0 0
Read Time14 Minute, 18 Second

[ডিস্ক্লেইমারঃ নিচের লেখাটা লিখেছিলাম ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে। আলসেমি করে এতদিন খসড়া ফোল্ডারে ফেলে রেখেছিলাম। আজ মন চেয়েছে প্রকাশ করতে, করে ফেললাম। আশা করি পাঠকেরা আমার এইসব অনিয়মিত এবং অ-ধারাবাহিক পোস্টাপুস্টি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ‘পিএইচডি দিনলিপি’ সিরিজের ধারাবাহিকতা বিচার করলে এই লেখা হওয়ার কথা ছিল ‘পর্ব ১৯’। কিন্তু আমি ‘পর্ব ১৯’ হিসেবে আরেকটা লেখা প্রকাশ করে ফেলেছি। তাই এটা হয়েছে ‘পর্ব ২১’। আপনারা যদি পর্ব ১৮-এর পর এটা পড়েন, আমার কাজকর্মের ধারাবাহিকতা বুঝতে সহজ হবে। Just saying…]

একদুইতিনচারপাঁচছয়সাতআটনয়দশএগারোবারোতেরোচৌদ্দপনেরোষোলসতেরোআঠারোঊনিশবিশ

পিএইচডি প্রোগ্রামে ঢুকার এক বছর পর লিখেছিলাম এই পোস্ট। আজ লিখছি দুই বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে। লেখাটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে এসেছে। হয়তো অনেকের সাথে মিলবে না। তারপরও লিখছি। দুই বছরে যেসব ব্যাপারে উপলব্ধি হয়েছে, তার মধ্যে প্রথমটা হল, কাজ করতে করতে বিভিন্ন জিনিস শেখা। আমার অ্যাডভাইজর বলেন, “তুমি যখন ব্যাচেলর করেছ, তখন কোর্সওয়ার্ক করেছ। এখন সময় হাতে কলমে কাজ শেখার।” আমি প্রথমে উনার কথার মাহাত্ম্য বুঝতাম না। ভাবতাম, প্রথম বর্ষ থেকেই কেন প্রোজেক্টে জড়াচ্ছেন আমাকে? এখন কি শুধু কোর্সওয়ার্ক করার কথা না? কিন্তু এক বছরের মাথায়ই টের পেলাম ব্যাপারটা কত উপকারী ছিল। যে প্রোজেক্টে কাজ করেছিলাম, সেটা আমার পিএইচডি প্রোগ্রামের অংশ ছিল না। ছিল অ্যাডভাইজরেরই একটা অতীত প্রোজেক্ট, যেটাকে আপডেট করা দরকার (হাসপাতালের রোগীদের ক্লস্ট্রিডাইওসিস ডেফিসিল নামক ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়া প্রতিরোধ করতে প্রোবায়োটিক কোনো ভূমিকা পালন করে কিনা, তার উপর সিস্টেম্যাটিক রিভিউ)। আমি ‘ডাইরেক্ট রিডিং’ কোর্সের অধীনে এই প্রোজেক্ট আপডেট করার দায়িত্ব নিয়েছিলাম। ‘ডাইরেক্ট রিডিং’ হল বিশেষ ধরনের কোর্স, যেটায় একজন শিক্ষার্থী একজন ইন্সট্রাক্টরের অধীনে বিশেষ দক্ষতা অর্জনের জন্য কাজ করে। আমার পিএইচডির প্রথম প্রোজেক্ট যেহেতু একটা সিস্টেম্যাটিক রিভিউ হবে, তাই কীভাবে রিভিউ করে, সেটা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য হাতে কলমে কাজ শেখাটা দারুণ উপকারে এলো। পিএইচডির প্রথম প্রোজেক্টে কাজ করার জন্য যে দক্ষতাগুলো দরকার ছিল, সেগুলো সম্পর্কে জ্ঞান হয়ে গেলো ডাইরেক্ট রিডিং’ কোর্সে কাজ করতে করতে। সিস্টেম্যাটিক রিভিউ, মেটা-এনালাইসিস, RevMan সফটওয়্যার, বা GRADE framework সম্পর্কে যত কিছু শিখেছি ওই সময়, ইউটিউব ভিডিও দেখে বা বিভিন্ন কোর্সে অংশ নিয়েও অত কিছু শিখিনি।

