এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো, বারো, তেরো, চৌদ্দ, পনেরো, ষোল, সতেরো, আঠারো, ঊনিশ, বিশ
এই প্রশ্নটা প্রায়ই করি নিজেকে। কেমন আছি আমি? যে ‘পিএইচডি’ করার জন্য পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম, যে পিএইচডিতে ঢুকার জন্য ২০১৪ সাল থেকে চেষ্টা করে চলেছিলাম, সে পিএইচডিতে ঢুকে আমি কেমন আছি? প্রশ্নটা করা খুবই জরুরী। শুধু আমার জন্য না, যেকোনো মানুষের জন্যেই জরুরী। যে জীবনের স্বপ্ন আমরা দেখি এবং প্রচুর চেষ্টার পর সে জীবনে প্রবেশ করি, ওই স্বপ্নিল জীবনে অবশেষে আমরা কেমন থাকি? সম্প্রতি কোথায় যেন পড়লাম, মানুষ যখন তার স্বপ্ন পূরণ করে ফেলে, তখন ওই যাপিত জীবনটা আর ভালো লাগে না। মানে যে স্বপ্নের পিছে এতদিন দৌড়েছেন, সেটা পূর্ণ হয়ে গেলে আর স্বপ্নের কদর থাকবে না। আমারও একই অবস্থা। পিএইচডিতে ঢুকার আগে এই জীবন নিয়ে থাকা ফ্যান্টাসি অনেকাংশে উধাও হয়ে গেছে। কেন? কারণ পিএইচডিতে না ঢুকা পর্যন্ত এই জীবন সম্পর্কে ১০০% ধারণা হওয়া সম্ভব হয় না বলে মনের মধ্যে অনেক রকম ফ্যান্টাসি কাজ করে। হেন কারেঙ্গা, তেন কারেঙ্গা ধরনের ফ্যান্টাসি। এগুলোর অধিকাংশই পরে পূর্ণ হয় না। আবার সবই যে অপূর্ণ থাকবে, তাও না। কতোখানি ফ্যান্টাসি পূরণ করতে পারবেন সেটা নির্ভর করবে আপনার উপর। আমার ফ্যান্টাসি ছিলো আমি নিউট্রিশন ইন্টারভেনশন নিয়ে কাজ করবো। সে ফ্যান্টাসি পূরণ হয়নি। প্রোগ্রামে ঢুকার এক বছর পর আমার পিএইচডি টপিক যেটা স্থির হলো সেটা নিউট্রিশন ইন্টারভেনশনের ধারে কাছে নেই। কিন্তু এতে কি আমি অসুখী? অবশ্যই না। যে টপিক নিয়ে কাজ করছি, সেটা অনন্য এবং সময়োপযোগী। কিন্তু ওই যে, ভেবেছিলাম এক আর হলো আরেক। আরও ফ্যান্টাসি করেছিলাম যে, পেপারের পর পেপার পাব্লিশ করবো। বাস্তবে কী দেখলাম? পিএইচডির দুই বছর হয়ে যাচ্ছে অথচ প্রথম প্রোজেক্টের পাণ্ডুলিপিই চূড়ান্ত করতে পারিনি। বিশ্বাস হতে চায় না যে, এই পাণ্ডুলিপি পঞ্চান্নবারের মত পরিমার্জিত হয়েছে। এখনও পরিমার্জনা চলছে। কবে নাগাদ জার্নালে সাবমিট করতে পারবো, জানি না। একেক কো-অথর একেক দৃষ্টিকোণ থেকে মন্তব্য করেন আর আমার সেগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে পাণ্ডুলিপি পরিমার্জন করতে হয়। মজার ব্যাপার হলো, একদম প্রথমে যে পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলাম, তার সাথে এখনকার পাণ্ডুলিপির এক কণাও মিল নেই। দুটো পাণ্ডুলিপি দিয়ে দুটো পাব্লিকেশন করা যাবে। হা হা হা!
