1 0
Read Time12 Minute, 0 Second

এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো, বারো, তেরো, চৌদ্দ, পনেরো, ষোল, সতেরো, আঠারো, ঊনিশ, বিশ

এখন বাজে ভোর সাড়ে চারটা। কেন এতো সকালে উঠে বসে আছি সেটা বলি। গতকাল বিকেলে বাজার সদাই করতে বের হয়েছিলাম। পাঁচটার দিকে আমি আর প্রিন্স হাঁটতে হাঁটতে গেলাম রস নামের একটা জামার দোকানে। এটাকে আমেরিকার বঙ্গবাজার বলা যায়। শুধু এটা না, যুক্তরাষ্ট্রে আরও অনেক দোকান আছে যেখানে মূল দামের অর্ধেকে বা তারচেয়েও কমে জিনিসপত্র বিক্রি করা হয়। আমাদের মতো ফকির মিসকিনদের জন্য স্বর্গরাজ্য। সেখানে গিয়েছিলাম হোলি উপলক্ষ্যে একটা সাদা টিশার্ট কিনতে। জীবনের প্রথম হোলি উৎসবে যাবো। দেশে থাকতে দেশীয় ঐতিহ্য পালনের সুযোগ হয়নি, এখন বিদেশে এসে করছি বলে প্রিন্স খানিকক্ষণ পচালো। তো, টিশার্ট কিনে মনে হলো এইচইবি থেকে একটু মুদিবাজার সেরে যাই। এইচইবি হলো টেক্সাসের আঞ্চলিক মুদি দোকান বা চেইন গ্রোসারি স্টোর। প্রতিটা অঙ্গরাজ্যের নিজস্ব মুদি দোকান আছে। ওয়ালমার্ট হলো সার্বজনীন। সব স্টেটেই আছে। কিন্তু এইচইবি শুধু টেক্সাসের। এভাবে পেনসিলভেনিয়ায় থাকতে পেয়েছিলাম জায়ান্ট ঈগল আর মিজৌরিতে শ্নাক্স। কিছু ক্ষেত্রে আশেপাশের কয়েকটা অঙ্গরাজ্য মিলে একটা আঞ্চলিক মুদি দোকান চালায়। তাই জায়ান্ট ঈগল আপনি ওহাইও, মেরিল্যান্ড আর ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতেও পাবেন। আচ্ছা, জ্ঞানদান শেষ। এবার আসল গল্প। এইচইবি থেকে একটা বেগুন, দুটো আম (ঠিক শুনেছেন… আম! টেক্সাসের সীমানা ঘেঁষেই যেহেতু মেক্সিকো, সেখান থেকে আম আসে। স্বাদে দেশী আমের কাছাকাছি), একটা পেঁয়াজ আর দুই প্যাকেট বিস্কুট কিনে বের হলাম। দেশের মানুষ একটা পেঁয়াজ, একটা বেগুন, একটা আলু কেনার কথা চিন্তা করতে পারে না। উল্টো কলকাতার দাদা দিদিদের পচায় এক পিস মাছ কেনে বলে। অথচ বাজারের ধরন এমনই হওয়ার কথা। যতটুকু লাগবে, ততটুকুই কিনবো। বেশি বেশি কিনে ফ্রিজে ফেলে রেখে শেষে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে মারা কোনো কাজের কথা নয়। যা হোক, বাসায় ফিরে গুগল ফিট চেক করে দেখি সাড়ে ছয় হাজার পা হাঁটা হয়েছে। আমি প্রতিদিন পাঁচ হাজার পা হাঁটার লক্ষ্য সেট করে রেখেছি, হয়ে উঠে না। আজ হয়েছে দেখে ফুরফুরে মন নিয়ে ল্যাপটপ খুলে রিসার্চ প্রজেক্ট নিয়ে বসলাম। একটু পর দেখি ঘুমে ঢলে পড়ছি। রাতের খাবারকে গুল্লি মেরে সটান বিছানায় গিয়ে পড়লাম। কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম, জানি না। একটু আগে ঘুম ভাঙলো। আট ঘণ্টা ঘুমিয়েছি বলে শরীর ঝরঝরে লাগছে। আর বিছানায় পড়ে থাকার মানে নেই বলে উঠে এলাম। মনে হলো অনেকদিন লেখালেখি করি না। তাই বসলাম ব্লগ নিয়ে।

