0 0
Read Time36 Minute, 7 Second

অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত ব্লগ পোস্ট চলে এল, পাঠক। যার অপেক্ষায় আপনারা এই ওয়েবসাইট প্রকাশ করার সময় থেকে বসে আছেন, সেই খবর দেওয়ার জন্য বান্দা হাজির। ২০১৯ সাল থেকে আপনারা পড়ছেন যে, যেকোনো ভ্রমণে আমার দায়িত্ব হল প্যাসেঞ্জার প্রিন্সেস হয়ে ঝিমানো। ড্রাইভ করার লাইসেন্স পাইনি বলে দূরপাল্লা তো বটেই, ‘ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া’ দূরত্বের ওয়ালমার্টেও গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার জো আমার ছিল না। একটু কিছু হলেই প্রিন্সকে বগলদাবা করে বের হতে হত। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? অন্য কেউ হলে এভাবে মাস কয়েক ঝিমিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠত। জিদ্দের ঠ্যালায় বাগিয়েই ফেলত লাইসেন্সখানা। কিন্তু আমি হলেম হাবলঙ্গের বাজারের ওই চরিত্রের মত, যে কিনা এক ডায়ালগ মেরেই আমার মনে স্থান করে নিয়েছে। তার “আমি বিবাহ করব না, আমার লইজ্জা লাগে”-এর মত আমিও “রোড টেস্ট দিব না, আমার ডর লাগে” জ্বরে আক্রান্ত। এই জ্বর নিয়েই কাটিয়ে দিলাম সাত সাতটি বছর।

জ্বর সারানোর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময় লাইসেন্স বাগানোর স্বপ্ন নিয়ে পোস্ট লিখেছি [, ]। তাতেও কাজ হয়নি। যেটা কাজে দিলো সেটা হল, মা-বাবার যুক্তরাষ্ট্রে ঘুরতে আসা। দুই সপ্তাহ পর উনারা আসবেন। উনাদের অনেক স্বপ্ন মেয়ে গাড়ি চালিয়ে উনাদের ঘুরাবে। সেটাই আমার প্রেষণা হয়ে দাঁড়াল। সাত বছর পরীক্ষা ‘দিচ্ছি, দিব’ করে করে টাইম পাস করলেও এইবার একদিনের ভেতর ঠিক করে ফেললাম পাশ করি আর ফেল মারি, পরীক্ষা আমি দিবই। প্রিন্সকে গিয়েও কথাটা বললাম। এটা কলেজ স্টেশনে থাকার সময়। তখন ছিল ২০২৫ সালের জুন মাস। প্রিন্স আমাকে নিয়ে আবারও এক বছর পর অনুশীলনে বের হল। ‘আবারও’ বললাম কারণ প্রতি এক বা দুই বছর পর পর আমার মাথায় ড্রাইভিং শেখার ক্যাড়া উঠে আর প্রিন্স আমাকে নিয়ে অনুশীলনে বের হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার আর টেস্ট দেওয়া হয়ে উঠে না। হয় আমার নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়, অথবা প্রিন্স বলে যে, আমি যথেষ্ট প্রস্তুত না। যা হোক, এইবার প্র্যাকটিস করতে নেমেও হাঁটু কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেল। প্রতিবারই হয়। কোথায় যেন পড়েছিলাম, যত বয়স বাড়তে থাকে, মানুষের ড্রাইভিং শেখার আতংক তত বাড়তে থাকে। তরুণ তুর্কি থাকা অবস্থায় মানুষের চ্যালেঞ্জ নেওয়ার মানসিকতা বেশি থাকে। “যা হয় হোক” ধরনের চিন্তাভাবনা থাকে। এজন্য চট করে ড্রাইভিংয়ের মত চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার আয়ত্ব করে ফেলে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষ অনেক কিছু নিয়ে চিন্তা করা শুরু করে, ‘যা হয় হোক’ ধরনের মানসিকতা কমতে থাকে। এজন্য ড্রাইভিং শিখতে গেলে মাথায় ঘুরতে থাকে “আমাকে দিয়ে হবে না।” একবার এই চিন্তা ঢুকলে আমি জানা জিনিস ভুল করা শুরু করি। এইবারও করলাম। তারপরও প্রিন্স তিনদিন আমাকে নিয়ে বের হল। শেষদিন হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “আমি আর পারব না তোমার সাথে প্র্যাকটিস করতে। একই জিনিস গত সাত বছর ধরে শিখাতে শিখাতে আমি ক্লান্ত। যদি ড্রাইভিং শিখতেই চাও, প্রোএকটিভ হয়ে শিখ। আমি যখন শিখেছি, তখন রাস্তায় প্র্যাকটিসের পাশাপাশি ইউটিউবেও শ’খানেক ভিডিও দেখেছি কীভাবে কী করে। এতটাই প্যাশনেট ছিলাম শিখার ব্যাপারে। কিন্তু তোমার মধ্যে ওই প্যাশন আমি দেখছি না।”

