1 0
Read Time14 Minute, 20 Second

আমেরিকায় আসার পেছনে আমার অন্যতম প্রেষণা ছিল বড়লোকি জীবনযাত্রার নাগাল পাওয়া। বাংলাদেশে থাকতে মধ্যবিত্ত জীবন যাপন করতে করতে স্বপ্ন দেখতাম আমেরিকায় এসে গাড়ি চালাচ্ছি, সুইমিংপুলে সাঁতার কাটছি কিংবা স্টারবাক্‌স্‌ থেকে কফি অর্ডার করছি। এসে গাড়ি কিনেছি ঠিকই, চালানোর অনুমতিটা আর নিচ্ছি না। আমি জানি গত ছয় বছর ধরে এই জিনিস শুনতে শুনতে আপনারা বিরক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছেন আর আমি বলতে বলতে লজ্জায় লুটোপুটি। কিন্তু তারপরও লজ্জার মাথা খেয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষা দিতে যাই না। আমার পরে এসে কতো মানুষ লাইসেন্স নিয়ে নিলো, হাঁটুর বয়সী ছোটো ভাইবোনগুলো গাড়ি চালানোর ছবি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তোলপাড় করে ফেললো, কিন্তু এই শর্মা আর লাইসেন্স পেলো না। পাবে কীভাবে, পরীক্ষাই দিলো না! মিজৌরি থেকে পেন্সিল্ভেনিয়া, পেন্সিল্ভেনিয়া থেকে টেক্সাস – তিন অঙ্গরাজ্যে কেবল ড্রাইভিং পারমিটই নিয়ে গেলাম। টেক্সাসের সেই পারমিট আবার গত মাসে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। শুনে আমার ইরানী বন্ধু বললো, “তুমি যদি পারমিট রিনিউ কর, তাহলে তোমার একদিন কি আমার একদিন। তুমি এবার ডাইরেক লাইসেন্স নিবা।” এই মেয়ে এক বছরও হয়নি যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে, ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে ফেলেছে। ওর নিজের গাড়ি নেই। আরেক ইরানী বন্ধুর গাড়ি দিয়ে দুইদিন প্র্যাকটিস করে তিনদিনের মাথায় পরীক্ষা দিতে গেছে, এক চান্সে পাশ করে ফেলেছে। অবশ্য ইরানী বালিকার ইরানে থাকতে নিজের গাড়ি ছিল। সেটা চালিয়ে চালিয়ে সে ইতোমধ্যেই ঝানু গাড়িচালক। এদেশে এসে শুধু রাস্তার নিয়মকানুন হালকা শিখতে হয়েছে। ফলে পরীক্ষা দিতে বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু আমার তো এখানে এসে গোড়া থেকে গাড়ি চালানো শিখতে হয়েছে। তাই পরীক্ষা দেওয়ার মত আত্মবিশ্বাস এখনও যোগাড় করতে পারিনি। পাঠক সমাজ তেড়ে আসতে পারেন এই বলে, “এর মত ফালতু অজুহাত আর হয় না। প্রিন্সও তো এদেশে এসে গোড়া থেকে গাড়ি চালানো শিখেছে। ও কীভাবে চার বছর আগে ড্রাইভিং লাইসেন্স বাগালো?” ইয়ে মানে, ঠিক। আমিই গাড়ি কেনার ব্যাপারে হই হল্লা করেছিলাম, আমিই ড্রাইভিং লাইসেন্স নেওয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ছিলাম। আর এখন আমিই পিছে পড়ে গিয়েছি। প্রিন্স আফসোস করে বলে, “তোমার লাইসেন্স থাকলে এতদিনে ক্রস কান্ট্রি ট্রিপ দিয়ে