1 0
Read Time11 Minute, 56 Second

এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো, বারো, তেরো, চৌদ্দ, পনেরো, ষোল, সতেরো, আঠারো, ঊনিশ, বিশ

ইদানীং মাথা এতো আউলে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রোজেক্টের হাইড্রেশনে! যারা হাইড্রেশন বাংলা জানেন না, তারা অভিধান ঘেঁটে মানে বের করে ‘সো’-এর জায়গায় ‘চো’ বসিয়ে নিন। আমি ঝামেলা পোহাচ্ছি, আপনি কেন ঝামেলা করে মানে জানবেন না? বাঙালি নরকে গেলে অন্যদেরও টেনে নামায়। আমার অবস্থাও সেরকম। ইচ্ছা করে এতগুলো প্রোজেক্টে জড়িয়েছিলাম। দ্রুত কিছু পেপার পাব্লিশ করে জাঁকালো প্রোফাইল বানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওই যে, ‘কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়’ বা ‘গ্রেট বিউটি কামস উইথ গ্রেট প্রাইস’। শেষেরটা কি আদৌ আছে নাকি আমি বানালাম, বুঝতে পারছি না। গত দুই মাসে এতো ঘটনা ঘটেছে যে, কোনটা রেখে কোনটা লিখবো ভেবে কিছুই লেখা হয়নি। কলোরাডোর রকি মাউন্টেইন, কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয় আর ওয়াশিংটন ডিসি থেকে ঘুরে এলাম, অথচ আমার মত লেখাপাগল মানুষ সেগুলো নিয়ে কিছুই লিখলো না। এমম… কিছু লিখিনি বললে ভুল হবে। লিখেছি, কিন্তু সেটা ব্লগ পোস্ট নয়, একটা উপন্যাস। উপন্যাসটা লেখা শুরু করেছিলাম চার-পাঁচ বছর আগে। শেষই হচ্ছিলো না। ভালো লাগে না, বিরক্ত লাগে, সময় নেই, কাহিনী মিলে না…। শেষে বুঝলাম, এখনই যদি শেষ না করি, এই উপন্যাস আর ইহজনমে শেষ হইবে না। তাই রুটিন করে লেখা শুরু করলাম। লেখালেখি অভ্যাসের ব্যাপার। প্রতিদিন লিখলে হাতে তরতর করে লেখা আসে। নতুবা কম্পিউটারের পর্দায় হা করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। লেখা শেষ করে একটা প্রকাশনীর কাছে পাঠিয়ে দিলাম, এরপর শান্তি পেলাম। সে প্রকাশনী এখনও কোনো উত্তর দেয়নি। আরে বাবা, বাতিল করে দিলে সেটাও তো জানাবি? সায়েন্টিফিক জার্নালগুলোও তো এইটুকু সৌজন্যতা করে!

পাহাড়ি এলাকায় বনের ভেতর কাঠের বাড়ি। ইয়াম ইয়াম!

আমার প্রায়ই এমন সময় আসে যখন কোনো কাজ করতে ভালো লাগে না। না মুভি-সিরিজ দেখতে, না গবেষণা করতে, না লেখালেখি করতে। টানা কয়েকদিন চলে ওই ঝিম ধরা ভাব। বয়স যতো বাড়ছে, ঝিমুনির হারও বাড়ছে। প্রতি মাসেই নিয়ম করে মনে হয় সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে বনবাসী হয়ে যাই। ইউরোপের কোনো পাহাড়ি অঞ্চলে কাঠের বাড়ি বানিয়ে থাকি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ইউরোপে ঘাঁটি গাড়া হবে না। দ্বিতীয় পছন্দ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রই সই। যেখানেই থাকি না কেন, আমার দরকার আততায়ীর হাতে খুনের শিকার না হয়ে ঝামেলাবিহীন জীবন কাটানো। প্রিন্স একটা গেইম খেলে ‘স্টারডিউ ভ্যালি’ নামে। ওই গেইমের মত ছোট্ট একটা বাড়ি বানিয়ে শহরের বাইরে ছোট্ট লোকালয়ে চাষাবাদ করে জীবন কাটিয়ে দেওয়াটাই আমার ধ্যান জ্ঞান। তবে এই চিন্তাই আজকালকার যুগে অবাস্তব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন শহরে বাস করা যতোটা না সহজ, গ্রামে গিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটানো ততোটাই মুশকিল। তারপরও নিজেকে বস্তুগত জীবনের লোভ থেকে অনেকখানি দূরে সরাতে পেরেছি। বাকিটুকুও আগামী দশ বছরে হয়ে যাবে। তখন জমানো টাকা নিয়ে দৌড় দেবো পাহাড়ের ভেতর। বই পড়বো, সবজি ফলাবো, মাসে একবার শহরে এসে কেনাকাটা করে যাবো। আহ! চিন্তা করেই লোল ঝরছে। লাভ অ্যাকচুলি মুভিটা দেখেছেন? সেখানে কলিন ফার্থ যে প্রেমিকার সাথে বিচ্ছেদের পর শহর থেকে দূরে একটা কাঠের বাড়িতে লেখালেখি করতে যায়, মনে আছে? ২০০৪ সালে এই মুভি দেখার পর থেকেই সম্ভবত আমার মাথায় লেখালেখির সাথে কাঠের বাড়ি আর গ্রামাঞ্চল ঢুকে গেছে।