প্রিন্সের হতাশা পুরোপুরি যৌক্তিক। ঝামেলা আমারই। রাস্তায় গাড়ি নিয়ে নামলেই আমি আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ি, দুঃচিন্তা ঘিরে ধরে। ফোবিয়া ধরনের অযৌক্তিক ভয়। এমন না যে, আমি কখনো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটিয়েছি বা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছি। তারপরও এক্সিডেন্ট করার এমন একটা ভয় আমাকে পেয়ে বসে যে, জানা জিনিস ভুল করা শুরু করি। ট্রাফিক সিগন্যালের মানে ধরতে সময় লাগে। লেইন বদল করতে গিয়ে লেইনচ্যুত হয়ে যাই, বা সময়মত বদল করতে পারি না (বার বার মনে হয় পিছনের গাড়ি গতি কমিয়ে আমাকে মার্জ করার সুযোগ দেবে না, বরং এসে ধাক্কা মারবে), মিররে চোখ রাখতে কিংবা ব্লাইন্ড দেখতে ভুলে যাই – এইসব। বলুন, এগুলো কি প্রশিক্ষকের বিরক্তির উদ্রেক করবে না?

তো, প্রিন্সের বকা খেয়ে ধরলাম আমার ইরানী বালিকাকে। সে আমাকে আল্টিমেটাম দিয়েছিলঃ এইবার আর ড্রাইভিং পারমিট রিনিউ করবা না। ডাইরেক লাইসেন্স নিবা। পারমিট রিনিউ করলে তোমাকে আমি খুন করব। যে এই কথা বলতে পারে, সে নিশ্চয় খুশি মনে আমাকে প্রশিক্ষণ দিবে? কিন্তু না, ইরানী বন্ধু বলল, আমার গাড়িতে যেহেতু ডুয়াল ব্রেক নেই, সে ইন্সট্রাক্টর হতে ভয় পাচ্ছে। ডুয়াল ব্রেক হল প্যাসেঞ্জারের বসার জায়গায় আরেকটা ব্রেক সিস্টেম থাকা। ড্রাইভিং স্কুলগুলোতে এই ধরনের গাড়ি ব্যবহার করা হয়। শিক্ষানবিশ যদি কোন অঘটন ঘটাতে যায়, তাহলে প্রশিক্ষক চট করে প্যাসেঞ্জার সাইডে থাকা ব্রেক কষতে পারে। যেহেতু আমার গাড়িতে এটা করা যাবে না, তাই সে আমাকে নিয়ে রাস্তায় নামতে ভরসা পাচ্ছে না। শুনে মনটা খারাপ হল। তবে এটাও ঠিক, সাহার অযৌক্তিক কিছু বলেনি।