আমার আরও ফ্যান্টাসি ছিলো পিএইচডিতে ঢুকলে আমি সমগ্র পুষ্টিবিজ্ঞানের উপর কেউকেটা হয়ে যাবো। কেউ আলতু ফালতু পুষ্টিবিজ্ঞান মারালে আমি তাকে ধুয়ে দিতে পারবো। কিন্তু দিনশেষে দেখি আমি পুষ্টিবিজ্ঞানের ‘একটা’ নির্দিষ্ট টপিক নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছি। এরকম করলে কোনোমতেই সমগ্র পুষ্টিবিজ্ঞানের উপর দখল আনা সম্ভব না। আমি শুধু এই টপিকের উপর বিশেষজ্ঞ হবো, পুরো পুষ্টিবিজ্ঞানের উপর না। পিএইচডির মূল লক্ষ্যই নাকি এটা। একটা নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর বিশ্বসেরা গবেষক তৈরি করা। আমার অ্যাডভাইজর বলেন, “পিএইচডির মানে হলো তোমাকে এই বিষয়ে বিশ্বের সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি হতে হবে। পাঁচ বছর পর তোমাকে এমন জায়গায় যেতে হবে যেখানে এই ব্যাপারে তোমার চেয়ে বেশি আর কেউই জানবে না।”
আপনি গবেষণার পাশাপাশি অন্যান্য টপিক নিয়ে পড়াশোনা করতে পারেন, কেউ মানা করবে না। কিন্তু পড়াশোনা আর গবেষণা, দুটো ভিন্ন জিনিস। আমি পুরাণ নিয়েও পড়াশোনা করি। তার মানে কি আমি অ্যাড্রিয়েন মেয়রের মত পুরাণ গবেষক হয়ে গেলাম? অতি অবশ্যই না। উনি সারাজীবন পুরাণ নিয়ে গবেষণা করে আজ বিশ্বখ্যাত পুরাণ গবেষক হয়েছেন। কিংবা নীল শুবিন সারাজীবন মাটি খুঁড়ে ফসিল সংগ্রহ করে আজ বিশ্বসেরা প্রত্নতাত্ত্বিক হয়েছেন, টিক্টালিক আবিষ্কার করে বসেছেন। আর আমি? আমি ফসিল কিংবা পুরাণ নিয়ে পড়ি ঠিকই, কিন্তু সেগুলো লাফাঙ্গা ধরনের পড়াশোনা। এই ওয়েবসাইট, সেই ওয়েবসাইট ঘেঁটে পৌরাণিক কাহিনী পড়ি। একটা নির্দিষ্ট কাহিনীর আদ্যোপান্ত জানার চেষ্টা করি। কিন্তু যে তথ্যগুলো ওয়েবসাইটে আছে, সেগুলো উদ্ঘাটিত হয় কাদের মাধ্যমে? মেয়রের মত গবেষকদের মাধ্যমে। মানে গবেষকরা গবেষণা করে যা বের করেন, আমরা সেগুলো নিয়ে পড়াশোনা করে জ্ঞানী হই। একজন গবেষক একটা নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে গবেষণা করে জ্ঞান উদ্ভাবন করেন। আর আমরা বিভিন্ন গবেষকের গবেষণা পড়ে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে পণ্ডিত হই। এই হলো গবেষকদের সাথে পড়ুয়াদের পার্থক্য। পিএইচডি আপনাকে একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে বিশ্বসেরা গবেষক বানাবে, জ্যাক অফ অল ট্রেডস নয়।
