এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো, বারো, তেরো, চৌদ্দ, পনেরো, ষোল, সতেরো, আঠারো, ঊনিশ, বিশ
আমার দৈনন্দিন জীবন কীভাবে কাটে তার একটা চিত্র আজ তুলে ধরবো। প্রথমেই ঘোষণা দিই, আমি আহামরি কোনো পিএইচডি শিক্ষার্থী নই। আমি ফাঁকিবাজ এবং সব কাজে গড়িমসি করি। তাই আমার লেখা পড়ে যদি ভাবেন এটা পিএইচডি শিক্ষার্থীদের আইডিয়াল জীবন, ভুল হবে। আমি শুধু আমার জীবনের ব্যাপারেই বলতে পারবো। অন্য কারো সাথে আমি নিজের জীবনের তুলনা করি না। আমার নীতি হলো, যে যেভাবে ভালো থাকতে পারে, তাকে সেভাবেই থাকতে দিন। দিনশেষে মানুষের একটাই চাওয়া – সুখী হওয়া। কেউ যদি চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করে সুখী হয়, হোক। মুহম্মদ জাফর ইকবালের ক্যালটেকের ওই স্মৃতিচারণা মনে আছে? ক্যালটেকে যখন উনি গবেষণা করছিলেন, তখন এক ছেলে টবে চাষ করা ঘাস খেয়ে পেট ভরাতো কারণ বাজার করা এবং রান্না করাকে তার সময়ের অপচয় মনে হতো। সে যদি ঘাস খেয়ে সুখী থাকে, থাক না! সেভাবে আমিও সপ্তাহে তিনদিন মনোযোগ দিয়ে কাজ করে বাকি সপ্তাহ টইটই করে ঘুরলে কার কী? আমি ভালো আছি, এই কি বেশি নয়? এহেম… বেশি দার্শনিকতা ফলাচ্ছি। পাঠক ভেগে যাওয়ার আগেই মূল কাহিনীতে ঢুকে পড়ি।
প্রতিদিন সকালে এক কাপ কফি না খেলে আমার সকাল শুরু হয় না। ভাবছেন ঢঙ করছি? ভাবতেই পারেন। আমিও এক আমলে বিদেশে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের কফি প্রীতি দেখে ঢঙ ভাবতুম। ভাবতুম, দেশে থাকতে সারাজীবন চা খেলি, আর পচ্চিমে গিয়ে কফি সন্ন্যাসী হওয়ার ভেক ধরলি? এখানে এসে বুঝলাম, এদের সংস্কৃতিতে চায়ের চেয়ে কফি বেশি চলে। সমপরিমাণ কফির দামও চায়ের চেয়ে কম। তাহলে কেন মানুষ কফির উপর নির্ভরশীল হবে না? এরা চা আমাদের মতো গাঢ় লিকার করে খায় না, দুধও দেয় না। খোলা চা-পাতাও সচরাচর পাওয়া যায় না মুদি দোকানে। অ্যামাজনে খুঁজলে পেতে পারেন কিন্তু কে অতো ঝামেলা করে চা-পাতা কেনে? তাই এক পর্যায়ে দেখা যায় সবাই ‘আঃ কফি! উঃ কফি!’ বলে ধূমায়িত মগ হাতে সেলফি দেয়। মজার ব্যাপার হলো, এশীয় সংস্কৃতির অগ্রসরতার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ‘চাই টি (Chai Tea)’ নামের অদ্ভুত এক পানীয়ের উৎপত্তি ঘটেছে। যেখানে এশীয় লোকজন আছে, সেখানকার দোকানগুলোতে এই অদ্ভুত পানীয়ের দেখা পাওয়া যায়। এই নামের মাজেজা হলো, এই চায়ের মধ্যে দুধও আছে। এমনিতে আমেরিকানরা কালো চা খায়, যেটা হয় ঠাণ্ডা। ঠাণ্ডা মানে ফ্রিজের ঠাণ্ডা। গরম চা কস্মিনকালেও ওদের পান করতে দেখবেন না। কালো, ঠাণ্ডা চায়ে চিনি থাকতে পারে, নাও পারে। কিন্তু এশিয়ানদের জন্য ইশপিশাল যে চাই টি আছে, সেটা গরমও হয়, দুধও মেশানো হয়। অনেক এশিয়ান নামটা ভালোভাবে নেয়নি। আমিও না। চা মানেই তো চা। এর সাথে টি লাগানোর মানে কী? কয়েকজন তো এককাঠি সরেস। টিশার্টও বের করে ফেলেছে হুমকি ধামকি দিয়ে।