তবে সবাই যে আমার মত গবেট হবে, তা না। অনেকেই লেকচার শুনে সবকিছু বুঝে ফেলেন বা মাথায় গেঁথে ফেলতে পারেন। কিন্তু কোর্স মারফত কোনোকিছু শেখার পর সেটা বাস্তবে প্রয়োগ না করলে সে জ্ঞান আমার মাথা থেকে হাওয়া হয়ে যায়। তাই আমার মত জনগণের জন্য প্রোজেক্ট করতে গিয়ে ঠেকে ঠেকে শেখাটা ক্লাসে বসে শেখার চেয়ে শতগুণে উপকারী। আপনি যদি এই ক্যাটাগরির হন, প্রথম থেকেই এমন কোনো প্রোজেক্টে শামিল হওয়ার চেষ্টা করুন যেটা আপনার পিএইচডি কন্সেন্ট্রেশনের সাথে মিলে। কাজ করতে করতে বিভিন্ন জিনিস শিখুন। মোদ্দা কথা, আমি যখন হাতে কলমে কাজ করি, তখন ব্যাপারটা ভালোমত বুঝতে শিখি। এজন্য আমার প্রিয় চৈনিক প্রবাদ, “I hear, and I forget. I see, and I remember. I do, and I understand.” কাজ করতে গেলে আমি ঠেকে যাই, সেটা সমাধানের জন্য ঘাঁটাঘাঁটি করি, ঘাঁটতে ঘাঁটতে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে পরিষ্কার ধারণা হয়। হয়ত সবার মস্তিষ্ক এভাবে কাজ করে না। কিন্তু যাদের সাথে আমার বৈশিষ্ট্য মিলে যায়, তারা আমার মত ‘বিভিন্ন প্রোজেক্টে যুক্ত হয়ে হাতে কলমে কাজ শেখার’ উপায় অবলম্বন করে দেখতে পারেন।

দ্বিতীয়টা হল, নিজের কমফোর্ট জোন থেকে বের হওয়া। আমার কাছে পিএইচডি হল নতুন জ্ঞান অর্জনের সময়। এই জ্ঞান যে শুধু নিজের গবেষণা ক্ষেত্রেই হতে হবে, তা না। একজন পিএইচডি শিক্ষার্থী হিসেবে আমার মনে হয়েছে আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা লাভ করা দরকার। আমি অন্তর্মুখী একজন মানুষ। ব্যক্তিগত জীবনে তেমন আলাপচারিতা জমাতে পারি না। কিন্তু একাডেমিক জীবনে আমি বেশ সামাজিক। সবার সাথে মিলে চলতে পারি, আড্ডা দিতে পারি, দলগত কাজ করতে পারি। এই ব্যাপারটা কি হুট করে হয়েছে? অবশ্যই না। আমি নিজেকে ভেঙ্গেছি নিজের প্রয়োজনেই। বিভিন্ন সময়ে হয়ত শুনে থাকবেন কানেকশন তৈরি করার কথা। এটা করার সবচেয়ে বড় উপায় হল মানুষের সাথে মেলামেশা। আমার লক্ষ্য ছিল People skills-এ দক্ষতা অর্জন করা। তাই পিএইচডিতে ঢুকেই আমি পুষ্টি অনুষদের গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী এ্যাসোসিয়েশনের সিনেটর পদে আবেদন করেছিলাম। নির্বাচিতও হয়েছিলাম। আমার কর্মকাণ্ড দেখে পরের বছর এ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমাকে নির্বাচিত করা হল। এই সংগঠনের সাথে কাজ করতে করতে আমি মানুষের সাথে ইফেক্টিভলি কথা বলা, নিজেকে তুলে ধরা, মানুষের প্রতি সহমর্মী হওয়া ইত্যাদি গুণ রপ্ত করেছি। এই গুণগুলো কাজে লাগছে যখন আমি কোর্স ইন্সট্রাক্টর হিসেবে আন্ডারগ্র্যাডদের পড়াচ্ছি।

