0 0
Read Time12 Minute, 25 Second

এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো, বারো, তেরো, চৌদ্দ, পনেরো, ষোল, সতেরো, আঠারো, ঊনিশ, বিশ

পিএইচডি জীবনের দুই মাস কেটে গেছে। সময় কি দ্রুত দৌড়ায়! মনে হয় এই তো সেদিন অ্যাডভাইজরের কাছ থেকে ইতিবাচক ইমেইলটা পেয়েছিলাম। প্রিন্স তখন বারান্দায় বসে ছিল। গ্রীষ্ম শুরু হবে হবে করছে। বিকেলে সুন্দর হাওয়া দেয় বলে অফিস থেকে ফিরে আমরা বারান্দায় বসি। সাত তলার বারান্দা থেকে প্রকৃতির রূপটা খুব বেশি চোখে পড়ে। আমরা চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে খাই আর সবুজ প্রকৃতি দেখি। পাহাড় কখনো পুরনো হয় না আমাদের কাছে। একই দৃশ্য আমরা প্রতিদিন মুগ্ধ হয়ে দেখি। পাহাড়ের উপর বানানো বাড়িগুলো দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। কখনো কি হবে এরকম একটা বাড়ি? বাটলারে যেখানে থাকতাম, সেখানে জাপানী ধাঁচের বাড়ি দেখা যেত। সন্ধ্যে নামার মুখে সেসব বাড়িতে টুক টুক করে হলদে আলো জ্বলে উঠত। কিন্তু কখনোই পুরো বাড়িতে আলো জ্বালানো হত না। কয়েকটা রুমে জ্বলত শুধু। সেসব আলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন রহস্যময় লাগত সবকিছু! কল্পনা করার চেষ্টা করতাম, বাড়ির বাসিন্দারা ঐ মুহূর্তে কী করছে। ঠিক তখন আমাদের নিচের ফ্ল্যাট থেকে আগরবাতির গন্ধ ভেসে আসত। বিল্ডিংয়ে কিছুদিন আগে এক ভারতীয় দম্পতি এসেছে। তারাই হবে হয়ত। সেই গন্ধ আমাকে ছোটবেলার কথা মনে করিয়ে দিত। আমার ছোটবেলা কেটেছে হিন্দু এলাকায়। আশেপাশে অনেকগুলো হিন্দু পরিবার ছিল। তারা প্রতি সন্ধ্যায় তুলসি গাছে পূজা দিত। তাদের ঘর থেকে আগরবাতির গন্ধ ভেসে আসত কিনা, মনে নেই। তবে এই গন্ধের সাথে হিন্দুয়ানী পরিবেশের স্মৃতি গেঁথে আছে আমার মাথায়। কোথাও এই গন্ধ পেলেই মনে পড়ে যায় ছোটবেলার ঐ মফস্বলের কথা। মনে পড়ে তুলসি গাছ, উলু ধ্বনি আর কাসার ঘটিবাটির কথা। দেশ থেকে আট হাজার মাইল দূরে এসেও সে স্মৃতি আমায় ছাড়ে না। মস্তিষ্কের গহীন থেকে বের হয়ে আসে। কিন্তু তখন মনে হয়, এসব ঘটনা আমার জীবনে কখনো ঘটেনি। সবই যেন অন্য এক জীবনের গল্প, কেমন আবছা আবছা ধূসর…।

পিএইচডি জীবনের দুই মাস পার হয়ে গেল। এই দুই মাসে শিখলাম যে, আমাকে নিজের উদ্যোগে বহু কাজ করতে হবে। আগে যেমন কোর্সওয়ার্ক করলেই ডিগ্রি পেয়ে যেতাম, এখন আর তেমন নেই। পিএইচডির সময়টা আপনি কীভাবে কাজে লাগাবেন এটা নির্ভর করে আপনার উপর। যদি চান অ্যাডভাইজর যতটুকু কাজ করতে বলবেন ততটুকুই করবেন, নিজের গরজে কিছুই করবেন না, সেটাও করতে পারেন। আবার অ্যাডভাইজরের আশায় বসে না থেকে নিজ উদ্যোগে লিটারেচার সার্চ করে নতুন নতুন আইডিয়া বের করা, সাম্প্রতিক পেপার পড়ে আপনার রিসার্চ টপিকের উপর নতুন জ্ঞান অর্জন করা, খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান থেকে আপনার মেজরের উপর অনলাইন কোর্স করা (ফ্রি হলে তো কথাই নেই), কিংবা কোথাও যদি ওয়ার্কশপের সন্ধান পান, সেটায় যোগ দেওয়ার জন্য ফান্ড যোগাড় করা ইত্যাদি কাজেও মনোযোগ দিতে পারেন। দ্বিতীয় গোত্রের মানুষজন শেখে বেশি কারণ তারা অনেক কিছু নিয়ে কাজ করে। আমার অ্যাডভাইজর সবসময় বলেন, শেখার জন্য হাতে কলমে কাজ করার বিকল্প নেই। থিওরি বেইজড কোর্সওয়ার্ক উনার পছন্দ নয়। উনি ফলিত (applied) পুষ্টিবিজ্ঞানের লোক। আমার মত যারা ফলিত পুষ্টিবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে আসে, তাদের জন্য ১০০% থিওরি বেইজড কোর্সের মাহাত্ম্য উনার মাথায় ঢুকে না। এজন্য আমার প্রাণরসায়ন কোর্স নিয়ে উনার তুমুল আপত্তি ছিল। কিন্তু core curriculum-এর গ্যাঁড়াকলে পড়ে কোর্সটা নিতে হয়েছে। সে কোর্স নিয়েই আমার এই বাজে সপ্তাহের উৎপত্তি।