জুলাই মাসে আমরা কলেজ স্টেশন থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে হিউস্টন চলে এলাম। এখানকার ট্রাফিক ভয়াবহ। হাইওয়েতে বেশিরভাগ চালক আন্দাগোন্দা টান দিচ্ছে। ইনডিকেটর ছাড়াই লেইন বদলাচ্ছে। এক ইঞ্চি জায়গা পেলে গাড়ি ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এরকম একটা জায়গায় এসে কি ড্রাইভিং টেস্ট দেওয়ার সাহস আমি পাব, যেখানে কলেজ স্টেশনের মত শান্তশিষ্ট জায়গাতেই পারিনি? তাই পুরো জুলাই মাস ধরে থম মেরে বসে রইলাম। বার বার মনে হতে লাগল কেন কলেজ স্টেশনে চার বছর কাটানোর সময় লাইসেন্সটা নিলাম না? একবার এটাও মনে হল, হিউস্টনে মুভ করেছি তো কী হয়েছে? কলেজ স্টেশনে গিয়ে পরীক্ষা দিব। কিন্তু কোনো চিন্তাই প্র্যাগমেটিক মনে হয় না। আগস্টে এসে বার বার মনে হতে লাগল, আর দুই মাস পর মা-বাবা আসবেন। উনাদেরকে কি আমি গাড়ি চালিয়ে আমেরিকা দেখাতে পারব না? ছোট ভাই কানাডায় আসার এক বছরের মধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে নতুন গাড়ি কিনে ফেলেছে। আর আমি সাত বছর হল গাড়ি কিনেছি, ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে পারলাম না। এরমধ্যে কত কঠিন কঠিন জিনিস বাগিয়ে ফেললাম (মাস্টার্স ডিগ্রি, পূর্ণকালীন চাকরি, পিএইচডি ডিগ্রি, পোস্টডক্টরাল ফেলোশিপ), অথচ ড্রাইভিং লাইসেন্স বাগানো হল না। নিশ্চয় বুঝতে পারছেন আমি কোন পর্যায়ের ভয় পেতাম এই ব্যাপারকে। এটাকে ফোবিয়া বলব না তো কী?

আগস্টের শেষ দিকে হঠাৎ মাথায় এল ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা। কিছু ড্রাইভিং স্কুল আছে যারা দেড়শ-দুইশ ডলারের মধ্যে ঘণ্টা দুই প্রশিক্ষণ দেয়, এরপর কিছু ফি’র বিনিময়ে রোড টেস্ট নেয়। ওদের কাছে শিখে ওদের কাছেই টেস্ট দিতে নিশ্চয় সহজ লাগবে? স্থির করে ফেললাম, আমি এটাই করব। মনঃস্থির করার পর এই প্রথম আমি প্যাশন নিয়ে ইউটিউব ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলাম। প্যারালাল পার্কিং নিয়ে গবেষণা শুরু করলাম। খাতায় এঁকে এঁকে ভিজুয়ালাইজ করার চেষ্টা করলাম কোন ধাপের পর কোন ধাপ। দেখা শুরু করলাম বিভিন্ন ম্যানুভার কীভাবে করে। টেক্সাস ডিপার্টমেন্ট অফ পাবলিক সেফটি (ডিপিএস) ওয়েবসাইট থেকে মুফতে ড্রাইভার হ্যান্ডবুক নামিয়ে বিভিন্ন সাইন আর সিগন্যাল, সাথে রাস্তার নিয়ম কানুন (কখন কার প্রায়োরিটি, কখন কাকে রাইট অফ দা ওয়ে দিতে হবে, ইত্যাদি) সম্পর্কে পুরনো জ্ঞান ঝালাই করে নিলাম। সাথে আরেকটা কাজ করলাম। রেডিটে (reddit.com) গিয়ে আমার মত যারা আতংকে থাকে ড্রাইভিং পরীক্ষা নিয়ে, তাদের অভিজ্ঞতা পড়া শুরু করলাম। কেন তারা ভয় পায় এবং কীভাবে এই অনুভূতি থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়, সে সম্পর্কে আলাপচারিতা। ওখান থেকে দারুণ এক মন্তব্য পড়লাম। এই মন্তব্য আমার ভয় কাটাতে সাহায্য করল। মন্তব্যটা হলঃ “সবাই বলে অন্য চালকদের বিশ্বাস না করতে। বলে, “গাড়ি এমনভাবে চালাবা, যেন তুমি বাদে আর সবাই পাগল।” আমিও এই কথা মাথায় রেখে প্র্যাকটিস শুরু করেছিলাম। কিন্তু কথাটা সারাক্ষণ মাথায় পিনপিন করত। মনে হত, এত পাগলে ভরা রাস্তায় কীভাবে গাড়ি চালাব? প্রচণ্ড চাপ অনুভব করতাম আর ঠিকমত ড্রাইভিং করতে পারতাম না। এমন সময় এক পরিচিতজন বলল, “তুমি যেমন ভাবছ তুমি বাদে সবাই পাগল, অন্য গাড়িতে যারা বসে আছে, তারাও ঠিক এটাই ভাবছে। ভাবছে, সে ছাড়া বাকিরা পাগল। তাই সবাই যার যার মত চেষ্টা করছে নিরাপদে গাড়ি চালানোর। তার মানে তুমি আসলে অন্য ড্রাইভারদের বিশ্বাস করতে পার। হ্যাঁ, সময়ে সময়ে বেপরোয়া চালক দেখবা। কিন্তু বেশিরভাগ চালকই সাবধান। তারা তোমাকে সাহায্যই করবে।” এই কথা শোনার পর আমার মাথা থেকে দুঃচিন্তা কেটে গেল। এখন আমি সাবধানে গাড়ি চালাই ঠিকই, কিন্তু অহেতুক চাপের মধ্যে থাকি না।” এই মন্তব্য দেখার পর থেকে, সত্যি বলতে, আমিও ভারমুক্ত হয়ে গেলাম। অনেকখানি আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম। এই করতে করতে পার হয়ে গেল সপ্তাহ খানেক। এরপরই ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা।

