3 0
Read Time9 Minute, 36 Second

এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো, বারো, তেরো, চৌদ্দ, পনেরো, ষোল, সতেরো, আঠারো, ঊনিশ, বিশ

আগস্টের দুই তারিখে টেক্সাসে মুভ করার পর থেকে চেয়ার-টেবিলের সাথে আটকে গেছি। সে আঠা কিছুতেই ছাড়াতে পারছি না। গ্রাম গঞ্জে বাউল গান গায়, “পিরিতি কাঁঠালের আঠা, ও আঠা লাগলে পরে ছাড়ে না।” আমাদের গাওয়া উচিৎ, “পিএইচডি সুপার গ্লু ভেইবে, ভর্তি হলে ছাড়ে না…।” মজার ব্যাপার হল, এই আটকে যাওয়া আমার খারাপ লাগছে না। অন্তত এখনও পর্যন্ত। চাকরি জীবন থেকে অনেক ভালো আছি। চাকরি করার সময় আট ঘণ্টা অফিসে থাকতাম, বাসায় থাকতাম ষোল ঘণ্টা। তবুও শরীর ক্লান্ত লাগত। চাকরিটা উপভোগ করতে পারছিলাম না বলে প্রতিদিন সকালে জোর করে অফিসে যেতাম। দিনের শুরুতেই মন মরে যেত। কিন্তু এখন ষোল ঘণ্টা কাজ করে আট ঘণ্টা ঘুমালেও শরীর ঝরঝরে লাগে কারণ মনের মত কাজ পেয়েছি। উইকডে বা উইকেন্ড, শনি থেকে শুক্র, সাতদিনই কাজ করছি। খারাপ লাগছে না। এর একটা কারণ হতে পারে, পিএইচডি শুরুর আগে থেকে আমি জানি এটাকে লাইফ স্টাইল বানিয়ে ফেলতে হবে। জীবন থেকে আলাদা করে দেখা যাবে না। আলাদা করলেই অশান্তি। মনে হবে আমি খালি কাজই করছি, বিনোদনের সময় পাচ্ছি না। কিন্তু আমি সাতদিন কাজ করতে করতেই নেটফ্লিক্স দেখছি, অ্যামাজন প্রাইম দেখছি, সিনেমা হলে যাচ্ছি। অর্থাৎ কাজের জন্য আলাদা সময় বের না করে সারাদিনই কাজ করছি, আবার বিনোদনও নিচ্ছি। এজন্যেই হয়ত খারাপ লাগছে না। এজন্য বুজুর্গরা বলেন, প্যাশন অনুযায়ী কাজ করা উচিৎ। এতে ব্যাপারটাকে আর প্রাত্যহিক জীবন থেকে আলাদা মনে হবে না। জানি, সবসময় সুযোগ আসে না ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করার। কিন্তু সুযোগ তৈরি করে নিতে হয়। ধৈর্য না হারিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। আমার পাঁচ বছরের সংগ্রামের কথা অনেকবার বলেছি। ২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত। ২০১৮-তে যুক্তরাষ্ট্রে মাস্টার্স করার সুযোগ পেয়ে লুফে নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার মূল লক্ষ্য ছিল পিএইচডি করা। তাই ২০১৮ থেকে ২০২১ পর্যন্ত আরেক দফা সংগ্রাম গেছে প্যাশন অনুযায়ী পিএইচডি প্রোগ্রাম খুঁজে পেতে। এতে দমে যাইনি। অনেকবার হতাশ হয়েছি, প্রণোদনা (হালে যেটা মোটিভেশন নামে পানি পাচ্ছে) হারিয়ে ফেলেছি, কিন্তু আবার ফিরেও এসেছি। রবার্ট ব্রুসের মত লেগে রয়েছি মনের আশা পূরণের পিছে। শেষমেশ সুযোগ করে নিতে পেরেছি।

গত তিন সপ্তাহ ধরে মিটিংয়ের পর মিটিং করছি ক্রিটিকেল অ্যাপ্রেইজাল কোর্সের কন্টেন্ট সাজানোর জন্য। চারজন টিচিং অ্যাসিস্টেন্ট আর একজন প্রফেসর মিলে মিটিং। প্রতিবার বলি এক ঘণ্টার মিটিং, কিন্তু সেটা দুই থেকে চার ঘণ্টায় গড়ায়। টামুর ফল সেমিস্টারের প্রথম ক্লাস শুরু হবে আগস্টের ৩০ তারিখ থেকে। এর আগেই কন্টেন্ট চূড়ান্ত করতে হবে। এজন্য চার ঘণ্টার মিটিংয়েও কারো আপত্তি দেখি না। তার উপর দুইজন টিএ চৈনিক। চীনাদের রাতদিন কাজ করার সুনাম-দুর্নাম, দুই-ই শুনেছি। এবার চর্মচক্ষে দেখছি। ওরা রাত জেগে ল্যাবে কাজ করে, সাথে কোর্সের স্লাইড তৈরি করে। সেই স্লাইড আমাদের পাঠায় ভোর তিনটা, চারটার দিকে। সকালে চোখ কচলাতে কচলাতে দেখি ওদের কারবার। কানাডিয়ান প্রফেসর ভড়কে গিয়ে বলেছিলেন, “তোমরা রাত একটা, ভোর চারটা, এরকম সময়ে ইমেইল পাঠাও কেন? রাতে ঘুমাও না?” হেইওয়ান আর জিয়ান হেসে বলেছিল, তারা দুইজনই রাত জাগা পাখি। নাইট আউল। ল্যাবের কাজ শেষ হতে হতে গভীর রাত হয়ে যায়। তাই ঘুমানোর সময় পায় না। এজন্য রাত জেগে অন্যান্য কাজ করে, সকালে ঘুমায়। বাকি তিনজন আমরা সকালের পাখি। সারাদিন কাজ করি, রাতে ঘুমাই। এ থেকে আরেকটা জিনিস বুঝলাম। রাতে ঘুমানোর ব্যাপারটা চিরন্তন সত্য নয়। শরীর যেভাবে খাপ খাওয়াতে পারে, যেভাবে সবচেয়ে বেশি উৎপাদনশীল হয়, সেভাবেই কাজ করতে দেওয়া উচিৎ। বিবর্তনীয় ব্যাখ্যা অনুযায়ী আমাদের শরীর রাতে বিশ্রাম নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশি অভ্যস্ত হলেও এটা পাল্টেও ফেলা যায়।