যা হোক, কফির মগ নিয়ে পড়ার টেবিলে বসি। এই ফাঁকে একটা কথা বলে রাখা ভালো। ইদানীং আমি খুব বেশি অনুভব করি নতুন জিনিস চেষ্টা করে দেখার ব্যাপারটা। এটা আত্মবিশ্বাস জোরদার করে বলে আমার ধারণা। কিছুদিন আগে সাহস করে রঙতুলি, অ্যাক্রিলিক রঙ, প্যালেট, ইজেল আর ক্যানভাস কিনেছি। আমার মুখবইয়ে কয়েকজন চিত্রশিল্পী আছেন। উনাদের আঁকাআঁকি দেখে খুব ইচ্ছে হতো আঁকতে, সাহস পেতাম না। টাকা খরচ করে সবকিছু কিনলাম অথচ পুরো টাকা জলে গেলো, এমনটা হলে আফসোসের সীমা থাকবে না। কিন্তু সত্যি হলো, চেষ্টা না করলে জানবেনই বা কীভাবে আপনাকে দিয়ে হবে কিনা? আমিও তাই প্রিন্সের তাগাদা খেয়ে দিব্যি কিনে ফেললাম আঁকাআঁকির সরঞ্জাম। সবচেয়ে সস্তাগুলোই কিনলাম যেন নষ্ট হলেও তেমন গা না পোড়ায়। তারপর সাহস করে একদিন আঁকতে বসলাম। বলতে দ্বিধা নেই, প্রথম পেইন্টিংগুলো যাচ্ছেতাই হয়েছিলো। দেখে ভাবছিলাম শুধু শুধু আঁকার চেষ্টা করছি। আমার ভেতরে মনে হয় মালমসলা নেই। তারপর প্রিন্সের অনুপ্রেরণা পেয়ে আরও কিছুদিন আঁকাআঁকি করলাম। প্রথমদিনেই তো আর মায়েস্ত্রো হওয়া যায় না… সাধনা করতে হয়।

আমার সমস্যা হলো, যেকোনো জিনিসে খুব দ্রুত বিরক্তি ধরে যায়। প্রথমদিকে যেহেতু অ্যাক্রিলিক পেইন্টিং সম্পর্কে কিছু জানতাম না, তাই শুধু ফ্ল্যাট আর্ট করেছি। একসময় সেটা আর ভালো লাগলো না। ধরলাম ইম্পাস্তো পেইন্টিং। সেটা করতে গিয়ে বুঝলাম এর জন্য ভারী অ্যাক্রিলিক রঙ লাগে (হেভি বডি অ্যাক্রিলিক)। সেটা কেনার অবস্থা নেই বলে ইম্পাস্তো বাদ দিলাম। এরপর শুরু করলাম অন্যান্য কৌশলের ব্যবহার। স্পঞ্জ দিয়ে রঙ করা, অনেকগুলো কোটিং দিয়ে পেইন্টিংয়ের চেহারা পাল্টে ফেলা। আরও অনেক কিছু করেছি যেগুলোর নাম জানি না। একেকটা কৌশল ব্যবহার করে পেইন্টিং করি আর ওই কৌশলের প্রতি আগ্রহ চলে যায়। নতুন কৌশল খুঁজি। এভাবে করলে জানি না কততুকু শিখতে পারবো। তবে এটা ঠিক, আমি অ্যাক্রিলিক পেইন্টিংয়ের মাস্টার হতে চাচ্ছি না। অন্তত এখনও না। এটা আমাকে কিছু সময়ের জন্য আনন্দ দেয় আর আত্মবিশ্বাস বাড়ায় বলে যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াই। সবসময় সব কাজে দক্ষ হতে হবে ভাবলে মানসিক শান্তি নষ্ট হয়ে যাবে। আপাতত আমার লক্ষ্য গবেষণায় দক্ষ হওয়া, খুব ভালোভাবে পিএইচডিটা শেষ করা। এরপর দেখা যাবে পেইন্টিংয়ে দক্ষ হতে চাই কিনা। ওহ হ্যাঁ, প্রথমদিকে আঁকা একটা ছবি আমার অ্যাডভাইজরকে উপহার দিয়েছিলাম। পেয়ে উনি খুব খুশী হলেও সাপ্তাহিক মিটিংয়ে আমাকে দৌড়ের উপর রাখা বন্ধ করেননি।
