এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো, বারো, তেরো, চৌদ্দ, পনেরো, ষোল, সতেরো, আঠারো, ঊনিশ, বিশ
আজকে আবার সেই কাহিনী… রাতে ঘুম হয়নি। রাত দেড়টা পর্যন্ত ঢুলতে ঢুলতে ল্যাপটপের পর্দার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এক পর্যায়ে প্রিন্স এসে ঠ্যালা দিলো, “ঘুমাবা না?” ঠ্যালা খাওয়ার পর মনে হলো, অনেক হয়েছে, এবার ঘুমাতে যাই। কিন্তু বিছানায় শোয়ার পর আর ঘুম এলো না। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে এক পর্যায়ে মুখবই, ইন্সটাগ্রাম, লিংকডইন সব ঘুরে ফেললাম, ঘুম আসার নাম নেই। প্রিন্স মাথায় বিলি কেটে দিলো। সে আরামে চোখ বুজে শুয়ে থাকলাম। কিন্তু যেই না বিলি কাটা বন্ধ হলো, অমনি ঘুম টুটে গেলো। কয়েক মিনিট মটকা মেরে পড়ে থেকে দেখলাম ঘুম আসে কিনা। ন্যাহ। তাই মোবাইল হাতে নিয়ে আবারও ঢুঁ মারলাম মুখবই, ইন্সটাগ্রাম, লিংকডইনে। এরপর পড়লাম ক্যান্ডি ক্রাশ নিয়ে। যা শালা! ঘুম না আসা পর্যন্ত গেমই খেলবো। আজ আমি তিন হাজার ধাপ অতিক্রম করেছি, কিন্তু ৩০০২ ধাপের পর আর আগাতে পারছি না। খুব কঠিন একটা ধাপ। পাঁচটা লাইফ শেষ করার পর মেজাজ তিরিক্ষে হয়ে গেলো। এই মেজাজ নিয়ে আর যাই হোক, ঘুম হবে না। চুপচাপ শুয়ে রইলাম। একটু পর বুঝলাম গেম আমাকে খেলে দিয়েছে। ঘুম পুরোপুরি ছুটে গেছে। এখন কী করি? আবার ঢুঁ মারো মুখবই, ইন্সটাগ্রাম, লিংকডইনে। এই করতে করতে ভোর ছয়টা বেজে গেলো। বুঝে গেছি ঘুম আর আসবে না। এতক্ষণ ধরে ফালতু কাজে সময় নষ্ট করেছি বলে মেজাজ দ্বিগুণ খারাপ হলো। ইচ্ছে করলেই পারতাম পড়াশোনা করতে বা অন্যান্য কাজ এগিয়ে রাখতে। কতগুলো যে ইমেইল লিখতে হবে সকালে উঠে! সেগুলো ড্রাফ্ট করে স্কেজিউল করে রাখলেও হতো মুখবইয়ে স্ক্রল করার চেয়ে। যাই হোক, সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি। দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠলাম। প্রিন্স ঘুমিয়ে কাদা। ওর যাতে সমস্যা না হয় সেজন্য বিড়ালের মত নিঃশব্দে পা টিপে টিপে রান্নাঘরে গেলাম। কফি পট থেকে মগে কফি ঢাললাম। আমি একবারে দশ কাপের মত কফি বানিয়ে রাখি। পরপর দুইদিন চলে যায়। কে প্রতিদিন কফি বানায় এতো? কফি নিয়ে পড়ার ঘরে এলাম। এসে ল্যাপটপ খুলে বসেছি ব্লগ পোস্ট লিখতে। সারাদিন কাজের ঝামেলায় মুড আসে না লেখার। আবার মুড এলে দেখা যায় সময় নাই। এখন সময় আর মুড দুটোরই বিরল সম্মেলন ঘটেছে। তাই চট করে লিখে ফেলছি।
যতো বয়স হচ্ছে, ততো যেন ছোটবেলার কথা বেশি বেশি মনে পড়ছে। সবকিছুতেই আমি ছোটবেলার কথা মনে করে নস্টালজিয়ায় ভুগি। সেটা প্রিন্সের সাথে ভাগাভাগি করে ওকেও নস্টালজিয়ায় ফেলে দিই। এই যেমন একটু আগে বিছানায় শুয়ে শুয়ে দিব্যি অনুভব করছিলাম ছোটবেলায় কীভাবে মা ঘুম থেকে ডেকে দিতো। তখন কতই বা বয়স? রাত দশটা বাজলেই ঘুম। সকাল ছয়টার দিকে মা গায়ে ঠ্যালা মেরে ঘুম থেকে উঠাতো, “নির্ঝর, উঠ। স্কুলে যেতে হবে।” উফ! স্কুলের নাম শুনলেই রাগে, দুঃখে কান্না পেয়ে যেত। কেন সকাল সাতটায় স্কুল শুরু করতে হবে? কেন সকাল দশটায় শুরু করা যায় না? তাহলে সকাল নয়টা পর্যন্ত ঘুমিয়ে স্কুলে যেতে পারতাম! আহা রে, ছোট্ট নির্ঝর ঘুম ঘুম চোখে বিছানা থেকে নেমে টাট্টিখানার