1 0
Read Time15 Minute, 53 Second

এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো, বারো, তেরো, চৌদ্দ, পনেরো, ষোল, সতেরো, আঠারো, ঊনিশ, বিশ

গতকাল গ্র্যাড ক্যাম্পে গিয়েছিলাম। এটা নতুন ভর্তি হওয়া গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের জন্য একটা আয়োজন। যদিও ক্যাম্প বললে তাবু খাটিয়ে থাকাথাকির কথা মাথায় আসে, এটা তেমন কিছু নয়। টামুর (এখন থেকে টেক্সাস এঅ্যান্ডএম ইউনিভার্সিটিকে সংক্ষেপে টামু বলব। আমেরিকান উচ্চারণে অবশ্য ঠেমিউ বা ঠেম্যু বলে) এলামনাই বা প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের জন্য নির্মিত সেন্টারে ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়েছে। নতুন শিক্ষার্থীরা যেন নিজেদের সাথে পরিচিত হতে পারে, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে জানতে পারে, সেজন্যে এই অনুষ্ঠান। সাথে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখার ব্যবস্থা আছে। রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে জানলাম, অনুষ্ঠানে গেলে টামুর লোগোওয়ালা টিশার্ট পাওয়া যাবে। লোভে পড়ে পনেরো ডলার দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে ফেললাম। প্রশ্ন আসতে পারে, পনেরো ডলার দিয়ে কি টামুর টিশার্ট কেনা যেত না? উঁহু। ওয়ালমার্ট, এইচইবি ইত্যাদি গ্রোসারির পাশাপাশি টামুর নিজস্ব দোকানেও ঘুরেছি। বিশ টাকার নিচে কোনো জামা নেই। তাই পনেরো ডলার দিয়ে যদি একটা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি জামাও পেয়ে যাই, সে সুযোগ নেওয়া দরকার।

রেজিস্ট্রেশন করে দেখি, আয়োজকদের পক্ষ থেকে একটা স্কলারশিপের ব্যবস্থা আছে। ওটা পেলে পনেরো ডলার ছাড়াই নিবন্ধন করা যাবে। কিন্তু আমি ইতোমধ্যে রেজিস্ট্রেশন করে ফেলেছি। তবে কি স্কলারশিপের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল? একটু ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখলাম, যারা টাকা দিয়ে ফেলেছে কিন্তু নিজেদের বৃত্তি পাওয়ার উপযুক্ত মনে করে, তারাও আবেদন করতে পারবে। আর যায় কোথায়? কিছু প্রশ্নের, যেমন – বৃত্তিটা কেন লাগবে, গ্র্যাড ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করলে কীভাবে আমি উপকৃত হব, ভার্সিটি জীবনের কোন ব্যাপারটার জন্য আগ্রহ নিয়ে বসে আছি, ইত্যাদির উত্তর লিখে সাবমিট করে দিলাম। যদি আয়োজকরা উত্তর পড়ে সন্তুষ্ট হয় আর বৃত্তি দেয়, তাহলে আমার রেজিস্ট্রেশনের টাকা ক্রেডিট কার্ডে ফেরত দেওয়া হবে। আবেদন করে দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভাবতে পারেন, পনেরো ডলার কি এমন কিছু যার জন্য স্কলারশিপের আবেদন করতে হয় বা ধাক ধাক কারনে লাগা বুক নিয়ে বসে থাকতে হয়? উত্তর হল, গরীব গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের কাছে পনেরো ডলার মাফ হওয়া বেশ আনন্দের ব্যাপার। যদিও পরিমাণটা বড় কিছু না, কিন্তু বৃত্তি পাওয়াটা বড় কিছু। It’s all about perspective. যা হোক, অনুষ্ঠানের ক’দিন আগে জানলাম আমি স্কলারশিপ পেয়েছি। টামু থেকে পাওয়া প্রথম স্কলারশিপ!