ফেলতাম।” তা কি আর জানি না? কিন্তু পরীক্ষার কথা ভাবলেই মেরুদণ্ড ঠাণ্ডা হয়ে আসে। কোল্ড ফিট হয়। শুনে ‘ইরানী বালিকা যেন মরুচারিণী’ বললো, সে সরাসরি ডিপার্টমেন্ট অফ মোটর ভিইকলে (যেটা সংক্ষেপে ডিএমভি নামে পরিচিত) ড্রাইভিং টেস্ট দেয়নি। সে দিয়েছে এমন একটা এজেন্সির কাছে যেটা ডিএমভির অধিভুক্ত। ওদের কাছে টেস্ট দিয়ে বালিকার কিচ্ছু ভয় লাগেনি। আমাকে বললো ওদের কাছে পরীক্ষা দিতে। যেহেতু ওরা উর্দি পরা সরকারী চাকুরে নয়, তাই মৌজে পরীক্ষা দেওয়া যায়। শুনে খুশি হলাম। টাকা একটু বেশি লাগলেও ওদের কাছেই পরীক্ষা দেবো। এখন গ্রীষ্মকাল। গ্রীষ্মে টেক্সাসের যে রোদ, সেটাকে কাঠফাটা না বলে পাথরফাটা বললে জায়েজ হয়। এই গরমের ভেতরেই পরীক্ষাটা দিয়ে ফেলবো। দিয়ে লাইসেন্স বাগিয়ে হেমন্তকালে সাতদিনের জন্য লাপাত্তা হয়ে যাবো টেক্সাস থেকে।

হে হে, আমার পরীক্ষা দেওয়ার কথা বিশ্বাস করবেন কিনা সেটা আপনার ব্যাপার। অন্তত আমি বিশ্বাস করি না। যতদিন না লাইসেন্স পেয়ে দেখাতে পারবো, ততদিন নিজের কথায় নিজেরই বিশ্বাস নেই। তবে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে যা তা চলার ফাঁক দিয়ে অন্য একটা স্বপ্ন পূরণ করে ফেলেছি। একখানা এস্প্রেসো মেশিন কিনেছি। এই যন্তর দিয়ে কী করে? কাফফে এস্প্রেসো তৈয়ার করে। কাফফে এস্প্রেসো কী? চরম তিতকুটে এবং খানিকটা টকটক সোয়াদের কফি। বাচ্চাকাচ্চাদের জন্য মোটেই নয়। আপনার যদি কফিতে কেবল হাতেখড়ি হয়, তাহলে এই কফি খেয়ে সারাজীবনের জন্য ট্রমাটাইজড হয়ে যেতে পারেন। যদি চিনি আর দুধ ছাড়া বানানো আসল কফি (সাদা বাংলায় ‘কালো কফি’) পছন্দ করে থাকেন, তাহলে পরবর্তী ধাপে উন্নীত হওয়ার জন্য এস্প্রেসো কফি শুরু করতে পারেন। আমি দেশে থাকতে কারওয়ান বাজার দিয়ে আসা যাওয়া করার সময় ‘বারিস্তা কফি শপ’ নামের দোকানটা দেখতাম কিন্তু টাকার কথা ভেবে কখনো ভেতরে ঢুকিনি। হঠাৎ একদিন দেখি গ্লোরিয়া জিন্স নামের এক কফি শপ এসে ঢাকার কফি সংস্কৃতিতে ঝড় বইয়ে দিচ্ছে। তখন অনেকের মত আমারও কফি নামক তিতকুটে পানীয়তে আগ্রহ জন্মালো। বুঝতে শিখলাম কফির প্রকারভেদ। সে সময় কাজ করি এক ইতালিয়ান বায়িং হাউজে। ইতালিয়ানরা যে কফি খেতো, সেটা ছিলো আমাদের কফি থেকে ভিন্ন। আমাদের জন্য ছিলো নেস্ক্যাফের পাউডার কফি। ওটা খেয়েই মনে মনে সুখ নিতাম। তো, একদিন ইচ্ছে হল ইতালিয়ান কফি খাবো। শুনে আমার ইতালিয়ান বস মনিকা বলল, “সহ্য করতে পারবা না।” আমি দুচ্ছাই বলে ওর কথা উড়িয়ে দিলাম। তারপর বিন্দু দাদাকে বলললাম, “দাদা, মনিকার কফি বানানোর সময় আমার জন্যেও এক কাপ বানাইয়েন, প্লিজ।” বিন্দু’দা বিস্ফারিত চোখে