মাথায় আত্মবিশ্বাস এমনই চাড়া দিয়ে উঠল যে, মনে হল, আমি কোচিং ছাড়াই পরীক্ষায় বসতে পারব। দরকার শুধু প্রিন্সের সাথে শেষ মুহূর্তের কয়েকটা সিটিং। গেলাম প্রিন্সের কাছে। প্রিন্স আমার আত্মবিশ্বাস দেখে কোনোরকম হাংকি পাংকি ছাড়াই রাজী হয়ে গেল প্র্যাকটিস সেশনে যেতে। আমি বিশাল বক্তৃতা ঠিক করে এসেছিলাম ওকে দেওয়ার জন্য। কিছুই দিতে হল না। হয়ত আমার কণ্ঠে এমন কিছু ছিল, যেটা শুনে ও বুঝে গিয়েছিল আমি এবার প্যাশন নিয়েই ড্রাইভিং প্র্যাকটিস করতে যাচ্ছি! প্রিন্স রাজী হওয়ার সাথে সাথে আমি হিউস্টন ডিপিএসের গেসনার শাখায় তিন সপ্তাহ পর একটা রোড টেস্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিলাম। চিন্তা করতে পারেন আমি থার্ড পার্টির কাছে নয়, বরং সত্যিকার ডিপিএস অফিসারদের কাছে পরীক্ষা দেওয়ার মত সিদ্ধান্ত নিচ্ছি? লোকে বলে থার্ড পার্টির কাছে পরীক্ষা দেওয়া সোজা, কারণ ‘অফিসার’ জিনিসটাই ভয়ের। অথচ আমার এখন মন চাচ্ছে ডিপিএস অফিসারদের কাছে পরীক্ষা দিতে। এখানে পরীক্ষা দিতে লাগে ১১ ডলার, যেখানে থার্ড পার্টির কাছে লাগে ৮৫ ডলার।

টেস্ট শিডিউল করার পর ইউটিউবে ঢুঁ মারলাম যেসব রাউটে গেসনারের টেস্ট হয়, সেগুলোর ভিডিও খুঁজতে। যারা পরীক্ষা দেয়, তারা অনেক সময় পুরো পরীক্ষা ভিডিও করে ইউটিউবে আপলোড করে। ভবিষ্যৎ পরীক্ষার্থীরা সেখান থেকে ধারণা পায় কোন রাস্তাগুলোয় পরীক্ষা নেওয়া হয়। রাস্তা কেবল একটা নয়। একই অফিস থেকে ভিন্ন ভিন্ন রাস্তা ব্যবহার করে পরীক্ষা নেওয়া হতে পারে। কিন্তু আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও গেসনার অফিসের কোনো ভিডিও পেলাম না ইউটিউবে। অন্য অফিসেরগুলো আছে, শুধু এটারই নেই। তবে রেডিটে একটা পোস্ট পেলাম যেখানে গেসনারে টেস্ট দিয়েছিল এমন একজন তার অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেছিল। ওই অভিজ্ঞতা পড়ে মনে হল, ভিডিও না দেখলেও চলবে। এভাবে কয়েকবার প্র্যাকটিস করলেই সাহস পাব। তাছাড়া এই অফিস আমাদের বাসা থেকে সবচেয়ে কাছে। অন্য অফিসে পরীক্ষা দিতে চাইলে ঘণ্টাখানেক দূরে যেতে হবে। তাই ‘যা হয় হোক’ ভেবে এখানেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট বহাল রাখলাম।

