1 0
Read Time13 Minute, 12 Second

এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো, বারো, তেরো, চৌদ্দ, পনেরো, ষোল, সতেরো, আঠারো, ঊনিশ, বিশ

[পিএইচডি জীবন, সে জীবনের কমিটমেন্ট, পিএইচডিতে ঢুকার আগে এ জীবন সম্পর্কে হালকা পাতলা ধারণা থাকা আর ঢুকার পরে বাস্তব উপলব্ধি কেমন হতে পারে, সে নিয়ে অনেকদিন ধরে কিছু চিন্তা ঘুরছে মাথায়। এগুলো একান্তই আমার ব্যক্তিগত মতামত। অন্যদের মতের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে।]

যতো দিন গড়াচ্ছে, ততো বুঝতে পারছি পিএইচডিতে সফল হতে হলে কী পরিমাণ প্যাশন থাকতে হয়। অন্য সকল প্যাশনকে লাগাম পরিয়ে শুধু পিএইচডির বিষয় নিয়েই দৌড়াতে হয়। আগে ব্যাপারটা জানতাম না, তা নয়। তবে জানা আর বুঝতে পারার মধ্যে বিশাল ফারাক। কিছু জানলেই যে আমরা সেটার মাহাত্ম্য অনুধাবন করতে পারবো, সেরকম নয়। যখন ওই ব্যাপারটা আমাদের জীবনে ঘটবে, তখনই আমরা ব্যাপারটা অনুভব করতে পারবো। তাই হাজারো পিএইচডি বিষয়ক পোস্ট পড়েও আমি বুঝতে পারিনি আমার পিএইচডি জীবন কেমন হতে পারে। এখন যেহেতু সেই জীবনের মধ্যে আছি, তাই বুঝতে পারছি। পড়ে পাঠকের আতংকিত বা ডিমোটিভেটেড হওয়ার কিছু নেই। ইদানীং মুখবইয়ের কিছু গ্রুপে নাকি পিএইচডি শিক্ষার্থীদের কঠিন অভিজ্ঞতার কাহিনী পড়ে অনেকে এই লাইনে পা বাড়ানোর উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। তাদের প্রতি আমার প্রশ্ন, কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? অন্য সকল বিষয়ের মতো পিএইচডিরও ভালো, ধূসর আর মন্দ দিক আছে। কেউ হয়তো শুধু খারাপ দিকগুলো নিয়ে কথা বলে। সেজন্য আপনি ভাবছেন এটা খুব খারাপ একটা জীবন। কিন্তু এই জীবনে অনেক আনন্দও আছে। বিশেষ করে আপনি যদি নতুন কিছু জানতে চান, নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করতে চান, নতুন দক্ষতা অর্জন করতে চান, বিখ্যাত গবেষকদের সাথে পরিচিত হতে চান, আপনার কাজকে পুরো বিশ্বে তুলে ধরতে চান, সমাজের উপকারের জন্য বৃহৎ পরিসরে অবদান রাখতে চান, তাহলে পিএইচডি খুব ভালো একটা রাস্তা। তবে কারো পিএইচডি জীবনের সাথে কারো পিএইচডি জীবন মেলানো যায় না। একই বিষয়ের উপর পিএইচডি করছে একই অ্যাডভাইজরের অধীনে, অথচ ঘেঁটে দেখুন তাদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন। যখন পিএইচডিতে ঢুকবেন তখনই কেবল বুঝতে পারবেন আপনার পিএইচডি জীবনটা কেমন। তাই অন্যের অভিজ্ঞতা পড়ে ভয় পেয়ে বা হতাশ হয়ে পিছু হটার কিছু নেই।

