1 0
Read Time12 Minute, 59 Second

আমেরিকায় আসার পর থেকেই ভাবছিলাম ক্যাম্পিঙয়ে যাব। ছোটবেলায় মুহম্মদ জাফর ইকবাল আর হুমায়ূন আহমেদের জীবনী থেকে জেনেছিলাম ক্যাম্পিঙয়ের ব্যাপারে। বড় হয়ে বাংলা ব্লগ জগতের সাথে পরিচিত হলাম, পড়লাম প্রবাসে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের কাহিনী। তারা মাঝে মধ্যে ক্যাম্পিং নিয়ে লিখতেন। খুব সম্ভবত ছুটি কাটানোর জন্য ক্যাম্পিং করাটা বাংলাদেশীদের পছন্দ নয়। তাই তেমন বাংলা লেখা পাওয়া যায় না এটা নিয়ে। কিন্তু যতটুকুই পেতাম, ততটুকুতেই আমার মত নাচুনি বুড়ির কানে ঢোলের বাড়ি আসত। এরপর এল সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীরা। ওরা তিন-চারদিনের ছুটি পেলেই ক্যাম্পিং করতে ছুটত। আমেরিকায় সরকারী ছুটিগুলো এমনভাবে ফেলা হয় যেন সপ্তাহান্তের ছুটির সাথে যোগ হয়ে টানা তিন-চারদিন ছুটি পাওয়া যায়। জ্যাকি নামের এক কলিগ ছুটি পেলেই যেত ক্যাম্পিঙয়ে। ফিরে এসে গল্প করত কী কী মজা করেছে। সেগুলো শুনে ক্যাম্পিং নিয়ে আমার ফ্যান্টাসি সাহিত্যের জগত থেকে বাস্তবে নেমে এল। সাথে বাড়ল আগ্রহ। কিন্তু প্রথমবার একা একা যাওয়ার সাহস হচ্ছিল না। ভাবছিলাম আরও দুই-তিনজনের সাথে দল বেঁধে যাব। কিন্তু কাউকেই পেলাম না। ক্যাম্পিং করতে মেলা কিছু লাগে বলে অনেকে আগ্রহ পায় না। এখানে তাবু থেকে শুরু করে বেঁচে থাকার যাবতীয় সরঞ্জাম, সবই নিয়ে যেতে হয়। যদি কষ্ট করে মাটিতে ঘুমাতে পারেন, তাহলে একটা স্লিপিং ব্যাগ হলেই চলে। কিন্তু যদি তোষক ছাড়া না চলে, তাহলে বায়ুতোষক (এয়ার ম্যাট্রেস, যা পাম্প দিয়ে ফুলানো যায়) সাথে নিতে পারেন। আবার গুটিয়ে রাখা যায় এমন চেয়ার (কাপড়ের তৈরি, ধাতুর নয়), আগুন জ্বালানোর সরঞ্জাম (কাঠ, কাঠের পাতলা টুকরো), টর্চলাইট, এলাকাভেদে গরম কাপড় (মরুভূমিতে দিনের বেলা যতই গরম হোক, রাতে ঠাণ্ডা পড়ে), ঠাণ্ডা বা গরম পানির জন্য ফ্লাস্ক, পোকার হাত থেকে বাঁচার জন্য গায়ে মাখার মলম বা স্প্রে, পোকার উপর মারার জন্য স্প্রে (ইন্সেক্ট রিপেলেন্ট), শুকনো খাবার, মুরগী (যদি আগুনে ঝলসে বারবিকিউ করে খেতে চান), ছিপ-বড়শি (যদি টাটকা মাছ ধরে সেটা ঝলসে খেতে চান), ক্যানু বা কায়াক (যদি পানিতে ভেসে বেড়াতে চান), অনেক কিছুই নেওয়া যায়। শেষের দুটো জিনিস অনেক ক্যাম্পিং স্পটে ভাড়া পাওয়া যায়। আগে থেকে খোঁজ নিয়ে যেতে হয়। যা হোক, যেহেতু রবি ঠাকুর বলেছেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে’, তাই ঠিক করলাম নিজেরা নিজেরাই ক্যাম্পিঙয়ে চলে যাব। তিন বছর হয়ে গেছে ল্যান্ড অফ অপরচুনিটিতে। আর দেরি করা যায় না।