নির্দিষ্ট দিনে সকাল নয়টায় এলামনাই সেন্টারে পৌঁছে গেলাম। ইউনিভার্সাল আইডেন্টিটি নাম্বার (ইউআইএন হিসেবে পরিচিত) দিয়ে চেক-ইন করলাম। এটা টামুর সকল শিক্ষার্থীর জন্য ইউনিক। যেকোনো কাজ করতে গেলে ইউআইএন জানতে চায়। চেক-ইনের মেয়েটা নিবন্ধন যাচাই করে গ্রুপ ছয় লেখা একটা কার্ড ধরিয়ে দিল। দূরে একটা টেবিল দেখিয়ে বলল, “ওখান থেকে তোমার টিশার্ট নাও। তারপর ছয় নাম্বার গ্রুপ খুঁজে বের করে সেখানে যোগ দাও।” টিশার্টের টেবিলের সামনে বিশাল লাইন। লাইনে দাঁড়িয়ে চারপাশে চোখ বুলালাম। এশীয় লোকজন দেখে তাক লেগে গেল। পঞ্চাশ শতাংশই মনে হচ্ছে এশিয়া, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়া, থেকে এসেছে। মিনিট পাঁচেক পর হাতে টিশার্ট পেলাম। পাওয়া মাত্র দৌড় দিলাম বাথরুমে। পরনের টিশার্ট পাল্টে ওটা পরলাম। আহা! কতদিন ধরে টামুর জামা গায়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখছি। গায়ে দিয়ে যেন অ্যাডমিশন পাওয়া পূর্ণ হল। এরপর ছয় নাম্বার গ্রুপ খুঁজে বের করলাম। দলের কাউন্সিলর ‘গ্রুপ সিক্স’ লেখা একটা প্ল্যাকার্ড ধরে রেখেছেন। দলের সদস্যরা নিজের পরিচিতি দিচ্ছে। নাম, কোথা থেকে এসেছে, কোন ডিপার্টমেন্ট, মাস্টার্স নাকি পিএইচডি, ইত্যাদি তথ্য জানাচ্ছে। আমার পালা যখন এল, বললাম আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। কাউন্সিলর বিশাল হাসি দিয়ে বললেন, “আমিও বাংলাদেশের।” এত ভালো লাগল! মাত্র দুইদিন আগে একজন দেশী ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়েছিল টিচিং অ্যাসিস্টেন্টদের সেমিনারে গিয়ে। পরদিনই আরেকজন বাংলাদেশীর সাথে পরিচয় হবে, ভাবিনি। একটু পর দেখি আগের ভাইটাও গ্র্যাড ক্যাম্পের কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। উনাদের দেখে ঠিক করলাম, আগামী বছর আমিও এই দায়িত্ব পালন করব।

প্রাথমিক পরিচয় শেষে ক্যাম্পাস ট্যুর শুরু হল। হেঁটে হেঁটে ক্যাম্পাস ভ্রমণ। ৫,৫০০ একরের ক্যাম্পাস হেঁটে দেখা বিশাল ঝামেলার। তাই হাতেগোনা কিছু বিখ্যাত জিনিসের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ট্যুর শেষ হল। এর মধ্যে আছে কাইল ফিল্ড ওরফে ভার্সিটির ফুটবল স্টেডিয়াম। ১,০২,৭৩৩ টা আসন নিয়ে এটা টেক্সাসের সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম, আর পুরো যুক্তরাষ্ট্রে চতুর্থ। মজার ব্যাপার হল, আমেরিকানরা ফুটবল খেলে হাত দিয়ে। আমরা যেটাকে ফুটবল বলি, সেটা আমেরিকায় সকার হিসেবে পরিচিত। এজন্যেই হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, এদের মত ফাজিল জাতি দুইটা নেই। বন্ধু ফরহাদ বলে, “আমেরিকানরা হাত দিয়ে বল ছোঁড়াছুঁড়ির একটা খেলা আবিষ্কার করল। এই খেলার কী নাম দেওয়া যায় চিন্তা করতে করতে ওদের মনে হল, ফুটবলই সবচেয়ে ভালো মানায়!” আমেরিকানদের ফাজলেমির উদাহরণ হিসেবে সুইচ টেপার কাহিনী খুব প্রচলিত। এখানে নিচের দিকে চাপলে সুইচ বন্ধ হয়, উপরে খুলে। বাকি বিশ্ব যেখানে মেট্রিক সিস্টেমে হিসাব নিকাষ করে, আমেরিকানরা করে ইম্পেরিয়াল সিস্টেমে। এখানে আসার পর পাউন্ড (lb) আর আউন্সের (oz) খেল বুঝতে বুঝতে এক বছর কেটে যায়। আরও ফাজলেমি হল Noon বলতে এরা বুঝায় ঠিক দুপুর বারোটা। বারোটা বেজে এক মিনিট হলে সেটা হয়ে যাবে Afternoon । আবার Midnight বললে বুঝতে হবে ঠিক রাত বারোটা। এখানে ডেডলাইনের বেলায় Noon আর Midnight নির্বাচন করার প্রবণতা বেশি। তাই এসব ব্যাপারে সাবধান থাকবেন।