মাত্র তিন সপ্তাহ হাতে রেখে শিডিউল করেছি। আমার ধারণা আমি যদি দুইদিন দুই ঘণ্টা করে প্র্যাকটিস করি, তাহলেই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাব। বুঝতে পারছেন আত্মবিশ্বাস কোন পর্যায়ের চাঙ্গা এবার? কিন্তু প্রিন্স একটু অসুস্থ থাকায় তিন সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও আমরা অনুশীলনে যেতে পারলাম না। ফলে শিডিউল বাতিল করে দশদিন পরের আরেকটা শিডিউল নিলাম। বাবা-মা আসার ঠিক দুই সপ্তাহ আগে। যদি পরীক্ষায় ফেল করি, তাহলে বাবা-মা আসার আগে আরও দুইবার পরীক্ষায় বসার সুযোগ পাব। তো, দ্বিতীয়বার শিডিউল করার পর হিউস্টন ডিপিএসের অন্য অফিসের ভিডিওগুলো দেখে কোন (cone) ব্যবহার করে কীভাবে প্যারারাল পার্কিং করে সেটা মাথায় সেট করে নিলাম। অদ্ভুত ব্যাপার হল, এর আগে যতবার প্যারারাল পার্কিংয়ের ভিডিও দেখেছি, ভূতুড়ে আর অশৈলী লেগেছে। মনে হয়েছে এরকম কঠিন একটা ম্যানুভার টেস্টে রাখার কী দরকার? অথচ এবার আমি দিব্যি বুঝে গেলাম স্টিয়ারিং হুইল কয়বার টার্ন করে, কোন এংগেলে গাড়ি কতখানি পিছিয়ে প্যারারাল পার্কিং করতে হবে। যেহেতু পরীক্ষায় পাশের জন্য আমার cone ব্যবহার করে প্যারারাল পার্কিং শিখলেই চলছে, তাই বাস্তবে দুই গাড়ির মধ্যে কীভাবে প্যারারাল পার্কিং করে, ঐদিকে আর দুঃচিন্তা নিলাম না।

পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগের উইকেন্ডে গেলাম গেসনার ডিপিএসে। অন্য রাস্তায় যত ভাল প্র্যাকটিসই করি না কেন, যেখানে টেস্ট হবে, ওই রাস্তায় এক-দুইবার প্র্যাকটিস করা বুদ্ধিমানের কাজ। গিয়ে যেখানে প্যারারাল পার্কিং করাবে, ওইখানে অনুশীলন করলাম অনেকবার। প্রথম প্রথম আমি হিসেব কষে পার্কিং করছিলাম। প্রিন্স বলল যতক্ষণ না পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে পার্কিং করছি (হিসেব করা ছাড়াই), ততক্ষণ প্র্যাকটিস করতে। ছয়-সাতবার প্র্যাকটিসের পর হঠাৎ মাথায় গোলমাল লাগল। কিছুতেই ঠিকমত পার্কিং করতে পারলাম না। বেশি পারফেক্ট করতে গিয়ে মাথার তার ছিঁড়ে গেছে। তখন গিয়ে আশেপাশের পাড়ার ভিতরে প্র্যাকটিস করে এলাম। ডিপিএস অফিসগুলো এমন জায়গায় থাকে যার আশেপাশে আবাসিক এলাকা আর হাইওয়ে থাকবে (ফ্রি ওয়ে নয়)। সে হিসেবে গেসনার অফিসের ঠিক পাশের নেইবারহুডেই পরীক্ষা নেওয়ার কথা। আমরাও ওখানে প্র্যাকটিস করলাম। ঠিক কোন রাস্তায় পরীক্ষা হবে সেটা যেহেতু জানি না, তাই অনেকগুলো রাস্তায়ই ঘুরলাম। এক জায়গায় দেখলাম গাছের আড়ালে স্টপ সাইন লুকিয়ে আছে। অন্য সময় হলে এটা চোখেই পড়ত না। কিন্তু এখন ড্রাইভিংয়ের সময় আমার মাথা অনেক সচেতন থাকে। তাই চোখে পড়ল আর সুন্দরমত থামলামও। এরপর আবার গেলাম প্যারারাল পার্কিং প্র্যাকটিস করতে। এবারও প্রথম দুই-তিনবার ঠিক হল, কিন্তু পরেরগুলো যাচ্ছেতাই হওয়া শুরু করল। প্রিন্সকে বললাম, “আমার যেহেতু একবারই এটা করে দেখানো লাগবে, তাই মনে হচ্ছে প্রথমবার যেহেতু ঠিকমত পারছি, পরীক্ষার সময়ও প্রথমবারেই পেরে যাব।”

