এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো, বারো, তেরো, চৌদ্দ, পনেরো, ষোল, সতেরো, আঠারো, ঊনিশ, বিশ
অনেকদিন ব্লগে লেখালেখি নেই। নিশ্চয় বুঝে গেছেন নিতম্ব দিয়ে লাল, নীল সুতো বের হচ্ছে? সত্যি বলতে, গত ছয় মাসের মধ্যে ২০২২ সালের জানুয়ারিতেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি মাথা পাগল লেগেছে। একমাসের মধ্যে অনেকগুলো জায়গায় ভিক্ষার আবেদন করেছি। বেশিরভাগই জানুয়ারির ৩১ তারিখে ডেডলাইন দিয়ে রেখেছে। ভিক্ষা মানে বৃত্তির আবেদন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় বৃত্তি, অনুষদের বৃত্তি, ব্যক্তিমালিকানাধীন বৃত্তি – বাদ যায়নি একটা কিছুও। এসব জায়গায় শুধু নীল কাগজে প্রেম পত্র (কেন আপনি এই বৃত্তির জন্য আবেদন করছেন, আপনার জীবনের দুঃখের কাহিনী, কীভাবে এই বৃত্তি আপনার পড়াশোনায় সাহায্য করবে, ইত্যাদি ইত্যাদি) লিখে পাঠালেই হয় না, রিসার্চ অ্যাডভাইজরের কাছ থেকে রেকোমেন্ডেশন নিয়ে সেটাও পাঠাতে হয়। আমার অ্যাডভাইজর সবসময় আমাকে দিয়ে একটা খসড়া চিঠি লেখান। সেখানে দাপ্তরিক ভাষায় নিজের গুণকীর্তন লিখে উনাকে পাঠাই। উনি সে খসড়ার উপর কাটাছেঁড়া করে, নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা যোগ করে চূড়ান্ত চিঠি দাঁড় করান। আমি সবসময় নিজের অবদানের ব্যাপারে সৎ থাকার চেষ্টা করি। তাই উনার কাটাছেঁড়া মূলত চিঠির ভাষার উপর দিয়ে যায়। শেষমেশ যেটা দাঁড়ায়, সেটা আর আমার লেখা থাকে না। দশ শতাংশ আমার হলে নব্বই শতাংশ উনার। তারপরও উনি সবসময় আমাকে দিয়েই খসড়া করান। উনার ধারণা এতে আমার লেখালেখির ধার বাড়বে। একাডেমিক জগতে প্রচুর লেখালেখির বালাই। গ্র্যান্ট লিখবেন, ভিক্ষার জন্য আবেদন করবেন, গবেষণাকর্মের পাণ্ডুলিপি লিখবেন, বিভিন্ন কনফারেন্সের জন্য অ্যাবস্ট্রাক্ট লিখবেন, এসাইনমেন্ট করবেন, অনেক পদের এবং অনেক ধরনের মানুষকে ইমেইল লিখবেন; তাই লেখালেখিতে দক্ষ হওয়া চাই। প্রফেসর জন্সটন ভাবেন নিজের রেকোমেন্ডেশন লেটারের খসড়া করতে করতে আমি একদিন জে কে রোওলিং হব। কে জানে, হতেও পারি জে কে রোওলিং লাইট! ভাবছেন একই রেকোমেন্ডেশন লেটার কেন বিভিন্ন জায়গায় পাঠাই না? পারলে তাই করতাম। কে চায় বারবার মাথা খাটিয়ে রচনা লিখে সেটাকে নির্দয়ভাবে লালকালিতে চুরমার হতে দেখতে? কিন্তু সমস্যা হল, একেক জায়গায় একেক কারণে বৃত্তি দেয়। তাই চিঠির কথাও পাল্টে যায়। মূল গুণকীর্তন বজায় রেখে হর্তাকর্তাদের চাহিদা অনুযায়ী আপনার অভিজ্ঞতার কথা পালটাবে, গবেষণার কথা পালটাবে। তাই একই টেম্পলেট ব্যবহার করে বারবার লিখতে হয়।