বলছিলাম ক্যাম্পাস ট্যুরের কথা। কাইল ফিল্ডের পর গেলাম পাঠাগার দেখতে। স্টারলিং ইভান্স আর কুশিং লাইব্রেরি নামের দুটো বিশাল পাঠাগার দেখলাম। টামুর মোট পাঠাগারের সংখ্যা আটের অধিক। ২০১৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি টামুর পাঠাগারে পঞ্চাশ লাখ-তম বইটা যোগ করা হয়। বইটা হল দা লর্ড অফ দা রিংসের লেখক জে আর আর টোকিয়েনের লেখা ‘দা হবিট’-এর প্রথম সংস্করণের একটা দুর্লভ কপি। গেম অফ থ্রোন্সের লেখক জর্জ আর আর মার্টিন টামুকে এই বই উপহার দেন। টামু মার্টিন বুড়োকে সম্মানসূচক ডক্টরেট উপাধিতে ভূষিত করেছে বলে তিনিও খুশি হয়ে এই উপহার দিলেন। কুশিং লাইব্রেরিতে রাখা বইটা যে কেউ দেখতে যেতে পারে। আমারও সময় করে একদিন যেতে হবে। এরপর গেলাম মেমোরিয়াল স্টুডেন্ট সেন্টারে। মেমোরিয়াল বলা হয় কারণ এটা বিভিন্ন যুদ্ধে টামুর যেসব শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে বা এখনও হচ্ছে, সবার স্মৃতির জন্য নির্মিত। এখানে ঢুকলে মাথার টুপি খুলে রাখতে হয়। টুপি খোলা এখানে সম্মানের প্রতীক। শিক্ষার্থীরা এখানে একটু দম ফেলতে আসে। খাওয়া থেকে শুরু করে বই কিংবা জামা, সবকিছুর দোকানই এখানে আছে। ক্লান্ত শিক্ষার্থীরা নরম সোফাতে গা এলিয়ে বিশ্রাম নেয়, বা ঘুমায়। একবার এক ছেলে কাগজে ‘অমুক সময়ে আমাকে ডেকে দিও, ক্লাস আছে’ লিখে কাগজটা কপালে লটকে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঐ সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ মেমোরিয়াল সেন্টারে ঘুরতে এলেন। তিনি ছেলেটাকে ডেকে বললেন, “ওঠ, বাছাধন! ক্লাসের সময় হয়ে গেছে।”

টামুর বিখ্যাত একটা অংশ হল সেঞ্চুরি ট্রি। একশো দশ বছর বয়সী গাছটা অনেক সংস্কারের জন্ম দিয়েছে। সঙ্গীকে নিয়ে এর তল দিয়ে হেঁটে গেলে সারাজীবন একসাথে থাকতে পারবেন, একা হেঁটে গেলে সারাজীবন একাই থাকতে হবে। কত মানুষ যে এই গাছের তলায় এসে সঙ্গীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে! গাছটা ঘিরে সম্প্রতি নতুন সংস্কার চালু হয়েছে। এর নির্দিষ্ট দুটো ডালের তলা দিয়ে বন্ধুকে নিয়ে হেঁটে গেলে সে বন্ধুত্ব আজীবন থাকবে। এরকম আরেকটা জায়গা দেখলাম। রাস্তার উপর ধাতব চাকতি লাগানো। ঐ চাকতির উপর দিয়ে হাঁটা যায় না। হাঁটলে দুর্ভাগ্য আসে। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় ফেল করে। তাই যারা পাশ করে বেরিয়ে গেছে তারা ওটা পাড়া দিতে পারবে, বর্তমান শিক্ষার্থীরা নয়।