এ বছরের (২০২১) মে মাসে জোরেশোরে প্রস্তুতি নিলাম ক্যাম্পিঙয়ের। ভাবলাম গ্রীষ্ম থাকতে থাকতে সেরে আসি। গ্রীষ্ম বা সামারের ছুটিতে ক্যাম্পিঙয়ে যাওয়া আমেরিকানদের অভ্যাস। এজন্য মুখবইয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে অভিজ্ঞদের কাছে পরামর্শও চাইলাম। কী কিনতে হবে, গিয়ে কী করা যায়, কীভাবে আগুন জ্বালাতে হয়, কীভাবে পোকামাকড় খেদাতে হয় বা বন্যপ্রাণীর হাত থেকে নিরাপদে থাকা যায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেকে ভাল কিছু পরামর্শ দিলেন। সে অনুযায়ী জিনিসপত্রের তালিকা বানালাম, অন্তর্জালে খুঁজে খুঁজে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের জিনিসপাতির মধ্যে দাম আর গুণের তুলনা করলাম। প্রস্তুতি অনেকদূর এগোলো, কিন্তু নানা কারণে আমাদের আর যাওয়া হল না। পেন্সিল্ভেনিয়ার বাটলার শহরে থাকতে প্রস্তুতি শুরু করেছিলাম। জুলাইয়ে চলে এলাম টেক্সাসের কলেজ স্টেশনে। অঙ্গরাজ্য বদল করা, নতুন বাসা নেওয়া, নতুনভাবে সংসার পাতা, সবকিছু মিলিয়ে ভাল পরিমাণ টাকা বেরিয়ে গেল। ক্যাম্পিঙয়ের জিনিস কেনার বাজেট রইল না। কিন্তু নভেম্বরে এসে মনে হল আরেকবার চেষ্টা করা যায়। যেই সিদ্ধান্ত, অমনি দৌড় দিলাম ওয়ালমার্টে। অনেক সময় কাজ হতে হয় ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ টাইপ। কত টাকা যাচ্ছে, কত থাকবে হাতে, অতকিছু ভেবে পেছালে আবারও অধরা রয়ে যাবে ক্যাম্পিঙয়ের স্বপ্ন। তাই খুঁজে খুঁজে দামে সাশ্রয়ী, মানে ভাল জিনিস কিনে আনলাম। দুইশোর বেশি ডলার খরচ হয়ে গেল। তাতে কী? এগুলো তো আর একবার ব্যবহার করে ফেলে দিচ্ছি না। বারবার ব্যবহার করা যাবে। দুইশ ডলার উসুল হতে কতক্ষণ? কিন্তু এবারও আমাদের ক্যাম্পিং করা হল না। কেন? কারণ আমরা ক্যাম্পিং করার জন্য রওনা দিয়েছিলাম সাউথ পাদ্রে দ্বীপে। সেখানে সমুদ্র সৈকতে ক্যাম্পিং করার সুযোগ আছে। সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভেবেছিলাম ঢেউয়ের আওয়াজ শুনতে শুনতে রোমান্টিক ক্যাম্পিং হবে। অথচ যাওয়ার পথে শুরু হল ঝড়। যত এগুচ্ছি দ্বীপের দিকে, ততই তীব্র হচ্ছে ঝড়। অবস্থা বেগতিক দেখে ক্যাম্পিঙয়ের চিন্তা ছেড়ে তড়িঘড়ি একটা হোটেলে উঠে গেলাম। দুইদিনের ছুটি নিয়ে গিয়েছিলাম, দুইদিনই তুমুল বাতাস আর বৃষ্টির চোটে হোটেলে থাকতে হল, ক্যাম্পিং হয়ে উঠল না। তবে দ্বীপটা এত সুন্দর! আরও সুন্দর সেখানে যাওয়ার রাস্তাটা। হঠাৎ করেই যেন টেক্সাসের খা খা প্রকৃতি শেষ হয়ে মেক্সিকোর গ্রাম শুরু হয়ে গেল। মনেই হল না আমরা আমেরিকায়, মানে টেক্সাসে আছি। বারবার মনে হল মেক্সিকো চলে এসেছি। হবে নাই বা কেন? দ্বীপের সীমানার শেষেই মেক্সিকোর শুরু।