ইদানীং ঘুমের টাইম টেবিল একেবারেই ঠিক নেই। কোনোদিন রাত তিনটায় ঘুমিয়ে সকাল নয়টায় উঠি, কোনোদিন বারোটায় ঘুমিয়ে ছয়টায়। পিএইচডি জীবন মনে হয় এরকমই। আরও অনেকের কাছ থেকেই ঘুমের ওলটপালট হওয়া নিয়ে শুনেছি। মাথায় অনেক দুশ্চিন্তা ঘুরে বলে ঘুমটা ঠিকমতো হতে চায় না। এখানে অন্যের “যত যাই হোক, আট ঘণ্টা ঘুম ঠিক রাখবা” ধরনের পরামর্শে লাভ হয় না। আপনার ঘুম আপনার কাছে। এটা নিয়ন্ত্রণের উপায়ও আপনার হাতে। অন্যের ঘুমের সাথে তুলনা করে নিজে অসন্তুষ্টিতে ভুগার মানে নেই। আমার কিছু বেসিক সায়েন্টিস্ট বন্ধু আছে। ওদের মধ্যে তিনজনকে দেখি ল্যাব এক্সপেরিমেন্ট শুরু করে বিকেল নাগাদ, সারা রাত ডিপার্টমেন্টে কাটায়, ভোরের দিকে বাসায় ফেরে। ঘুম টুম দিয়ে দুপুর দুইটা নাগাদ আবার ডিপার্টমেন্টে আসে, শুরু করে এক্সপেরিমেন্ট। বাকি দুইজনকে দেখি সকাল নয়টা নাগাদ ডিপার্টমেন্টে আসে, সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ ল্যাব এক্সপেরিমেন্ট গুছিয়ে বাসায় চলে যায়। এই যে পুরো স্কেজিউল, এটা আপনার উপর। কোন সময় কাজ করলে আপনার প্রোডাক্টিভিটি বাড়বে, ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে পারবেন, কোলাবরেশনের জন্য মানুষ পাবেন, সব চিন্তা করে স্কেজিউল সাজাতে হয়। এখন যদি বলতে আসেন “ঘুমের নিয়ম হলো রাত দশটার মধ্যে বিছানায় যাওয়া, ভোর ছয়টার মধ্যে উঠে পড়া”, তাহলে তো সমস্যা! যে যেভাবে স্বস্তি অনুভব করে, তাকে সেভাবেই থাকতে দেওয়া উচিৎ। আমি যেমন গবেষণা নিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা পড়ে থাকতে পারি না। গড়ে দুই ঘণ্টা আমার যায় পছন্দের বই পড়তে পড়তে, বা টিভি শো দেখতে দেখতে, বা লেখালেখি করতে করতে। এখনো প্রথম বর্ষে বলে এতটা ছাড় নিজেকে দিতে পারি। দ্বিতীয় বর্ষ থেকে গবেষণার চাপ আরও বাড়বে। তখন সুবিধা অনুযায়ী বিনোদনের ব্যবস্থা করে নেবো। এখন যদি কেউ বলে, “নির্ঝর তো কোনো পিএইচডি স্টুডেন্টই না! অন্যরা যেখানে প্রজেক্ট নিয়ে দম ফেলার সুযোগ পায় না, সেখানে ও দুই ঘণ্টা আলতু ফালতু কাজ করে”, আমি তাকে স্বাগত জানাই। সত্যি বলতে, এখনো পর্যন্ত পিএইচডিটা ট্র্যাকে আছে। একসাথে আমার তিনটা প্রজেক্টে কাজ করছি। চতুর্থ একটা প্রজেক্টে কোলাবরেট করছি। তার মানে দুই-তিন ঘণ্টা ধরে নিজেকে বিনোদিত করলেও কাজের জায়গায় ঠিক আছি।