সমস্যা হলো, পিএইচডিতে ঢুকার পর অনেকে বুঝেন যে, পিএইচডি জীবনটা তাদের জন্য নয়। তিন-চার-পাঁচ বছর ধরে একই বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা তাদের কাছে বিরক্তিকর লাগতে পারে। কিংবা অনেকগুলো প্রোজেক্ট শেষ করার ব্যাপারটা ভীষণ মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে। যাদের মনে হয় এগুলো সামাল দিতে গিয়ে মানসিক কষ্ট পাওয়ার চেয়ে পিএইচডি ছেড়ে দেওয়া উপকারি, তারা হয়তো তাই করেন। আমি তাদেরকে একদমই বিচার করি না। যে যেভাবে ভালো থাকতে পারে। ইদানীং দেখবেন লিংকডিন বা টুইটারে এই ব্যাপারগুলো নিয়ে অনেক আলোচনা চলে। সেদিন একটা পোস্ট দেখলাম, “কেউ যদি মাঝপথে পিএইচডি ছেড়ে চাকরি জীবনে ঢুকতে চায়, তাহলে অ্যাডভাইজরের উচিৎ শিক্ষার্থীর সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে তাকে সমর্থন দেওয়া।” আপনি লেখকের কথাকে সমর্থন করবেন কিনা, সেটা আপনার বিবেচনা। তবে কথাটা আমাকে বেশ ভাবালো। এখানে শিক্ষার্থীর নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছার সাথে অ্যাডভাইজরের প্রোজেক্টও জড়িত। তাই কমেন্ট সেকশনে অনেকে নৈতিকতা টেনে আনলেন। এই ধরনের আলোচনায় একটা মন্তব্য বেশ জনপ্রিয়, “পিএইচডিতে ঢুকার আগেই তো আপনি জানতেন এটা চার থেকে পাঁচ বছরের কমিটমেন্ট। জেনেই ঢুকেছেন। এখন অ্যাডভাইজরকে বিপদে ফেলে, কমিটমেন্ট ভেঙে চলে যেতে চাইছেন। আপনার তো নৈতিকতা বলে কিছু নেই!” আমার মনে হয় এই মন্তব্য খুবই আপত্তিকর। এটা একটা মানুষের ভিতরকার কথা, তার অনুভূতি সবকিছু এক কথায় নাকচ করে দিচ্ছে। অথচ ওই ব্যক্তি যে অভিজ্ঞতায় পড়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আমরা যাইনি। তাহলে কীভাবে তার সিদ্ধান্তকে নাকচ করে দিচ্ছি? তাছাড়া এটাও সত্যি, কমিটমেন্টের ব্যাপারে শুধু জেনে পিএইচডি জীবনে ঢুকা আর ঢুকার পর সে কমিটমেন্ট ধরে রাখার অভিজ্ঞতা পুরোপুরি আলাদা। আমি নিজেও পিএইচডি করার ব্যাপারে প্যাশনেট ছিলাম। কমিটমেন্টে নিজেকে জড়ানো নিয়ে কোনো দ্বিধাই ছিলো না। কিন্তু সেই আমিও পিএইচডি শুরু করার পর উপলব্ধি করতে পেরেছি কমিটমেন্টের আসল মাহাত্ম্য। এই মাহাত্ম্য একজন পিএইচডি জীবনে ঢুকার আগে কীভাবে বুঝবে, বলুন? তাহলে কেনো আমরা তাকে বিচার করতে যাবো কমিটমেন্টের ধোঁয়া তুলে? আবার এটাও ঠিক, একজন শিক্ষার্থী চলে গেলে অ্যাডভাইজর আরেকটা শিক্ষার্থী পাবেন। একটু সময় লাগবে নতুন করে তাকে গড়ে তুলতে এবং প্রোজেক্টের কাজ হয়তো থেমে থাকবে কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু যে শিক্ষার্থী আর চায় না পিএইচডি করতে, তাকে জোর করে রেখে দিলে কি সে আদৌ প্যাশন নিয়ে কাজ করবে? প্রোডাক্টিভ হবে? মনে তো হয় না। তাই কেউ যদি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলে পিএইচডি ছাড়ার, আমার মনে হয় তাকে সমর্থন করা উচিৎ। সে জেনেবুঝেই নিজের জন্য যা ভালো, সেটা করছে। একটা মানুষের স্বাধীনতা আছে সে কীভাবে জীবন যাপন করবে সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। কিন্তু ব্যাপারটা যেনো অ্যাডভাইজরের সাথে সুন্দরভাবে সমাধানের মাধ্যমে ঘটে। অ্যাডভাইজর যেহেতু নিজের সময় এবং শ্রম দিয়েছেন ওই শিক্ষার্থীর পেছনে, শিক্ষার্থীরও খেয়াল রাখতে হবে যেন সে অ্যাডভাইজরকে আলটপকা বিপদে ফেলে চলে না যায়। তবে একটা জিনিস আমার কাছে অনৈতিক মনে হয়। অনেকে কোনোমতে যুক্তরাষ্ট্রে আসার জন্য পিএইচডিতে আবেদন করেন। ক্ষেত্রবিশেষে যেহেতু পিএইচডিতে ফান্ডের এভেইলেবিলিটি বেশি, তাই অ্যাডমিশন নেন পিএইচডিতে। অথচ তাদের মূল লক্ষ্য একটা মাস্টার্স নিয়ে বেরিয়ে পড়া এবং চাকরি করা। এটা সত্যিই দুঃখজনক। আপনি পিএইচডিতে ঢুকার আগেই জানেন অ্যাডভাইজরকে ধোঁকা দেবেন। তাই এই পথে পা না বাড়ানোর অনুরোধ রইলো।