এটা ঠিক, শুধু জনমানববর্জিত নির্জন পাহাড়ে বাস করাই আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়। আরও কিছু লক্ষ্য আছে। যেমন, লেখালেখি করা, বিশ্ব ভ্রমণ করা। অন্তত চার পাঁচটা উপন্যাস লিখে মরতে চাই। যবে থেকে নিজের প্যাশন বুঝতে শিখেছি, তবে থেকে জানি লেখালেখি আর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণই আমার সবচেয়ে প্রিয়। মাথায় বিস্তর কাহিনী নিয়ে ঘুরি, ভাবি সময় পেলেই কেল্লা ফতে। কিন্তু দশটা-পাঁচটা চাকরি জীবন সয়ে (পিএইচডির ক্ষেত্রে অনেক সময় সারাদিনই কাজ করতে হয়) সৃজনশীল কাজের জন্য সময় বের করা খুব কঠিন। কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। আবার সময় বের করলেও অতোটুকু সময়ের মধ্যে মানসম্পন্ন কাজ করতে পারবেন, তার নিশ্চয়তা নেই। একটা কাজ করলেন অথচ সেটা মানসম্পন্ন হলো না, তাহলে সন্তুষ্টি আসবে না।

গ্রিসের ক্রিট দ্বীপ। গ্রিক পুরাণে মিনোটরের কাহিনী পড়েছেন না? এই দ্বীপেই তো বন্দী ছিলো সে।

হুমায়ুন আহমেদ শেষদিকে যা করে গেছেন, সেটা তড়িঘড়ি করে করা কাজের ভালো উদাহরণ। চিন্তা করা যায় না একই লেখক ‘তারা তিনজন’ নামের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লিখেছেন, আবার ‘হার্ভার্ড পিএইচডি বল্টু ভাই’ নামের আবর্জনা লিখেছেন। মনে কষ্ট নেবেন না, পাঠক। হুমায়ুন আহমেদ আমারও প্রিয় লেখক। এজন্য উনার লেখা আবর্জনার কথা মনে পড়লে চরম রাগ উঠে। যা হোক, উনি নিজেও স্বীকার করেছেন প্রকাশকদের অনুরোধ রাখার জন্য উনাকে অল্প সময়ের ভেতর অনেক লেখা লিখতে হয়েছে। কিন্তু চিন্তা করে দেখুন, মাথার ভেতর একটা কাহিনী জন্ম নিতে সময় না লাগলেও সেটাকে লিখে প্রকাশ করতে অনেক সময় লাগে। দেখা যায়, যেভাবে ভাবছি সেভাবে লিখতে পারছি না। প্রচুর কাটাকাটি হচ্ছে। কাহিনী এমন দিকে মোড় নিচ্ছে যেটা আমি ভাবিইনি। অনেক প্যাঁড়া। তাই মানসম্পন্ন লেখা লিখতে গেলে হাতে যথেষ্ট সময় থাকতে হয়। মাথায় চাকরির বোঝা নিয়ে মন ভালো রাখা কঠিন। এজন্য উন্নত বিশ্বে দেখবেন লেখকেরা শুধু লিখেই যান, অন্য কোনো চাকরি করেন না। তাদেরকে চিন্তা করার জন্য, লেখা নামানোর জন্য প্রচুর সময় দেওয়া হয়। আর আমাকে পিএইচডির পাশাপাশি লিখতে হচ্ছে। শালার জীবন! এজন্যেই আমার লক্ষ্য চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ভেগে যাওয়া। পিএইচডি শেষ করে পাঁচ বছর চাকরি করবো, টাকা জমাবো, এরপর ভাগবো। দেশ বিদেশ ঘুরবো আর গল্প উপন্যাস লিখবো।