তো, দুই বছর কোর্স ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কাটানোর পর মনে হল নিজেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নেওয়া দরকার। আমি হয়তো নতুন টিচিং এসিস্টেন্ট এবং ইন্সট্রাক্টরদের প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করার যোগ্যতা রাখি! ব্যাপারটা যাচাইয়ের জন্য দিলাম ‘গ্র্যাজুয়েট টিচিং কনসালটেন্ট’ হিসেবে আবেদন করে। নির্বাচিতও হলাম। তারপর ফল সেমিস্টারে প্রশিক্ষণ দিলাম চুরাশি জন নতুন টিচিং এসিস্টেন্ট, গ্রেডার, ল্যাব এসিস্টেন্ট এবং কোর্স ইন্সট্রাক্টরকে। প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় আগের কাজগুলোর মাধ্যমে অর্জিত এবং চর্চিত গুণগুলো কাজে দিয়েছে। এগুলো আমার না করলেও পিএইচডি জীবন দিব্যি চলে যেত। থাকতাম গবেষণা নিয়ে। তাই না? কিন্তু আমার মনে হয়েছে মানুষের সাথে সহজে মিশতে পারা বা উঠবস করতে পারা বিশাল এক যোগ্যতা। আপনি যেখানেই চাকরি করতে যান বা ব্যবসা করেন, সহকর্মীদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। সম্পর্ক তৈরি করা অন্তর্মুখীদের জন্য সহজ না। ওই দক্ষতা অর্জনের জন্য শিক্ষার্থী থাকাকালেই বিভিন্ন কাজের সাথে জড়ানো ভালো। এতে আপনার ভাষাগত দক্ষতা (বলতে পারা এবং শুনে বুঝতে পারা) বাড়বে, অন্যের কাছে নিজেকে প্রকাশ করার দক্ষতা বাড়বে। তাছাড়া যতো মানুষ (বা সংগঠন) আপনার গবেষণা সম্পর্কে জানবে, ততো আপনার কানেকশন তৈরিতে সুবিধা হবে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, সম্প্রতি পুষ্টি অনুষদের একটা আন্ডারগ্র্যাজুয়েট সংগঠনের সাথে কাজ শুরু করেছি। ওরা একটা ক্যারিয়ার ফেয়ার আয়োজন করবে, সেটার অন্যতম আয়োজক হিসেবে কাজ করছি। এর পিছে উদ্দীপনা হল ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে অভিজ্ঞতা লাভ করা। তো, আমার সাথে কাজ করতে গিয়ে সংগঠনের সভাপতি আমার গবেষণা সম্পর্কে জেনেছে। অনুরোধ করেছে যেন আমি আন্ডারগ্র্যাজুয়েটদের একটা সেমিনারে গেস্ট স্পিকার হিসেবে এসে আমার গবেষণা ক্ষেত্র ‘ফলিত পুষ্টিবিজ্ঞান’ নিয়ে কথা বলি, ওদের উৎসাহিত করি। যদি সভাপতির সাথে আমার চেনাজানা না হতো, হয়তো সে আমার গবেষণা সম্পর্কে জানতও না, অনুরোধও করতো না কথা বলার জন্য।

