এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো, বারো, তেরো, চৌদ্দ, পনেরো, ষোল, সতেরো, আঠারো, ঊনিশ, বিশ
ঠিক এক বছর আগে লিখেছিলাম গ্রীষ্মকালীন পিএইচডির প্রথম খণ্ড। আজ আবার ইচ্ছে হল এই বছরের গ্রীষ্মের অভিজ্ঞতা ধরে রাখার, তাই খাতা কলমের বদলে ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়লাম। মাত্র দেখে এসেছি স্টার ওয়ার্স মুভি সিরিজের পঞ্চম পর্ব, Attack of the Clones । নিজেকে যতোই মুভি বা সিরিজখোর বলি না কেন, ক্লাসিক অনেক মুভি বা সিরিজই আমার দেখা হয়নি। প্রিন্সকে বিবাহ করার পর অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। বিশেষ করে সে যখন শোনে আমি এটা দেখিনি, ওটা দেখিনি, তখন ওর হার্ট অ্যাটাকের মত হয়। সেটা থেকে বাঁচাতে ঠিক করি ‘না দেখা’ ক্লাসিক চলচ্চিত্রগুলো ওর সাথে বসে একটা একটা করে খতম দেবো। সে সুতো ধরে অনেক কিছু দেখে ফেলেছি। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ম্যাট্রিক্স ট্রিলোজি, জিবলির অ্যানিমেশনগুলো (প্রায় ৯০% শেষ করেছি), গুপী বাঘা, কিংবা হ্যারি পটার সিরিজের কথা। এখন দেখছি স্টার ওয়ার্স সিরিজ। প্রিন্স বলেছে এই সিরিজের প্রথম ছয়টা মুভি দেখে ম্যান্ডালোরিয়ান টিভি সিরিজ ধরবে। স্টার ওয়ার্সের শেষ তিনটা মুভি নাকি না দেখলেও চলবে। ওর রেকোমেন্ডেশনে বিশ্বাস করি বলে ব্যাপারটা মেনে নিয়েছি। এখন আর আলতু ফালতু মুভি দেখে সময় নষ্ট করার মত বয়স নেই। এটা শুনে স্টার ওয়ার্স ভক্তদের ক্ষেপে যাওয়ারও কারণ নেই। শিল্প সবসময়ই সাবজেক্টিভ। আপনার যেটা ভালো লাগবে, আমার সেটা বিষ্ঠা মনে হতে পারে। আবার আমার যেটা ভালো লাগবে, সেটা দেখে আপনি আমাকে ধুয়ে দিতে পারেন।
যা হোক, আমি মনে হয় পিএইচডিতে সুযোগ পাওয়ার পর জীবনের আয়েশি দিকটা হরক্রাক্সে ঢুকিয়ে অ্যামাজনের জঙ্গলে ফেলে দিয়ে এসেছি। কিছুতেই সেই হরক্রাক্স খুঁজে পাচ্ছি না। তাই জীবনটাও আয়েশি হচ্ছে না। এই ‘দৌড়ের উপর থাকা’ জীবনের সোদনে সবকিছুর অনর্থকতা নিয়ে ক্ষণে ক্ষণে মস্তিষ্কে গভীর ভাবের উদয় হয়। কেন করছি এসব? কী বালটা ছিঁড়বে এগুলো করে? যাদের জন্য গবেষণা করছি, সে পেশার মানুষ খুব একটা সাপোর্টিভ না। যাদের পেশাগত উন্নতির জন্য আমার পিএইচডির প্রতিটা প্রোজেক্ট, তারাই মুখ ভার করে রাখে গবেষণার ফলাফল দেখে। আরে বাবা, কোনোকিছুতে উন্নতি করতে হলে সবার আগে স্বীকার করতে হবে ওই জায়গায় খামতি আছে। খামতি ধরিয়ে দিলে যদি গোস্বা করিস, কীভাবে উন্নতি করবি? আশা আছে একদিন ঠিকই ওরা বুঝবে আমার অবদান। আউট অফ দা বক্স কিছু করতে গেলে ঠ্যাঙ্গানি খেতে হয় ঠিকই, কিন্তু এর স্বীকৃতিও কোনো না কোনো সময় মেলে যদি ব্যাপারটা ভালো কিছু হয়। দেখি পানি কোনদিকে গড়ায়!