প্রাণরসায়নের স্নাতকোত্তর কন্টেন্টগুলো আমার কাছে বিশাল প্যাঁড়া লাগছে। কীভাবে ল্যাক্টেট আর গ্লুটামিনের আধিক্য মস্তিষ্কে স্বাভাবিক রক্ত চলাচল হতে বাঁধা দেয় – এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু যখন প্রফেসর পড়াতে শুরু করেন আইসোটোপ দিয়ে কীভাবে মেটাবলিক পাথওয়ের কাজকর্ম নির্ধারণ করা যায়, আমার মাথা ওলট পালট হয়ে যায়। আমি কিছুতেই বুঝি না আইসোটোপের কাহিনী। একটা পাথওয়েতে কী পরিমাণ NADPH উৎপন্ন হবে, সেটা বের করার উপায় আমার বুঝে আসে না। তেরো বছর আগে অনার্সে থাকতে প্রাণরসায়ন পড়েছিলাম। তখন সত্যনারায়ণের সোজা বই দিয়েই চলে গিয়েছিল। এখন পড়তে হচ্ছে ডঃ উ-এর লেখা প্রিন্সিপালস অফ অ্যানিম্যাল নিউট্রিশন আর অ্যামিনো অ্যাসিড বই দুটো। উফ! এত কঠিন কন্টেন্ট আমার জন্য নয়। এগুলো যারা নিউট্রিশনাল বায়োকেমিস্ট্রি বা বেসিক নিউট্রিশনে ক্যারিয়ার গড়তে চায়, তাদের জন্য। আমার ক্যারিয়ার হবে অ্যাপ্লায়েড নিউট্রিশনে। আমি এগুলো পড়ে কী করব? আমার দরকার পরিসংখ্যান, গবেষণা পদ্ধতি, রোগবিস্তার বিদ্যা ইত্যাদির উপর কোর্স। যদিও সেকেন্ড সেমিস্টার থেকে এগুলোই নেব, কিন্তু তবুও প্রথম সেমিস্টারের এই অযাচিত প্যাঁড়া আর ভাল লাগছে না। যারা প্রাণরসায়নের শিক্ষার্থী, তারা ভুল বুঝবেন না। এই বিষয় নিয়ে জানতে আমার খুব ভাল লাগে। কীভাবে আমাদের শরীর কাজ করে, সেটা দারুণ কৌতূহলোদ্দীপক! তাই যখন প্রফেসর উ গল্প করেন কীভাবে ডাইক্লোরোঅ্যাসিটেট শিশুদের জীবন রক্ষা করে, কিংবা কীভাবে ফ্রান্সে একের পর এক শিশু গ্লুকোজের পরিমাণ কমে গিয়ে মারা যাচ্ছিল কিন্তু কেউ ধরতে পারছিল না কেন এমন হচ্ছে, আমি হা করে শুনি। কিন্তু যখন উনি অংক করতে বসেন, তখনও আমি হা করে থাকি ঠিকই, কিন্তু সেটা “কিছুই বুঝতাম ফারতেসি না” ধরনের হা।