পিএইচডি করার সময় ভিক্ষাবৃত্তির পাশাপাশি আরেকটা বিষয়ের দিকে নজর দিতে হয়। উঁহু, গবেষণার কথা কইছি না। সেটা কয়েকমাস পর হাগুমুতুর মতই প্রাকৃতিক বিষয় হয়ে যায়। কইছি নিজেকে পেশাগতভাবে দক্ষ করে তোলা নিয়ে। একে বলে প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট। আমি যেহেতু প্রমাণভিত্তিক পুষ্টিবিজ্ঞান এবং সিস্টেম্যাটিক রিভিউ মেথডোলজি নিয়ে কাজ করি, তাই এই দুই জায়গায় আমাকে দক্ষ হতে হবে। এজন্য টুইটার আর লিংকডিনে এই সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুসরণ করি। এভাবেই একদিন দেখলাম ইউএস গ্রেড নেটওয়ার্ক একটা ভার্চুয়াল ওয়ার্কশপের আয়োজন করতে যাচ্ছে। এই সংস্থাটি আমার গবেষণার ক্ষেত্রে বেশ কেউকেটা। ওদের ওয়ার্কশপে নিবন্ধন করতে হলে আটশো ডলার গুনতে হবে। অংক দেখে মন খারাপ হল। পঞ্চাশ ডলার হলে নিজের পকেট থেকে দিয়ে হলেও ওয়ার্কশপটা করতাম। কিন্তু আটশো ডলার মানে কিডনি বেচতে হবে। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে দেখি ওরা তিনটা স্কলারশিপের ব্যবস্থা রেখেছে। যে কেউ সেগুলোর জন্য আবেদন করতে পারবে। যদি স্কলারশিপ পাই, তাহলে নিবন্ধন করতে কোনো টাকা লাগবে না। আবেদন করার জন্য কভার লেটারের সাথে অ্যাডভাইজরের রেকোমেন্ডেশন লেটারও পাঠাতে হবে। আমি প্রফেসরকে গিয়ে ঘটনা খুলে বললাম। প্রফেসর খুশী হয়ে বললেন, “অবিশ্যি দেব! তুমি যে প্রোএকটিভ হয়ে সুযোগটা খুঁজে এনেছ, এতে আমি মুগ্ধ।” সুতরাং যারা পিএইচডিতে ঢুকতে চাচ্ছেন, এইবেলা প্রোএকটিভ হওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলুন। আমি প্রফেসরকে যে খসড়া রেকোমেন্ডেশন লেটার পাঠালাম, সেটা উনি সংশোধন করে ফেরত দিলেন। পড়ে দেখি উনি আমার আরও দুটো অবদানের কথা যোগ করেছেন। একদম ভুলে গিয়েছিলাম ওগুলো লেখার কথা। পড়ার পর কিছুক্ষণ থ মেরে রইলাম। বাংলাদেশে থাকতে একটা রেকোমেন্ডেশন লেটারের জন্য কী না করেছি! শিক্ষকদের পিছু পিছু ঘুরেছি, উনাদের বাসা পর্যন্ত গিয়েছি, কত তেল মেরেছি! অথচ যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রফেসরের পিছু ঘোরা ছাড়াই, উনাকে তেল দেওয়া ছাড়াই উনি আমার গুণগান গেয়ে বিশাল সব লেটার দিচ্ছেন, নিজের স্মৃতি হাতড়ে দুটো কথা বেশি লিখছেন। এটা শুধু আমার পিএইচডি মেন্টর বলে নয়, মাস্টার্সের (যুক্তরাষ্ট্র থেকে যেটা করেছি) শিক্ষকদের কাছেও যখনই রেকোমেন্ডেশন লেটার চেয়েছি, উনারা ভাল কথা লিখেছেন। আমার বর্তমান অ্যাডভাইজর অ্যাডমিশনের আগে যখন আমার ইন্টার্ভিউ নিচ্ছিলেন, তখন বলেছিলেন, “তোমার মাস্টার্সের সুপারভাইজরের লেটার পড়ে আমি মুগ্ধ।”
যা হোক, শেষ পর্যন্ত আমি স্কলারশিপটা পেয়েছিলাম। গতকালই এক্সটেন্সিভ ওয়ার্কশপটা শেষ করেছি। সেখানে আমার বর্তমান গবেষণার উপর ভিত্তি করে একটা পোস্টারও উপস্থাপন করেছি। বিখ্যাত সব গবেষকদের কাছ থেকে সিস্টেম্যাটিক রিভিউ মেথডোলজি সম্পর্কে শিখেছি, তাদের সাথে মত বিনিময় করেছি। আমি আগে প্রচণ্ড লাজুক ছিলাম। মাথায় প্রশ্ন আসলেও মুখ ফুটে বলার সাহস পেতাম না। প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলেও ঘরভর্তি অচেনা মানুষের সামনে সেটা বলতে পারতাম না। যুক্তরাষ্ট্র আমাকে বদলে দিয়েছে। এখানকার লেখাপড়ার সিস্টেম আমাকে অনেক স্মার্ট করেছে। কেউ যেহেতু আমার উত্তর শুনে হাসাহাসি করবে না বা আমার প্রশ্নকে “কী বোকার মতো প্রশ্ন!” বলে লজ্জা দেবে না, তাই আমি এখন উত্তর দিতে বা প্রশ্ন করতে