যা হোক, বলছিলাম আমি কেমন আছি সে ব্যাপারে। জীবনের এই পর্যায়ে এসে “হ্যাঁ/না” ধরনের এক্সট্রিম উত্তর দেওয়া সম্ভব না। কেন? কারণ আমি ডক্টর অফ ফিলোসফির লাইনে পা দিয়েছি। এখন দর্শন কপচানো ছাড়া কোনো কথা চইলত ন। হি হি! আসলে এখন বুঝতে পারি দুনিয়া শুধু সাদা আর কালো দিয়ে ভর্তি না, এখানে ধূসর বলেও একটা জায়গা আছে। সাদা থেকে কালো বা কালো থেকে সাদার দিকে যাওয়ার সময় ধীরে ধীরে রঙ পরিবর্তন হয়। পরিবর্তন হওয়ার জায়গাটা ধূসর। গ্রে এরিয়া। বেশিরভাগ সময় আমরা গ্রে এরিয়ার মধ্যে ঘুরাঘুরি করি। এই যেমন আমি বর্তমানে ১০০% ভালো নেই, আবার ১০০% খারাপও নেই। আমি আছি অর্ধেক ভালো, অর্ধেক খারাপ। তাই এক বাক্যে “ভালো আছি” বা “ভালো নেই” না বলে “ভালো-খারাপের মাঝামাঝি আছি” বললে যুতসই হয়। কিন্তু কেন মাঝামাঝি? কেন ১০০% ভালো নেই? প্রশ্নটা এভাবে না করে করা দরকার, কে ১০০% ভালো আছে? মানুষের জীবনে সুখের অনুভূতি খুবই অস্থায়ী, কিন্তু দুঃখ চিরস্থায়ী। যে দুঃখকে মেনে নিতে শিখে, সে ভালো-খারাপের মাঝামাঝি থাকে। আর দুঃখকে মেনে নেওয়ার নাম হলো ‘পরিপক্কতা’। আমার পিএইচডি জীবনের ফ্যান্টাসিগুলো এক এক করে গায়েব হয়ে যাচ্ছে দেখে মন খারাপ হয় ঠিকই, কিন্তু আমি এখন পরিপক্ক হতে শিখেছি। তাই বাস্তবতা মেনে নিয়ে দুঃখের সাগরে ভেসে যাচ্ছি না, ভালো-খারাপের মাঝামাঝি আছি। কিন্তু একটা ব্যাপারে এখনও পরিপক্ক হতে পারিনি বলে খুব দুঃখ লাগে। ব্যাপারটা হলো ভ্রমণ করা। পঞ্চাশটা অঙ্গরাজ্য দেখার স্বপ্ন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলাম। কিন্তু সেটা পূরণ হচ্ছে না। কী এক ফালতু অঙ্গরাজ্যে যে থাকি! উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম যেদিকেই যাই, আট ঘণ্টা ধরে কেবল টেক্সাসই পাড়ি দিতে হয়। এজন্য গাড়ি চালিয়ে কোথাও যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। ঠা ঠা সূর্যের তাপে গাড়ির ভিতর এসি চালিয়েও শান্তি পাওয়া যায় না। যা হোক, এখানেও নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখছি। খুব করে চাইছি বর্তমানে বাঁচতে। যেটুকু আছে, সেটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে।
আমি ইদানীং পিএইচডি মিমগুলোর সাথে খুব একাত্মতা অনুভব করি। আগে বুঝতাম না মানুষ (পড়ুন বর্তমান বা প্রাক্তন পিএইচডি শিক্ষার্থীরা) কেন এরকম ব্যাঙ্গাত্মক মিম তৈরি করে নিজেদের নিয়ে। এখন বুঝি। সুযোগ পেলে আপনারাও মিম পেইজগুলোতে লাইক মেরে পাশে থাকতে পারেন। প্রতিদিন একবার এসব পেইজে ঢুঁ না মারলে দিনটা পানশে মনে হয়। আমার মত আরও অনেক পিএইচডি শিক্ষার্থী একই সংগ্রাম বা মানসিক অশান্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এটুকু জানতে পারলেই সান্ত্বনা লাগে। শেষমেশ বলতে চাই, জীবনানন্দ দাশ বহু আগেই আমাদের মত পাবলিকদের নিয়ে লিখে গেছেন “যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের— মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা”। একটু ওলট পালট করে বলা যায়, যে-জীবন ফ্যান্টাসির, সুখের— পিএইচডি শিক্ষার্থীর সাথে তার হয়নাকো দেখা…