চেয়ে বললেন, “আপনারে কি পাগলা কুত্তা কামড়াইছে?” আজব! এটা এমন কি জিনিস যে সবাই হুজ্জৎ লাগিয়ে দিচ্ছে? আমার দৃঢ় ইচ্ছার কাছে হার মেনে বিন্দু’দা জিজ্ঞেস করলেন, “চিনিসহ খাবেন, নাকি চিনি ছাড়া?” বললাম, “মনিকা যেভাবে খায়।” বিন্দু’দা গলা খাকরে বললেন, “ওর মত চিনি ছাড়া আপনে খাইতে পারবেন না। আপনাকে চিনিসহ বানায় দিতেছি।” যদিও মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো, তারপরও বিন্দু’দার কথা অমান্য করার সাহস পেলাম না। উনি অভিজ্ঞ লোক। এত করে যখন চিনি নিতে বলছেন, তখন নিশ্চয় শক্ত কারণ আছে। মিনিট বিশেক পর বিন্দু’দা এসে আমাকে আর মনিকাকে দুই কাপ কফি দিয়ে গেলেন। এর আগেও লক্ষ্য করেছি ইতালিয়ানরা কফি খায় বুড়ো আঙ্গুলের সমান একখানা পেয়ালা থেকে। এতো ছোটো কাপে কেন খায়, আমার বুঝে আসে না। আমরা তো এক হাত লম্বা মগে নেস্ক্যাফে খাই! শুনে মনিকা রহস্যময় হাসি দিয়ে তাকিয়ে রইলো। আমি সামনে রাখা পেয়ালা হাতে নিলাম। থকথকে কালো রঙের একটা তরল। সেটার উপরে ফেনা ভাসতে দেখা যাচ্ছে। “এ আর এমন কী?” বলে চুমুক দিলাম পেয়ালায়।

পাঠক, এরপর যা হলো সেটা বললে মানীর মান থাকে না। তারপরও আপনাদের কৌতূহল মেটানোর জন্য বলতে হচ্ছে। চুমুক দেওয়ার সাথে সাথে এস্প্রেসো কফির জঘন্য তিতা স্বাদ তুমুল বেগে আমার আনকোরা জিভের প্রতিটা স্বাদ গ্রন্থি দখল করে নিলো। সে তিতা স্বাদের চোটে, বাড়িয়ে বলছি না, গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেলো। এই পানীয় বসের সামনে মুখ থেকে পিরিচে ঢালতেও পারছি না, আবার গিলতেও পারছি না। মনিকা পষ্টাপষ্টি তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওর মত কাজপাগল মানুষ, যে কিনা নখপালিশ মাখতে মাখতে সাপ্লায়ারের সাথে ডিল পাকা করে ফেলে যাতে নখপালিশ মাখার সময়টুকু খামাখা না যায়, সে পর্যন্ত কাজ বাদ দিয়ে আমাকে দেখছে। উপায় না পেয়ে মনিকার দিকে তাকিয়ে কোঁত করে এস্প্রেসো গিলে ফেললাম। চরম তিতা কফিটা গলা বেয়ে পাকস্থলীতে নেমে যাওয়ার প্রতিটা মুহূর্ত আমি টের পাচ্ছি। প্রতি মুহূর্তে সে জানান দিচ্ছে তার তিতকুটে স্বাদ। আমার চেহারা নিশ্চয় অসুস্থ মানুষের মত হয়ে গিয়েছিলো কারণ মনিকা টেবিল চাপড়ে বললো, “হয়েছে, আর খাওয়া লাগবে না। এক ঢোক যে খেয়ে দেখিয়েছো, এই ঢের!” আমি কাষ্ঠ হেসে পেয়ালাটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলাম মনিকার অফিস থেকে। বিন্দু’দা একটু পর এলেন আমার টেবিলে। হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন, “দিদি, এখন থেকে কি এস্প্রেসোই চলবে?” আমি কটমট করে তাকালাম। অ্যাম আই এ জোক ঠু ইউ?