প্রশ্ন করতে পারেন, এতকিছু করার সময় কোথায়? উত্তর হবে, যদি আপনি চান, তাহলে কিছু জিনিসের জন্য সময় বের করা সম্ভব। আমি প্রথম দুই বছর অনেক কিছুর সাথে জড়িত ছিলাম। তখন ছিল নিজেকে ভাঙার সময়, বিভিন্ন দক্ষতা অর্জনের সময় (নেতৃত্ব, পাবলিক রিলেশন, পাবলিক স্পিকিং ইত্যাদি)। তৃতীয় বর্ষে উঠার পর হাতে গোনা কিছু ব্যাপারে নিজেকে জড়াচ্ছি। আপনি প্রথম বর্ষে থাকতেই খুঁজে বের করুন পিএইচডি জীবনে গবেষণার বাইরে অন্যান্য বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্য কতটুকু সময় ব্যয় করতে পারবেন। পিএইচডি শিক্ষার্থী হিসেবে টাইম ম্যানেজমেন্ট করতে শিখাটা অত্যাবশ্যকীয়।

শেষ করার আগে একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। ইদানীং আমার মস্তিষ্ক বিচিত্র এক প্যাটার্নে চলছে। টানা কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহ পড়াশোনা বা গবেষণায় একদমই মন বসাতে পারি না। সারাক্ষণ ভাবি, কী করছি এই জীবন নিয়ে? কে আমাকে এই ছিনিমিনি খেলায় অংশ নিতে বলেছিল? পিএইচডি করেই বা কী হবে? কোথায় মনের মত চাকরি পাবো? আমার নন-একাডেমিক প্রতিষ্ঠানে গবেষক হিসেবে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা। আমি কি পারবো এমন কোন জবে ঢুকতে? মনে হয় না। আমি তো সামনে কোনো অপশন দেখি না। এরকম কতো কী যে ভাবি! প্রতি মাসেই এরকম কিছু দিন আসে। ভীষণ বিষণ্ণ লাগে, হতাশ লাগে। কিচ্ছু ভালো লাগে না, একটু পর পর কান্না পায়। মনে হয় কী ভীষণ বিরক্তিকর এই গবেষণার কাজগুলো! কেন আমার জীবনটা এমন হল না যেখানে আমি নিজের ইচ্ছেমত কাজ করে কামাই করতে পারব? কেন আরেকজনের অধীনে থেকে গবেষণা করতে হচ্ছে যার সাথে দুইদিন পরপর বিভিন্ন কারণে কুস্তাকুস্তি লাগে? না পাঠক, এই মুড সুইংয়ের সাথে মেন্সট্রুয়েশন সাইকেলের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি প্রথম প্রথম এটাই ভাবতাম। পরে দেখি, নাহ, এই প্যাটার্ন র‍্যান্ডম। হুটহাট দেখা দেয়। স্থায়ীও হয় র‍্যান্ডম সময়ের জন্য। তারপর একদিন মোক্ষ লাভ হয়, বিরেন অটো মোডে চলে যায়। সঠিক পথে আগায় (মানে সমাজের মানদণ্ডে যাকে আমরা সঠিক বলে ভাবি)। তখন সবকিছু ফকফকা লাগে। সামনে অনেক অপশন দেখি। মানুষকে নক করে কানেকশন বানানোর প্রক্রিয়াকে জলবৎ তরলং মনে হয়। মনে হয় I can carry on. চেষ্টা করেও তখন বিরেনের কাজ করা থামাতে পারি না। রাতে ঘুমাতে পারি না কাজ করে পাওয়া আনন্দের ঠ্যালায়। ছয় ঘণ্টা ঘুমিয়েই উঠে যাই যেন কাজ শুরু করতে পারি। যেন সফলভাবে কাজ শেষ করার উপহার হিসেবে ডোপামিন নিঃসৃত হয়ে আনন্দের অনুভূতি পাই। কি যে অদ্ভুত এই ছলাকলা!

আজ এই পর্যন্তই। ধন্যবাদ সবাইকে।

Happy
Happy
0 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post পিএইচডির শেষ সেমিস্টারের স্মৃতি (পর্ব ১)
Next post পাইলাম, আমি ইহাকে (এহেম… এহেম… ড্রাইভিং লাইসেন্স) পাইলাম