দক্ষিণ পাদ্রী দ্বীপ থেকে ফিরে আবারও পরিকল্পনা করলাম ক্যাম্পিঙয়ে যাওয়ার। এই বছর শেষ হওয়ার আগে ক্যাম্পিঙয়ে যাবই যাব। জনগণ যাকে দুর্ভাগ্য বলে এবং আমি বলি কাকতাল (আরও সূক্ষ্মভাবে বললে, সম্ভাব্যতা), সে বিষয়টা যতই আমাকে কাবু করার চেষ্টা করুক না কেন, আমি দমব না। সমস্যা হল, শীতকাল চলে এসেছে। আমরা প্রস্তুতি নিয়েছিলাম গ্রীষ্মের ক্যাম্পিঙয়ের। শীতকালের ক্যাম্পিঙয়ে কীভাবে মজা করব, বুঝতে পারছি না। তাই খুঁজতে লাগলাম লগ কেবিন বা কাঠের তৈরি ছোট কেবিন। বনের ভেতর এরকম ছোট ছোট কাঠের ঘর ভাড়া পাওয়া যায়। আমার এক বন্ধু কিছুদিন থেকে এসেছিল। তার অভিজ্ঞতা খুবই ভাল। সে বিবেচনায় আমরাও চেষ্টা করলাম লগ কেবিন ভাড়া নেওয়ার। এ ধরনের ক্যাম্পিংকে বলে গ্ল্যাম্পিং। জানতাম না এই নামে কোনো জিনিস আছে। পরে দেখি তাবু খাঁটিয়ে ক্যাম্পিং করাকে বলে টেন্ট ক্যাম্পিং, আর কেবিনে থেকে ক্যাম্পিং করাকে বলে গ্ল্যাম্পিং। তাবুতে থাকলে একদম প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়। কিন্তু কেবিনে থাকলে বিছানা পাবেন, মাথার উপর শক্ত ছাদ পাবেন আর চারপাশে পাবেন শক্ত দেওয়াল। অর্থাৎ নিরাপত্তা বেশি। তাই এর গালভরা নাম দেওয়া হয়েছে গ্ল্যামারাস ক্যাম্পিং ওরফে গ্ল্যাম্পিং। নামকরণের সার্থকতা বুঝানোর জন্যেই যেন একেক রাতে কেবিন ভাড়া চাচ্ছে দেড়শ থেকে দুইশ ডলার। হলিডে সিজনের কারণে দাম বেড়ে গেছে। ওগুলো থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। খুঁজতে বসলাম গরিবী চালের কেবিন। লগ বা কাঠের কেবিন আমাদের লাগবে না। এসবেস্টস বা মাটির থাকলে সেটাই নেব। শেষমেশ অনেক খুঁজে প্রিন্স কলেজ স্টেশন থেকে তিন ঘণ্টা দূরে একটা স্টেট পার্ক পেল যেখানে সস্তা কেবিন আছে। দ্রুত বুক করে ফেললাম দুই রাতের জন্য। পার্কের নাম ইঙ্কস লেক স্টেট পার্ক। ছোটখাট একটা হ্রদকে ঘিরে গড়ে উঠেছে উদ্যানটা। টেক্সাসে পানির দেখা পাওয়া আনন্দের বিষয় বলে হ্রদের ধারে কেবিন পেয়ে খুশিতে আটখানা হয়ে গেলাম।

ছুটিতে যাব বলে সব কাজ গুছিয়ে নিচ্ছি। অ্যাডভাইজরের সাথে দুই ঘণ্টা করে টানা চারদিন মিটিং চলল। মিটিংয়ের ধাক্কায় কাজ অনেকটা এগোলো। তবে বড়দিনের ছুটিতে যাওয়ার আগে উনি একগাদা নতুন কাজ ধরিয়ে দিলেন। আমি বড়দিন উপলক্ষ্যে চারদিন ছুটি নিয়েছি। এরপর এসে আবার কাজ। সমস্যা নেই, জানতাম পিএইচডিতে এরকম হবে। প্রফেসর নিজেও ডিসেম্বরর চব্বিশ তারিখ পর্যন্ত কাজ করবেন। উনার কথা শুনে মনে হল, আমি কী ছার! উনাকে বড়দিন, নতুন বছর, সবকিছুর জন্য অগ্রিম শুভেচ্ছা জানিয়ে রওনা দিলাম গ্ল্যাম্পিঙয়ের উদ্দেশ্যে। চালকের আসনে প্রিন্স, যাত্রীর আসনে আমি। ঘোড়া দেখলে মানুষ খোঁড়া হয়ে যায়। আমি তাই প্রিন্সের উপর গাড়ি চালানোর ঝামেলা চাপিয়ে খোঁড়া হয়ে বসে আছি। ড্রাইভিং লাইসেন্স করার প্রয়োজন অনুভব করছি না। সব কাহিনীতে আমাকে তাই যাত্রী হিসেবে দেখা যায়। আমাদের গাড়ি বোঝাই ক্যাম্পিঙয়ের জিনিসপাতি। মুরগী মেরিনেড করে নিয়ে যাচ্ছি। কেবিনের সাথে বারবিকিউ গ্রিল আছে। সেখানে ঝলসে কাবাব বানাব। সাথে নিয়েছি ভাজা পরোটা। রসিয়ে চা খাওয়ার জন্য ফ্লাস্ক, চা-পাতা, চিনি নেওয়া হয়েছে। আয়েশ করে পড়ার জন্য নিয়েছি দা লর্ড অফ দা রিংসের প্রথম খণ্ড। বোকাবাক্সের পর্দায় হ্যারি পটার, গেম অফ থ্রোন্স কিংবা লর্ড অফ দা রিংস দেখা হলেও আমার পড়া হয়নি মূল উপন্যাসগুলো। বুকশেলফে পড়ে আছে অথচ পড়া হয় না।

দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব, চতুর্থ পর্ব

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
100 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post পিএইচডি দিনলিপি – ৭ (হিজিবিজি)
Next post প্রথম গ্ল্যাম্পিং এবং দীর্ঘশৃঙ্গ গুহা (পর্ব ২)