আরও কী করছি, শুনবেন? কথাগুলো বলা দরকার ভবিষ্যতে যারা আসবে পিএইচডি করতে, তাদের অনুপ্রাণিত করার জন্য। টামুতে স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের যে সংগঠন আছে, সেখানে আমি সিনেটর হিসেবে আছি। কেন এখানে যোগ দিয়েছিলাম, বলি। আমি খুবই মুখচোরা মানুষ। কিন্তু একাডেমিতে সফল হতে চাইলে মুখচোরা হলে চলে না। মানুষের সাথে কথা বলতে হয়, নিজেকে উপস্থাপন করতে হয়, অন্যকে কনভিন্স করতে হয়। এসব আপনি কীভাবে শিখবেন? শিখবেন অন্যের সাথে মেলামেশা করে। তাই একজন সিনেটর হয়ে অন্য সিনেটরদের সাথে মেলামেশার মাধ্যমে মুখচোরা ভাবটা ভাঙার চেষ্টা করছি। আরও সুবিধা আছে গভর্নমেন্ট বডির সাথে যুক্ত থাকার। কয়দিন আগে আমরা ট্রাভেল অ্যাওয়ার্ডের জন্য জমা হওয়ার আবেদনগুলো যাচাই বাছাই করলাম। এটা করতে গিয়ে গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের লেখা আবেদন সম্পর্কে আমার জ্ঞান হলো। এরা কতোটা পেশাদারভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারে, কতোটা বিক্রি করতে পারে নিজের প্রোফাইলকে, সেটা জানলাম। তারপর বিচারক হিসেবে অংশ নিলাম স্টুডেন্ট রিসার্চ উইকে। আন্ডারগ্র্যাড শিক্ষার্থীদের গবেষণা বিচার করলাম। এগুলো করতে গিয়ে মানুষের কাজ বিচার করার একটা দক্ষতা তৈরি হচ্ছে নিজের মধ্যে। এটা খুবই জরুরী। আমি যেহেতু টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট, তাই শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারাটা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যতই আমি এসব কাজে অংশ নেবো, ততই আমার ইন্দ্রিয় প্রখর হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এসব অভিজ্ঞতা আপনার সিভিকেও মজবুত করবে।

দুইদিন আগে গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের সম্মানে টামুতে আয়োজিত হলো ‘ডিনার অ্যান্ড ডায়ালগ’ অনুষ্ঠানটি। সেখানেও অংশ নিলাম। উদ্দেশ্য ছিলো অন্য গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের সাথে পরিচিত হওয়া। মোট কথা, নিজের কম্ফোর্ট জোন ভাঙা। যারা নিবন্ধন করেছিলো, সবাইকে নির্দিষ্ট টেবিল ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমার পড়লো টেবিল নং ষোল। গিয়ে দেখি ওই টেবিলের ছয়জন শিক্ষার্থীই এশিয়ান। দুইজন ভারতীয়, দুইজন নেপালি, একজন জাপানী, এবং আমি বাংলাদেশী। টেবিলে যে অধ্যাপক মডারেটর হিসেবে ছিলেন, তিনি কানাডীয়। ব্যাপার দেখে একচোট হাসাহাসি হলো। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র যে কতখানি মাল্টিন্যাশনাল, আরেকবার প্রমাণিত হলো। মুহম্মদ জাফর ইকবাল আশির দশকে যে পরিস্থিতি দেখেছিলেন, এখনো সেই পরিস্থিতি বহাল। বলা যায় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের আনাগোনা আরও বেড়েছে। বিশেষ করে এশিয়া থেকে আসা প্রচুর শিক্ষার্থী আমি টামুতে দেখি। শুধু টামু কেন, সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়েও যেদিকে তাকাতাম, এশিয়ান দেখতাম। মজাই লাগে। ভারত আর নেপালের শিক্ষার্থীরা আগামী শনিবার হোলি উৎসবের আয়োজন করেছে ভার্সিটিতে। বায়োস্ট্যাটিস্টিকসের ক্লাস করতে গিয়ে অলকা নামের এক ভারতীয় মেয়ের সাথে আমার পরিচয়। পেশায় ও দন্ত চিকিৎসক। টামুতে এসেছে এপিডেমিওলজির উপর মাস্টার্স করতে। প্রচণ্ড মেধাবী। ক্লাসে যা শিখি, ওর কাছ থেকে তারচেয়ে বেশি শিখি। ওর সাথেই হোলি উৎসবে যাবো। ওর পরামর্শেই সাদা টিশার্ট কিনেছি। সেটা কিনতে গিয়েই গতকাল রসে গেলাম। তারপর… তারপর এই ব্লগের উৎপত্তি!

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
100 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post পিএইচডি দিনলিপি – ৮
Next post পিএইচডি দিনলিপি – ১০