অনেকের কাছে আমার কথাগুলো ‘ফ্যান্টাসির দুনিয়া’ মনে হতে পারে। কিন্তু এটাই কি আমাদের জীবন হওয়ার কথা ছিলো না? নিজেদের ইচ্ছেমত বাঁচা? সমাজ আপনার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে লেখাপড়া করে সার্টিফিকেট বাগাতে হবে, নতুবা চাকরি পাবেন না। চাকরি করতে হবে, নতুবা পাছায় কাপড়-পেটে ভাত-মাথার উপর ছাদ থাকবে না। আপনার কি একবারও ইচ্ছে করে না সমাজ নামক প্রতিষ্ঠানের পুতুল হয়ে না থেকে নিজের মনমতো বাঁচতে? আমার করে। এজন্য অন্যদের কাছে যা ফ্যান্টাসি মনে হয়, আমার কাছে সেটা জীবন মনে হয়। ওয়াসফিয়া নাজরীন যেমন বলেছেন, “I refuse to live by society’s standards or expectations of me“, আমিও তেমনি আমার জীবন কেমন হবে সেটা নিজেই ঠিক করতে চাই। আজ থেকে ত্রিশ বছর পর যখন ষাটোর্ধ্ব হবো, তখন একটা দামী গাড়ি আর জাঁকালো বাড়ি হয়তো থাকবে না, কিন্তু এই সন্তুষ্টি নিয়ে মরতে পারবো যে, আমি নিজের মতো করে বেঁচেছি।

রোমের নেমি শহরের একটা গলি। শহরটা মধ্যযুগের স্মৃতি বয়ে চলেছে।

 সম্প্রতি একটা ব্লগ পড়ে খুব অনুপ্রেরণা পেয়েছি। আগ্রহীরাও ঢুঁ মারতে পারেন। একটা মেয়ে কীভাবে একা একা পুরো বিশ্ব ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার বর্ণনা। সেও আর সবার মতো একটা ধাঁচে বড় হয়েছে। লেখাপড়া করেছে, ভালো ফলাফলের পিছে ছুটেছে, ভালো চাকরি করতে চেয়েছে। একসময় পেয়েছেও। কিন্তু চাকরিতে ঢুকার পর বেচারার মানসিক শান্তি হারাম হয়ে গেলো। নিজেকে একটা খুপরিতে বন্দী মনে হতে লাগলো। চাকরিটা যেন ওর জীবনকে শুষে নিচ্ছে। তখন সে ভীষণ সাহসের একটা কাজ করলো। চাকরি ছেড়ে দিলো। জমানো টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো বিশ্ব ভ্রমণে। টাকা তো আপনার জীবনকে সহজ আর আনন্দময় করার জন্য, তাই না? সে টাকা উপার্জন করতে গিয়ে যে আমরা জীবন থেকে সুখ বিসর্জন দিয়ে দিচ্ছি, সেটা কয়জন বুঝি? বা বুঝলেও পাল্টা অ্যাকশন নিতে পারি কয়জন? কার্স্টেন সেটা করে দেখিয়েছে। ‘গ্রিস ভ্রমণ করার সস্তা উপায় কী?’ ঘাঁটতে গিয়ে ওর ব্লগটা পেয়েছি। খুব ভালো লেগেছে। একদিন আমিও কার্স্টেনের মতো বের হয়ে যাবো, ঘুরে বেড়াবো রোমের অলিতে গলিতে। সেখানে টমেটো সসের গন্ধে পেট উল্টে আসবে, আবার পিতসার গন্ধে মন ভরবে। হেঁটে বেড়াবো গ্রিসের দ্বীপগুলোয়। গ্রিক পুরাণের কাহিনী মনে করে বিস্মিত হবো। এই তো এখানে ক্রিট দ্বীপ, এখানে ইথাকা…

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
50 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
50 %
Previous post ছবি ব্লগঃ রকি পর্বতমালা, গ্রেট স্যান্ড ডিউন এবং অন্যান্য (পর্ব ৫)
Next post পিএইচডি দিনলিপি – ১৪ (যেভাবে চলছে ২০২২-এর গ্রীষ্মকালীন পিএইচডি)