পরীক্ষার আগেরদিন আরেকবার গেলাম ডিপিএসে। আবারও প্যারারাল পার্কিং প্র্যাকটিস করে নেইবারহুড ঘুরলাম। তারপর হাইওয়ে দিয়ে ডিপিএস অফিসে ফেরত এলাম। মনে হল এটাই সম্ভাব্য রাউট। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আমার মনে একটুও ভয় কাজ করছে না যে, আগামীকাল পরীক্ষা। For god’s sake, it’s that damn road test, Nirjhar! সাত বছর যে জিনিসের ভয়ে জবুথবু হয়ে সময়ে সময়ে নিজেকে অকর্মণ্য, অপদার্থ মনে হত, সে জিনিস আমাকে একটুও কাবু করতে পারছে না। ফুরফুরে মনে বাসায় ফিরে ভাল একটা ঘুম দিলাম। পরদিন দুপুর দুটোয় পরীক্ষা। অন্তত আধাঘণ্টা আগে অফিসে হাজিরা দিতে হবে। তার আগে গাড়িতে গ্যাস নেব আর ওয়াশ করব। গাড়ির চেহারা ভয়াবহ। ধুলো জমে এমন অবস্থা যেন ভাগাড় থেকে উঠিয়ে এনেছি।

পরীক্ষার দিন (সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫)

সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রাঞ্চ করলাম ভাত দিয়ে। দুপুরে যেহেতু খাওয়া হবে না, তাই ভারী কিছু খেয়ে পেট ভর্তি রাখা। এরপর রেডি হয়ে দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ রওনা দিলাম গ্যাস ভরতে। ভরে গেলাম এক কার ওয়াশে। আমাদের যেহেতু তাড়াহুড়া ছিল, তাই সামনে যে কার ওয়াশ পেয়েছি, ওটাতেই ঢুকে গেলাম। গিয়ে দেখি একদম বেসিক ওয়াশ করতেই এরা ২৬ ডলার নিচ্ছে। কাহিনী কী? কলেজ স্টেশনে ১২ ডলার দিয়ে বেসিক ওয়াশ করে হিউস্টনে এসে ২৬ ডলার শুনে অবাস্তব লাগল। কিন্তু হাতে সময় নেই বলে ওদের কাছেই করব ঠিক করলাম। একজন কর্মী এসে আমাদের বলল গাড়ি থেকে নামতে। সে নাকি গাড়ির ভিতরে ভ্যাকুয়াম করবে। অ্যাঁ! কলেজ স্টেশনে আমি আর প্রিন্সই ভ্যাকুয়াম করতাম। এই কারণেই কি ২৬ ডলার? আমাদের কিছু করা লাগবে না, আমরা খড়ের ছাউনির নিচে বসে অপেক্ষা করব। বা রেস্তোরাঁর ভিতর খানাও অর্ডার দিতে পারব। বুঝলাম বড়লোকি কার ওয়াশে চলে এসেছি। যা হোক, বেশ সময় নিয়ে ভ্যাকুয়াম করে ওরা গাড়ি পাঠিয়ে দিল ওয়াশে। আমরা ছাউনির নিচে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্রায় দশ মিনিট লাগিয়ে গাড়ি ওয়াশ হয়ে বাইরে এল। আমরা গিয়ে গাড়ির কাছে দাঁড়ালাম। কিন্তু এক লোক এসে বলল কাজ নাকি এখনও শেষ হয়নি। শেষ হলে আমাদেরকে ডাকা হবে। আমরা আবার ছাউনিতে এসে বসলাম। মনে পড়ল Love Actually সিনেমার ওই দৃশ্য, যেখানে প্রফেসর স্নেইপ স্ত্রীর থেকে লুকিয়ে একটা সোনার লকেট কিনতে এসেছেন আর মিস্টার বিন দশ মিনিট ধরে সেই লকেট প্যাকেট করছেন। প্রতি মিনিটে স্নেইপের স্ত্রীর লকেটটা দেখে ফেলার চান্স বাড়ছে…