সেই যে এস্প্রেসোতে হাতেখড়ি হলো, এরপর বারবার এস্প্রেসো খাওয়ার মওকা মিলেছে। অফিসের কাজে যতবার ইতালি গিয়েছি, ততবারই এস্প্রেসো পান করতে হয়েছে। ইতালির কাফফেত্তেরিয়াগুলোতে গিয়ে যদি বলেন “এক কাপ কফি দাও”, ওরা বুড়ো আঙ্গুলের সমান পেয়ালায় কালো কুটকুটে এস্প্রেসোই দেবে, কারণ ইতালিয়ানরা কফি বলতে এস্প্রেসোই বুঝে। সাথে হয়তো একটা বিস্কুট। মজার ব্যাপার হলো, আপনি মকা, কাপ্পুচ্চিনো, মাকিয়াতো, আমেরিকানো কিংবা লাত্তে, যে কফিই খান না কেন এগুলো সবই এস্প্রেসো থেকে বানায়। এস্প্রেসোর মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ দুধ যোগ করে এসব কফি বানানো হয় (ছবি দ্রষ্টব্য)। যা হোক, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর নিয়মিত কফি খাওয়া ধরলাম। আমার কফি খাওয়ার ইতিহাস নিয়ে একটা ব্লগ পোস্টও আছে। এরপর পদ্মা, মেঘনা, যমুনা দিয়ে বহুত পানি গড়ালো, আমার ন্যাংটোকালের বন্ধুরা বাচ্চার মা-বাপ হয়ে গেলো, আর আমি কালা কফি থেকে এস্প্রেসোতে উন্নীত হলাম। প্রথমে স্টোভ টপ এস্প্রেসো কফি মেকার দিয়ে এস্প্রেসো বানাতাম। কিন্তু সেটা বেশি ঝামেলা লাগতো বলে কিছুদিন পরই এস্প্রেসো বানানো বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কয়েকদিন আগে ভালো একটা ডিল পেয়ে ‘বেস্ট বায়’ নামক দোকান থেকে একটা বিদ্যুৎ চালিত এস্প্রেসো মেশিন কিনলাম। এখন প্রতিদিন এস্প্রেসো অথবা লাত্তে খাই। প্রথম কয়েকদিন জোশ নিয়ে কাপ্পুচ্চিনো বানিয়েছিলাম। কিন্তু সেটায় ঝামেলা বেশি, মানে দুধ পেটিয়ে ফেনা তুলতে হয় বলে আপাতত লাত্তেতে স্থায়ী হয়েছি। দুধও মেশিনই পেটাবে কিন্তু তারপরও ঝামেলা লাগে। যেদিন বেশি জোরদার টোটকা লাগে, সেদিন এস্প্রেসো মারি। যেদিন কমে হয়ে যায়, সেদিন লাত্তে। সুখেই আছি।

শেষ কথা হলো, আমেরিকায় এসে এমন অনেক কিছুই জীবনে ঘটেছে যেগুলো দেশে থাকলে ঘটত না। ঘটলেও অনেক বছর লেগে যেত ঘটতে। হয়তো আমি বুড়ো হলে ঘটত। এখানে এসে তরুণ থাকতে থাকতেই অনেক স্বপ্নের নাগাল পেয়েছি। তাই এদেশে আসা সার্থক মনে হয়। তবে আমার আসল আমেরিকান ড্রিম যেটা, মানে টাকাপয়সার চিন্তা থাকবে না আর আমরা রিক্রিয়েশনাল ভিইকলে করে জীবন পার করবো, সেটা কবে নাগাদ ছুঁতে পারবো সেই হিসেবই করি।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
100 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post পিএইচডি ক্যান্ডিডেসি পরীক্ষার গল্প – প্রথম পর্ব
Next post দুই হাজার বিশ সালঃ স্মরণীয় এক বছর