গ্রীষ্ম যে শুধু মুভি দেখে কাটছে, তা নয় (যদিও এমন হলে কি ভালোই না হতো!)। মুভি আর টিভি সিরিজ দেখার ফাঁক দিয়ে পিএইচডির দ্বিতীয় প্রোজেক্টের ম্যানুস্ক্রিপ্ট লিখে শেষ করেছি। ম্যানুস্ক্রিপ্টটা অনেকদিন ধরে কৃমির মত পাছায় আটকে ছিল। বেরই হচ্ছিলো না। অবশেষে মুড এলো আর টানা একমাস কাজ করে প্রাথমিক খসড়া দাঁড় করিয়ে ফেললাম। পাঠিয়ে দিলাম অ্যাডভাইজরকে। বল এখন উনার কোর্টে। সেই বল আবার পাঠানো হবে আমার কোর্টে। এভাবে লাত্থালাত্থি চলতে চলতে একসময় খসড়া চূড়ান্ত হবে এবং জায়গা করে নেবে আমার পিএইচডি ডিজার্টেশনে। এই প্রোজেক্ট নিয়ে পোল্যান্ডের একদল গবেষক বেশ আগ্রহ দেখিয়েছিল। তারা এখন পোলিশ জনগণের কাছ থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করছে। সেটার জন্য ওদেরকে মাঝে মাঝে সময় দিচ্ছি। তার উপর আমার তৃতীয় প্রোজেক্টের উপাত্ত সংগ্রহ প্রায় শেষ করে এনেছি। এখন ব্যবহারযোগ্য উপাত্ত আলাদা করে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে তথ্যে রূপান্তরিত করা বাকি। এই প্রোজেক্ট নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার এক গবেষক আগ্রহী হয়েছেন। উনি অস্ট্রেলিয়ান জনগণের উপর এই বিষয়ে গবেষণা করতে চান। তাই উনাকেও সময় দিচ্ছি। এর উপর আছে সামার জব। সপ্তাহে বিশ ঘণ্টা ওখানে দিই। জবটা অনেক ডিমান্ডিং, মানে করতে গেলে মাথায় চাপ পড়ে। তবে ভালো যে, এটা আমার পিএইচডির ফোকাসের সাথে মিলে। অনেক কিছু শিখতে পারছি। গত বছরের সামার জব নিয়ে বেশ মনঃকষ্টে ছিলাম। একে তো আমার পিএইচডির ধারে কাছে নেই, তার উপর ডিমান্ডিং।
আমি পিএইচডির যে পর্যায়ে আছি, সে পর্যায়ে মানুষ ডিজার্টেশন নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে। আমিও করেছি। অ্যাডভাইজর পরামর্শ দিয়েছেন স্যান্ডউইচ ডিজার্টেশন লেখার। মানে পাবলিশড আর্টিকেলের ফরম্যাটে তিনটা প্রোজেক্ট উপস্থাপন করতে হবে। প্রথম অধ্যায় হবে গবেষণার ভূমিকা আর শেষ অধ্যায় হবে উপসংহার। দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ অধ্যায়ে থাকবে আমার তিনটা প্রোজেক্ট। অ্যাডভাইজর বলেছেন ডিজার্টেশন চূড়ান্ত করতে ছয় মাস সময় হাতে রাখা ভালো, নতুবা তাড়াহুড়া হয়ে যাবে। এর মানে হল আমাকে পিএইচডির শেষ ছয় মাস হাতে রাখতে হবে ডিজার্টেশনের জন্য। তার মানে ওই ছয় মাস আসার আগেই চূড়ান্ত করতে হবে দ্বিতীয় আর তৃতীয় প্রোজেক্টের ম্যানুস্ক্রিপ্ট। কীভাবে এটা সম্ভব? অনেক ভেবে চিন্তে একটা পরিকল্পনা দাঁড় করিয়েছি। সবকিছু ঠিকমতো চললে পরিকল্পনা বলছে সময়মতই ডিজার্টেশন প্রস্তুত হয়ে যাবে। তবে কিনা কিছুই নিশ্চিত নয়। উল্টোপাল্টা কিছু ঘটলে যেন হাতে বাড়তি সময় থাকে, ওদিকেও চিন্তা করতে হবে। আপনারাই বলুন, একসাথে এত দিক নিয়ে চিন্তা করলে ভজঘট লাগে কিনা? আমার লাগে। তবে আলাদা আলাদাভাবে দেখলে মনে হয় কাজগুলো শেষ করা সম্ভব। আমি তাই ভেঙ্গে ভেঙ্গেই দেখি। এই যেমন দ্বিতীয় প্রোজেক্টে কাজ করতে গিয়ে কোয়ালিটেটিভ রিসার্চ করতে হবে কিংবা তৃতীয় প্রোজেক্টে কাজ করার জন্য R শিখতে হবে – এগুলো যখন একসাথে চিন্তা করতাম, সবকিছুর উপর থেকে মন উঠে যেত। নিজেকে ফেইলিওর মনে হতো। ভাবতাম পিএইচডির এই চাপ আমার জন্য নহে। কিন্তু দেখুন, কোয়ালিটেটিভ রিসার্চে উৎরে গিয়েছি। হয়তো R ব্যবহারেও উৎরে যাবো। কে জানে!