এখন আমার আক্ষেপের কারণ বলি। আমি একাডেমিক লেখাপড়ার বাইরে আরও অনেক জিনিসের উপর ইন্টারেস্টেড। কিন্তু সেসব বিষয়ে সময় দেওয়ার মতো সময় ইদানীং আমার থাকে না। আমি নতুন জ্ঞান অর্জন করতে চাই ঠিকই, কিন্তু সেটা কখনো একটা নির্দিষ্ট ছকে ফেলে নয়। এটা পীড়াদায়ক। আমি চেয়েছি যখন যা খুশি, তখন তাই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করবো। কিন্তু যখন পিএইচডিতে ঢুকলাম, তখন এই ছকে আটকা পড়ে গেলাম। পিএইচডিতে কী করছি? একটা নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর দক্ষ হওয়ার জন্য ওই বিষয়ের উপর এই পর্যন্ত হওয়া গবেষণা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছি, সেসব গবেষণার ফাঁক বের করছি, নতুন আঙ্গিক বের করছি, নিজের গবেষণা করছি। তারপর সে গবেষণাকে জার্নালে প্রকাশের জন্য ম্যানুস্ক্রিপ্ট লিখছি। সে ম্যানুস্ক্রিপ্ট আবার অ্যাডভাইজরের মনঃপুত হচ্ছে না। বারবার “এটা করো, সেটা করো” বলে সংশোধনী দিচ্ছেন। এসব গ্যাঁড়াকলে পড়ে একদিন খেয়াল করলাম অন্য জিনিস জানার যে আকাঙ্ক্ষা ছিলো, সেটায় লাগাম পরাতে হচ্ছে। ইচ্ছেমত অন্য জিনিস নিয়ে ঘাঁটার সময় থাকছে না। পুরাণ এবং এ সংক্রান্ত প্রত্নতত্ত্ব আমার খুবই প্রিয় একটা বিষয়। অথচ এটা নিয়ে এখন একটা প্রবন্ধও পড়া হয় না। আগে প্রতিদিনই টুকটাক পড়তাম। জানতে চাইতাম মানুষের ভিতরে কীভাবে এসব গল্প তৈরির অনুপ্রেরণা এলো। কিন্তু এখন শুধু পুষ্টিবিজ্ঞান নিয়ে পড়ে থাকতে হয়। একটার পর একটা কাজ লেগেই থাকে। এসব কাজ সামলে যখন একটু শ্বাস ফেলার সময় পাই, তখন কি আর পুরাণ নিয়ে বসতে ইচ্ছে করে? তখন মনে হয় হালকা চালের কোনো কাজ করি যেখানে মাথা খাটাতে হবে না। তাই মাঝে মাঝে খারাপ লাগে।

আমি বুঝতে পারিনি জীবনটা এরকম হবে। পিএইচডিতে ঢুকার আগে মনে হয় কেউই বুঝতে পারে না সে কীসের ভিতর ঢুকছে। জীবনটাই এরকম। আমরা যতোই আশেপাশে থাকা মানুষকে কোনো একটা পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে যেতে দেখি না কেনো, কখনোই ওই পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারবো না যতক্ষণ না নিজেরা ওই পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। তাই আমার কথা শুনে আপনার হাসি আসতে পারে। চট করে বিচার করে ফেলতে পারেন যে, “নির্ঝর কি ভেবেছিলো ফুলের বিছানায় শুয়ে পিএইচডি শেষ করে ফেলবে? এসব কষ্টের কথা তো সবাই জানে! নতুন করে মাতম করার কী হলো?” আমি আপনাকে দোষ দেবো না। আমিও কি এসব বলিনি এক আমলে? যখন পিএইচডি শিক্ষার্থীরা তাদের কষ্টের কথা বলতো, মনে মনে ভাবতাম, “লোক দেখানো ঢঙ! হাজারো মানুষ যেখানে পিএইচডিতে সুযোগ পাচ্ছে না, সেখানে ইনারা সুযোগ পেয়ে ঢঙ করছেন।” কিন্তু এখন বুঝি আসল কাহিনী। অনেক ত্যাগস্বীকার করতে হয় এই জীবনে এলে। অনেকে শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্কের ব্যাপারে আলোকপাত করেন। সঙ্গীর সাথে খিটিমিটি, পরিবারের সাথে দূরত্ব তৈরি হওয়া, ইত্যাদি। আমার বেলায় ঘটছে নিজের সাথে দূরত্ব তৈরি হওয়ার ঘটনা। আমার যেসব বিষয় ভালো লাগে, সেগুলো আর চর্চা করতে পারছি না। হ্যাঁ, আমার পুষ্টিবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে ভালো লাগে। যে গবেষণাগুলো করছি, সেগুলোও ভালো লাগে। কিন্তু আমার জীবন তো শুধু এগুলো নিয়ে নয়…! আমার ভালো লাগে ছোটো গল্প লিখতে। ভালোবাসি উপন্যাস লিখতে। সেগুলো করার সময় পাই না। মাঝে মাঝে এতো হতাশ লাগে! হয়তো আজ থেকে পাঁচ বছর পর জীবনটা এরকম থাকবে না। আমি সে সময়ের কথা বলছিও না। বলছি বর্তমান সময়ের আমার আমিকে তার প্রাপ্যটুকু দেওয়ার ব্যাপারে।

Happy
Happy
18 %
Sad
Sad
45 %
Excited
Excited
18 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
18 %
Previous post কবে দেখবো নতুন ইয়র্ক?
Next post ক্যানাডিয়ান নায়াগ্রা ফলস… আর ছেলেটি