোট প্যাকেট কিনতে হবে যেন মুভিংয়ের সময় আসতে আসতে ফ্রিজে কিছুই না থাকে। এরপর বসলাম বইপত্র, খাতা, কাগজ নিয়ে। সেন্ট লুইসে থাকতে প্রচুর বই কিনেছিলাম। গুডউইলে বইয়ের দাম এক ডলার। এক হাজার ডলারের বইও আপনি এক ডলারে পাবেন। এটা দেখার পর কি মাথা ঠিক থাকে? ধুমসে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ইলাস্ট্রেটেড বই, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ইতিহাসের বই কিনেছিলাম। ভারী বইগুলো নিয়েও এসেছিলাম বাটলারে। এবার হাতেগোনা কয়েকটা বই রেখে বাকিগুলো গুডউইলে দান করে দিলাম। টানার মত অবস্থা নেই। আমাদের টয়োটা করোলা ২০০৪ খুবই ছোট একখান গাড়ি। আমি আর প্রিন্স বসলেই জায়গা শেষ। সেখানে ঠেলাঠেলি করে কীভাবে চারটা বড় সুটকেস আর দুটো ছোট সুটকেস ঢুকাব, মাথায় আসছে না… তায় বই! বইগুলো দান করতে গিয়ে কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। দুই বছর ধরে কতই না প্যাশন নিয়ে সংগ্রহ করেছিলাম! প্রিন্স সান্ত্বনা দিল, ‘টেক্সাসে গিয়ে আবার কিনো।’ হুম! দেশ ছাড়ার সময় বিশাল একটা বুকশেলফ ছেড়ে এসেছিলাম। কত ভালবাসা নিয়েই না বইগুলো কিনেছিলাম, অথচ আনতে পারলাম না। সেন্ট লুইসে যেগুলো কিনেছিলাম, বাটলারে আসার সময় সেগুলোর আদ্দেকই ছেড়ে এসেছিলাম। বাটলার থেকে কলেজ স্টেশনেও নিয়ে যাচ্ছি আদ্দেকের কম। কলেজ স্টেশনে গিয়ে হয়ত তিন, চার বছরে কেনা হবে আরও অনেক বই। কিন্তু যদি সেখান থেকে মুভ করি কোথাও, সেগুলোও ফেলে যেতে হবে। এভাবে হয় নাকি? আমার পাঠাগার গড়ব কীভাবে তাহলে?
Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
20 %
Excited
Excited
80 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post মৃত্যুকে ঘিরে তিনটা চলচ্চিত্র
Next post টেক্সাসে যাওয়ার প্রস্তুতি (পর্ব ২)