এখন সামার সেমিস্টার চলছে বলে বাসায় বসে কাজ করছি। ওয়ার্ক ফ্রম হোম। ফল সেমিস্টার শুরু হলে আবার ভার্সিটিতে দৌড়াদৌড়ি শুরু হবে। সামারে আমি ছয় ক্রেডিটের রিসার্চ নিয়েছিলাম। সে তুলনায় মনে হচ্ছে তেমন কাজ করিনি। সারাদিন কাজ করলেও রাতে আমার মনে হয় কিছুই তো করিনি! এরপর আর ঘুম আসে না। আসলেও ভোরে ভেঙে যায় আর মাথার ভেতর শয়তানেরা জপ করতে থাকে, “সেমিস্টার শেষ হয়ে এলো, কিছুই তো করো নাই। প্রফেসর নাখোশ হয়ে গ্রেড দিবে ‘অসন্তোষজনক’।” কোনো গ্র্যাড স্টুডেন্টই এই গ্রেড পেতে চায় না। বিশেষ করে গবেষণায় তো অবশ্যই না। পিএইচডি মানেই গবেষণা। সেখানে যদি ভালো গ্রেড না আসে, মানায়? অনেক সময় দেখা যায় চার-পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়ে আবার পড়ার টেবিলে বসি। ঘুমঘুম চোখে তাকিয়ে থাকি ল্যাপটপের পর্দায়। ভাবি, কাজ করে ফাটিয়ে ফেলছি। না ফাটালেও অন্তত ঘুমিয়ে তো সময় নষ্ট করছি না! জানি এসব চিন্তা শারীরিক আর মানসিক চাপ তৈরি করে। কিন্তু এগুলো থেকে বের হওয়া এতো সোজা নয়। আগে বাইরে থেকে মানুষের পিএইচডি জীবন দেখতাম। ভাবতাম ওরা এতো চিন্তা করে কী নিয়ে? সারাক্ষণ ঘোর লাগা ভাব। এখন বুঝি কাহিনী কী। প্রিন্সের অনেক সময় তিন-চারবার করে বলা লাগে একেকটা কথা। আমি যেন শুনেও শুনি না। অনেক সময় গবেষণার কাজে এতো বেশি ডুবে থাকি যে, প্রিন্স যদি বলে “খিদা লাগছে? খাবা?”, সেটা প্রসেস করতেও আমার মস্তিষ্কের এক মিনিট লেগে যায়।
এরপরের কাহিনী সরলরৈখিক। সকালে উঠে এই যে বসা হলো টেবিলে, সারাদিন এখানেই বসবাস। প্রকৃতির ডাকে সারা দেওয়ার সময় শুধু উঠা হয়। নইলে এখানেই ঘরবসতি। মাঝে দুইবার খাওয়া দাওয়া হয় (দুপুরে, রাতে), আর মাঝে মাঝে হাত পা ছোঁড়াছুঁড়ির জন্য এক ঘর থেকে আরেক ঘরে হাঁটাহাঁটি হয়। আমার ছবি আঁকার স্টেশনও পড়ার ঘরে। তাই একবার এই ঘরে ঢুকলে আর বের হওয়ার দরকার পড়ে না। যখন পড়াশোনা আর গবেষণা সংক্রান্ত কাজ ভালো লাগে না, বসে যাই ছবি আঁকতে। এই যেমন গতকাল এতোগুলো কাজ দেখে মনটা বিষিয়ে উঠেছিলো বলে সবকিছু বাদ দিয়ে ছবি আঁকতে বসলাম। Vincent van Gogh (ওলন্দাজ উচ্চারণ কি ভিন্সেন্ত ফন খোখ?)-এর স্টারি নাইটের আদলে কিছু একটা করার চেষ্টা। যদিও কিছুই হয়নি, তারপরও মাত্র তিনমাস হলো যে অ্যাক্রিলিক পেইন্টিং ধরেছে, তার সাহস দেখে একটু বাহবা দেবেন না?
এই তো! এভাবেই শেষ হয় আজকালকার দিনগুলো। ভাবতে পারেন সময়মত কাজ শেষ করলেই তো আর কাজ জমতে পারে না। কিন্তু পিএইচডি এমন একটা ক্ষেত্র, এখানে যতো কাজ করবেন, ততো কাজ জমবে। আজ একশোটা কাজ করে খুশ মেজাজে আছেন? কালকের মধ্যে আরও একশোটা কাজ জমবে। তাই আমার মনে হয় কাজগুলো স্মার্টলি করতে পারছি কিনা, সেটাই বড় বিষয়। এতগুলো কাজ সামলানো চাট্টিখানি কথা নয়। তাই বিরতি নিয়ে নিয়ে, মাথা ঠাণ্ডা রেখে, নিজেকে বিনোদিত করে কাজগুলো করা দরকার। ভাত আপনি মাথার চারপাশে হাত ঘুরিয়ে এনেও খেতে পারেন, অথবা সরাসরি মুখে দিতে পারেন। কাজের বেলায়ও স্মার্ট উপায় খুঁজে বের করতে হবে যেন কম সময়ে মানসম্মতভাবে বেশি কাজ করা যায়। আমিও সেই উপায় খুঁজে চলেছি…