দুই সপ্তাহ আগে ডঃ উ আমাদের মিডটার্মের প্রশ্ন দিলেন। ওপেন বুক একজাম। এক সপ্তাহের মধ্যে বই বা নেট ঘেঁটে, যে যেভাবে পারে উত্তর দেবে। কিন্তু প্রশ্নপত্র দেখে আমি বজ্রাহত হয়ে গেলাম। হুমায়ূন আহমেদ বা জাফর ইকবালের মত (কার লেখায় যে জীবনের প্রথম ওপেন বুক একজামের কথা পড়েছিলাম!) আমিও চোখ কচলে বুঝতে চাইলাম, এগুলো কী দেখছি? এসব কি আদৌ পড়িয়েছিল? চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা সব অংক দিয়ে ভরা। আইসোটোপ সংক্রান্ত অংক। আমি প্রশ্নই বুঝতে পারছি না, উত্তর কী দেব? একশবারের মত প্রশ্নগুলো পড়ে কয়েকটা যেন হালকা বুঝতে শুরু করলাম। বই, ইউটিউব ভিডিও, ব্লগ, বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ – কিছুই বাদ দিলাম না উত্তর খোঁজার জন্য। টানা চারদিন সংগ্রাম করে তিনটা বাদে সব প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলাম। বুঝলাম, ঐ তিনটার উত্তর আমার পক্ষে খুঁজে বের করা সম্ভব না কারণ আমি হাজারবার পড়েও বুঝতে পারছি না ডঃ উ কী জানতে চাচ্ছেন। হুমায়ূন আহমেদ তার ‘হোটেল গ্রেভার ইন’ বইয়ে লিখেছিলেন, কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে উনার এই হাল হয়েছিল। প্রথম পরীক্ষায় পেয়েছিলেন শূন্য কারণ কিছুই বুঝতে পারেননি। দ্বিতীয় পরীক্ষায় পেয়েছিলেন একশো কারণ অমানুষের মত খেটে নিজে নিজে সবকিছু বুঝেছিলেন। আমি হুমায়ূন আহমেদের মত কেউকেটা হলে হয়ত একশো পাওয়ার মত পরিশ্রম করতাম। কিন্তু সে ইচ্ছে হয়নি, তাই আধাখেঁচড়া পরীক্ষার খাতা জমা দিলাম। ঐ সপ্তাহটা আমার দুই মাসের পিএইচডি জীবনের সবচেয়ে বাজে সময়। বারবার মনে হচ্ছিল প্রাণরসায়নে ফেইল করব। ফেইলের চিন্তায় রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেল। রাতে ঘুমাতে পারি না বলে সকালে ক্লাসে যেতে পারি না। পরপর তিনটা ক্লাস মিস করলাম। মন খারাপের ধাক্কা এসে লাগল এপিডেমিওলজি ক্লাসের কুইজেও। কুইজের জন্য একটা পেপার পড়তে দিয়েছিল। মনোযোগ দিয়ে সেটা পড়িনি বলে তিনটা উত্তর ভুল করলাম। সব মিলিয়ে মনে হতে লাগল, আমার পিএইচডি জীবন শেষ।

হঠাৎ মাথায় এল, সেমিস্টারের ফাইনাল গ্রেড কমপক্ষে ‘বি’ হতে হবে। অর্থাৎ এখনও সময় আছে প্রাণরসায়নের বাকি পরীক্ষাগুলো ভালমত দিয়ে ফেইল থেকে উঠে আসার। অনেক কষ্টে নিজেকে বুঝালাম। ধীরে ধীরে মন স্বাভাবিক হওয়া শুরু করল। এক সপ্তাহ পর যখন প্রফেসর গ্রেড করা উত্তরপত্র ফেরত দিলেন, দেখি ৭৬% নাম্বার পেয়েছি। এটা আমেরিকার মানদণ্ডে ‘সি’ গ্রেড। তারপরও সান্ত্বনা যে, ফেইল করিনি! আমার অ্যাডভাইজর বলেন, ‘কোর্সওয়ার্কে ‘বি’ থাকলেই হল। ‘এ’ পাওয়ার জন্য এগুলোর পিছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট করার দরকার নেই। তুমি বরং গবেষণায় সময় দাও।’ আমি উনার কথা বেদবাক্য হিসেবে নিয়েছি। তবে এটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনি এমন করে নাও ভাবতে পারেন। কিন্তু একটা জিনিস ভেবে আমি চিন্তায় পড়ে গিয়েছি। কোর্সের মিডটার্মে ফেইল করার ভয়ে যদি মন এত বিষণ্ণ হয়ে থাকে, তাহলে আমার প্রজেক্টগুলো ঠিকঠাকমত না চললে কী হবে? আমি কি বেঁচে থাকতে ফাইরবো? নাকি এসব অনুভূতি তখন গা সওয়া হয়ে যাবে?

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
25 %
Excited
Excited
25 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
50 %
Previous post যুক্তরাষ্ট্রে তিন বছর
Next post দুইদিনে লাস ভেগাস এবং গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ভ্রমণঃ পর্ব ৫