এরপর গেলাম দুপুরের খাবার খেতে। সবাইকে বারো ডলারের কুপন দেওয়া হল। আমি এগারো ডলার দিয়ে একটা স্যান্ডউইচ আর একটা লেমনেড নিলাম।  স্যান্ডউইচে দুনিয়ার পিকেল দিয়ে রেখেছে। এরা যে কী মজা পায় পিকেলের মধ্যে, কে জানে। বিশ্রী টক টক স্বাদ। সিরকার মধ্যে জলপাই চুবিয়ে এই পিকেল বানানো হয়। পিকেল ফেলে দিয়ে দিয়ে স্যান্ডউইচ খেলাম। স্যান্ডউইচের সাথে একটা সুপও দিয়েছে। ব্রকোলি আর চেডার চিজের সুপ। এটা আমার বরাবরই প্রিয়। লাঞ্চ শেষ করে ফিরে এলাম এলামনাই সেন্টারে। এবার ভার্সিটির বিভিন্ন ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলল বক্তারা। খুব মজা পেলাম। টামুতে Yell বা চিৎকার করার একটা ঐতিহ্য আছে। আন্ডারগ্র্যাডের বিভিন্ন বর্ষের ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন ধরনের Yell দিয়ে থাকে। ফ্রেশম্যান, সফোমোর, জুনিয়র, সিনিয়র – সবার চিৎকারের ধরন আলাদা। গ্র্যাড স্টুডেন্টরা সিনিয়রদের মত চিৎকার করে। চিয়ার লিডিং ব্যাপারটা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন খেলায় গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। মুভিতে হয়ত দেখেছেন তরুণীরা ছোট ছোট জামা পরে চিয়ার লিডিং করে। কিন্তু টামুর কোনো খেলায় চিয়ার লিডার থাকে না। এখানে থাকে ইয়েল লিডার। এরা চিৎকার লিড করে। এদের সাথে সাথে দর্শকরাও ইয়েলিং করে।

দুপুর তিনটা নাগাদ মূল অনুষ্ঠান শেষ হল। এবার বিদায় নেওয়ার পালা। অডিটোরিয়াম থেকে বের হয়ে দেখি ভার্সিটির বিভিন্ন সংগঠন কলম, হাইলাইটার, সচেতনতামূলক স্টিকার, ওয়েলকাম ব্যাগ, মাস্ক ইত্যাদি নিয়ে মেলা বসিয়েছে। সবকিছুই ফ্রি। সাথে সাথে এশীয়রা হামলে পড়ল টেবিলগুলোয়। শ্বেতাঙ্গ বা কৃষ্ণাঙ্গ কাউকে দেখলাম না মুঠো মুঠো করে জিনিস বগলদাবা করছে। কিন্তু এশীয়, বিশেষ করে দক্ষিণ এশীয়রা একদম ঝাঁপিয়ে পড়েছে। একটা সংগঠন বিনামূল্যে কনডম বিলাচ্ছে। বলছে, ওদের অফিসে গেলে ফ্রিতে আরও কনডম দিবে। তারপরও যেন আমরা নিরাপদ যৌনতা অনুশীলন করি। এতদিন শুনে এসেছি আমেরিকার ভার্সিটিতে ফ্রি কনডম দেয়। এবার চোখে দেখলাম। উদ্যোগটা অবশ্যই প্রশংসনীয়। আমিও কিছু জিনিসপাতি ব্যাগে ভরে বেরিয়ে এলাম বাইরে। এতক্ষণ সুন্দর ঠাণ্ডা পরিবেশে ছিলাম। বাইরে এসে মনে হল অগ্নিকুণ্ডে পড়লাম। কিন্তু কী করার? টেক্সাসে থাকব আগামী চার বছর। যত দ্রুত মানিয়ে নিতে পারি, ততই মঙ্গল।

Happy
Happy
17 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
83 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post পিএইচডি দিনলিপি – ১
Next post পিএইচডি দিনলিপি – ৩ (কাজের চাপ)