দিকে এগুতো। ঝান্দি তখন আমাদের বাসায় কাজ করতো। দিদির আসল নাম ছিলো জানকী রায় বর্মণ। আমরা ‘জানকীদি’ বলতে পারতাম না। বলতাম জান’দি। সেখান থেকে বলার সুবিধার্থে একদিন দেখি ঝানদি বা ঝান্দি হয়ে গেছে। একই কাহিনী আমার এক বন্ধুর বেলায়ও ঘটেছিলো। ওদের বাসায় কাজ করতো হরিপদ নামের এক লোক। তাকে পদ’দা ডাকতে ডাকতে একদিন সবাই খেয়াল করলো নাম হয়ে গেছে পদ্মা। তো, ঝান্দিও মায়ের ডাকাডাকিতে উঠে রুটি বেলতে বসতো। ডিম ভাজা দিয়ে রুটি সাঁটিয়ে আমি দৌড় দিতাম স্কুলে। যখন কিশোর বয়স, তখন আর মাকে গায়ে ঠ্যালা দিতে হতো না। পাশের ঘর থেকে মা আমার ঘরে এলেই টের পেয়ে যেতাম। তারপরও মা কখন টিউব লাইট জ্বালাবে, সেটার জন্য অপেক্ষা করতাম। ওই এক মিনিটের ঘুম যেন সারারাতের ঘুমের চেয়েও প্রিয় ছিলো। আর এখন? এখন কারো ডেকে দিতে হয় না। এলার্ম সেট করে ঘুমাই, এলার্ম বাজার আগেই উঠে যাই। মনের ঘড়ি টিকটিক করে উঠিয়ে দেয়। রাত জাগি ইচ্ছেমত, বকা দেওয়ার কেউ নেই। ইচ্ছেমত ঘুমাতে যাই, চার ঘণ্টা-আট ঘণ্টা-বারো ঘণ্টা যতক্ষণ ইচ্ছে ঘুমাই, কথা শোনানোর কেউ নেই। কতো বড় হয়ে গেছি আমি! কতো স্বাধীনতা আমার। পাঠকেরা যদি ভাবেন আমি মন খারাপ করে বলবো, “ছোটবেলার দিনগুলোই ভালো ছিল। এই স্বাধীনতা ভালো লাগে না”, তাহলে ভুল। আমি এই স্বাধীনতা অত্যন্ত উপভোগ করি। ছোটবেলার ঐসব দিনের কথা মনে পড়লে এখনও রোম দাঁড়িয়ে যায়।
যা হোক, বলছিলাম পিএইচডি করতে এসে নির্ঘুম রাতের কথা। ঘুম না হওয়া একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। সবসময় শরীর নিয়ম মেনে চলতে চায় না। তাই কালেভদ্রে ঘুম না হওয়াকে আমি তেমন পাত্তা দিই না। এটা নিয়মিত হতে থাকলে সমস্যা। তখন দেরী না করে চিকিৎসকের সাথে কথা বলা উচিৎ। আমার যেহেতু এই সমস্যা কদাচিৎ হয়, আমি তেমন গা করি না। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়, রাত জেগে আমি নিজেকে উচ্চশ্রেণীর মানব সন্তান প্রমাণ করি। কথাটা আছে আয়নাঘর উপন্যাসে। হুমায়ূন আহমেদের লেখায় আমার হাতেখড়ি হয়েছিলো এই উপন্যাসের মাধ্যমে। না পড়া থাকলে পড়ে ফেলুন। উচ্চমার্গীয় আধিভৌতিক উপন্যাস। তো, কেন আজ রাতে আমি উচ্চশ্রেণীর মানব সন্তান হয়ে বসে আছি সেটা বের করার জন্য ফেলুদার কায়দায় কিছুক্ষণ ভাবলাম। গতকাল রাতে মাংস দিয়ে ভাত খাওয়ার সময় তিনটা কাঁচামরিচ চটকে খেয়েছি। তিনটা মরিচ হয়তো অনেকের কাছে নস্যি। কিন্তু মাংসটাও ছিলো ঝাল। ঝালে ঝালে পেটের রমরমা অবস্থা। তার উপর পান করেছিলাম দুই মগ কফি। সাধারণত আমি সকাল বেলায় বিশাল এক মগ কফি সাঁটাই। এরপর পানীয় পানের ইচ্ছে জাগলে কালো চা খাই। কিন্তু গতকাল যে টিভি সিরিজ দেখছিলাম, সেখানে নায়ক নায়িকা কফি খাচ্ছিলো। দেখে এমন কফি খাওয়ার ঝোঁক উঠলো! না পারতে বিকেলবেলায় আরেক মগ কফি খেয়ে ফেললাম। দ্বিতীয় দফার সে বৈকালিক কফি আর রাত্রিকালীন ঝাল অভিযান আমাকে চিৎপটাং করলো রাত দেড়টায়। তবে কফির কাছে হেরে না গিয়ে আমি আবারও কফির মগ হাতে বসে পড়েছি টেবিলে। এক চুমুক কফি খাই আর ব্লগ লিখি। ব্লগ প্রকাশ করে বসবো পিএইচডির কাজ নিয়ে। ঐ যে বলে না, হোয়েন লাইফ গিভস ইউ লেমন, মেইক লেমনেড? জীবন যখন তোমাকে সোদে, তুমিও হালকা মুতে সুদে দাও? আমিও তাই করছি।