লজ্জা পাই না। এজন্য বাঘা বাঘা গবেষকদের ইচ্ছেমত প্রশ্ন করেছি। তাদের করা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। কখনো সঠিক হয়েছে, কখনো ভুল। কিন্তু তাতে কেউ বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলেনি, “পিএইচডি করছ, তাও এই উত্তর জান না?” মনে রাখবেন, আপনি সবজান্তা নন। এমনকি আমার অ্যাডভাইজরও সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না। মাঝে মাঝে আমিই উনাকে নতুন জ্ঞান দিই। আমার ক্লাসের ছেলেমেয়েগুলো হঠাৎ এমন প্রশ্ন করে, যেটার উত্তর আমার জানা থাকে না। তখন বলি, “আমি উত্তরটা জেনে তোমাকে জানাব।” না জানার মধ্যে লজ্জা নেই। অন্তত আমেরিকার একাডেমিয়াতে এটা দেখছি। সবাই হয়ত এভাবে ভাবে না, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই এমন।
সামনের সামারে আসছে আরেকটা ওয়ার্কশপ, কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে। এটার খরচ আমার অ্যাডভাইজর বহন করছেন। আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়া সব উনার ফান্ড থেকে আসবে। কানাডায় যাওয়ার জন্য আমাকে ভিজিটর ভিসার আবেদন করতে হবে। গেলাম নির্ধারিত ওয়েবসাইটে। কত যে লিংক সেখানে! এক লিংকে ক্লিক করলে পাঠায় আরেক লিংকে। সেই লিংকের রচনা পড়া শেষ হলে যেতে হয় আরেক লিংকে। অনেকগুলো পেইজ পড়া শেষে বুঝলাম আমাকে একাউন্ট খুলে ফরম পূরণ করতে হবে। সেই ফরম আবার বাংলাদেশ টু কানাডা সমান লম্বা। তাতে যুক্ত করতে হবে ইনভাইটেশন লেটার। ম্যাকমাস্টারে ইমেইল দিয়ে লেটার চাইলাম। সেই লেটার যোগ করে অবশেষে ফর্মের শেষ পৃষ্ঠায় আসার অনুমতি পেলাম। খালি বুঝলাম না আমাকে কেন গত দশ বছরের ফিরিস্তি দিতে হল। কোথায় কোন চাকরি করেছি, অফিসগুলোর ঠিকানা, বেকার থাকলে কবে থেকে কবে পর্যন্ত ছিলাম, ইত্যাদি। আমি ২০২০ সালে মাস্টার্স পাশের পর সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানাই ভুলে গেছি। সেখানে ২০১৮ সালে ছেড়ে আসা দেশী অফিসের ঠিকানা মনে থাকবে? যা হোক, এরপরের ধাপ বায়োমেট্রিক্স দেওয়া। এই ধাপের জন্য যেতে হবে হিউস্টন। যদি ভালোয় ভালোয় ভিসাটা পেয়ে যাই, সেটা এক বছরের জন্য বলবত থাকবে। কানাডায় পড়তে যাওয়ার খুব শখ ছিল। সে শখ পূরণ করতে হবে ওয়ার্কশপ দিয়ে। সাতদিনের সফরে এবার হয়ত টরোন্টো শহরের বাইরে যাওয়া হবে না, তবে কোনো এক গ্রীষ্মে আমি অ্যালবার্টা প্রদেশের বানফ জাতীয় উদ্যানে যাব। এটার ছবি দেখে মাথা নষ্ট, ম্যান! আমার সংক্ষিপ্ত তালিকায় আরও আছে ইতালি, সুইটযারল্যান্ড, আলাস্কা, ভারতের কিছু জায়গা (সিমলা, মানালি, রাজস্থান, কাশ্মীর), নেপাল, চিলি আর অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটা জাতীয় উদ্যান। দেখি কতগুলোয় যেতে পারি। আমরা দুজনই খুব চেপেচুপে চলি যেন ঘুরে বেড়ানোর জন্য কিছু টাকা জমাতে পারি। আশি বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকলে নিশ্চয় সবগুলো জায়গায় পা দিতে পারব। আপনারাও পারবেন যদি প্রচণ্ড ইচ্ছে থাকে এবং সেই মত স্টেপ নেন।