অনেককে বলতে শুনি, পিএইচডির প্রথম এক মাস বা ছয় মাস বা এক বছর বেশ হালকা চালে যায়। যারা এমন বলেন, তারা হালকা চাল বলতে কী বুঝেন? আমি তো দেখি প্রথম বছরে অনেকগুলো কোর্স নিতে হয়, প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দিতে হয়, ডিজার্টেশন কমিটি তৈরি করতে হয়। এগুলো তো অনেক চাপের কাজ! অত দূরেই বা যাচ্ছি কেন? প্রথম সেমিস্টারেই তো আমার টিএশিপ, তিন ক্রেডিট করে মোট নয় ক্রেডিটের তিনটা কোর্স, শূন্য ক্রেডিটের সেমিনার নিয়ে মাথা খারাপ অবস্থা। এর উপর আছে আমার রিসার্চ প্রজেক্ট। যদিও পুরোদমে শুরু হয়নি, কিন্তু প্রফেসর প্রতি সপ্তাহে দুটো করে পেপার পড়তে দিচ্ছেন। পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন ভবিষ্যৎ কোলাবোরেটরদের সাথে। উনাদের সাথে ইমেইল চালাচালি করতে করতে বেশ কয়েক ঘণ্টা চলে যায়। আবার পেপারগুলো নিয়ে প্রফেসরের সাথে সপ্তাহে একবার মিটিং করতে হয়। সেটাও অনেক সময় খেয়ে ফেলে। এগুলো তো আমার কাছে হালকা চালের কিছু লাগে না। অবশ্য আগেই বলেছি, সবার জার্নি একরকম নয়। হয়ত এগুলো কারো কাছে হাতের মোয়া, কিন্তু আমার কাছে অনেক কিছু। অনেকে হয়ত এত গ্যাঞ্জামের ভেতর দিয়ে যায় না প্রথম সেমিস্টারে, কিন্তু আমার যেতে হচ্ছে। বড় কথা হল, এমন পরিস্থিতিতে পড়ে আপনার অনুভূতি কী? মুন্নী সাহার এই বিখ্যাত প্রশ্ন নিয়ে যতই ফাজলেমি করি, দিন শেষে এটাই জরুরী বিষয়। গবেষক হওয়ার রাস্তায় যে নামলেন, সেটা কেমন লাগছে? হতে পারে অন্যদের তুলনায় আপনার কাজ বেশি, অন্যদের তুলনায় আপনার মাথা কম কাজ করে (পাঁচ মিনিটের জায়গায় দশ মিনিট লেগে যায়), কিন্তু কাজগুলো আপনি উপভোগ করছেন তো?

হেইওয়ান পিএইচডির তৃতীয় বর্ষে আছে। খুব স্মার্ট একটা মেয়ে। ক্রিটিকেল থিংকিংয়ে খুব ভালো। যেকোনো বিষয়ের দারুণ সমালোচনা করতে পারে। ওর মতামত শুনে ভাবি, আমি কেন এভাবে চিন্তা করতে পারি না? তারপর ভাবি, তুলনা করে মন খারাপ করার চেয়ে ওর কাছ থেকে শিখে নিই কীভাবে চিন্তা করতে হয়। কেউ একজন বলেছিল, আজ সারাদিন কত চাপ যাবে এভাবে না ভেবে দিন শেষে নতুন কী শিখব, এভাবে চিন্তা করতে। এভাবে প্রণোদনা পাওয়া যায়। কিন্তু দিনের শুরুতেই চাপের কথা ভেবে মিইয়ে গেলে সমস্যা। আমিও তাই অন্যের সাথে তুলনা করে মানসিক শান্তি হারাম করার চেয়ে অন্যের কাছ থেকে শেখার দিকে মনোযোগ দিচ্ছি। আমার ভ্রমণ মাত্র শুরু। এক বছর পর হয়ত আমিও হেইওয়ানের মত ক্রিটিকেল থিংকিং করতে শিখব। তাই হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ঐ যে বলে না, “Geniuses are made, not born”? হা হা হা!

Happy
Happy
17 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
83 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post পিএইচডি দিনলিপি – ২ (গ্র্যাড ক্যাম্প)
Next post পিএইচডি দিনলিপি – ৪ (এক মাস হল পার)