ঘড়িতে যখন একটা বিশ, তখন আমরা গাড়ি ফেরত পেলাম। এক কর্মী চাকায় কীসব ক্রিম মাখিয়ে, ঘষে, চাকা চকচকে করে ফেলেছে। আমরা মুগ্ধ হয়ে হালকা বখশিশ দিলাম। তারপর প্রিন্স বলল আমিই যেন গাড়ি চালিয়ে ডিপিএসে যাই। ভাল বুদ্ধি। এতে করে আমার ওয়ার্ম আপ হবে। গাড়িতে ঢুকে দেখি ভেতরে এমন পালিশ করেছে যে, গাড়ির জৌলুশই পাল্টে গেছে। ২৬ ডলার উশুল! খুশি মনে গাড়ি চালিয়ে দুটোর একটু আগে অফিসে পৌঁছলাম। আগেই যেহেতু শিডিউল করা ছিল, টোকেন নেওয়ার জন্য লাইন ধরতে হল না। সেলফ চেক-ইন কিয়োস্কে (kiosk) গিয়ে কনফার্মেশন নাম্বার দেওয়ার পর টোকেন প্রিন্ট হয়ে বের হল। সেটা নিয়ে অফিসে ঢুকতেই প্রিন্স বলল, “আরে, অলরেডি একটা কাউন্টারে তোমার সিরিয়াল দেখাচ্ছে!” পড়িমরি দৌড় দিলাম কাউন্টার সতেরোতে। এক নানীর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ নারী বসে আছেন। জিজ্ঞেস করলেন, “কীসের অ্যাপয়েন্টমেন্ট তোমার?” হাসিমুখে বললাম, “রোড টেস্টের।” উনি কিছু ফর্ম পূরণ করতে দিলেন, নিজেও ওয়েবসাইটে কিছু ফর্ম পূরণ করলেন। বললেন, “যুক্তরাষ্ট্রে তোমার হালনাগাদ স্ট্যাটাস কী?” আমি OPT EAD কার্ড এগিয়ে দিলাম। উনি খটাখট কিছু টাইপ করলেন, তারপর আমার দুই বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপ নিলেন। ছবিও তুললেন। ছবি তোলার সময় আমি সবসময় হাসি। যেকোনো নথিপত্রে আমার হাসিমুখ দেখবেন। এবারও ঝুঁটি খুলে চুল ছেড়ে হাসিমুখে ছবি তুললাম। নানী বললেন ছবি নাকি সুন্দর হয়েছে। তারপর আবারও খটখট খটখট। একটু পর চিন্তিত মুখে বললেন, “আমি তোমাকে খুঁজে পাচ্ছি না কেন?”

খুঁজে পাচ্ছেন না মানে? কোথায় খুঁজে পাচ্ছেন না? সেন্ট্রাল ডাটাবেসে? কেন পাচ্ছেন না? আমাকে কি ডিপোর্ট করে দিল নাকি দাদু? কয়েক মুহূর্ত পর নানী বললেন আমার নাকি আবারও বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপ দেওয়া লাগবে আর ছবি তোলা লাগবে। অবিশ্যি! ডাটাবেসে আমাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য আজকে সারাদিন ধরে যদি এই করতে হয়, আমি রাজী। দ্বিতীয়বার ছবি তুলতে গিয়ে ঝুঁটিসহ দাঁড়ালাম। চিন্তায় পড়ে চুলও ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না, হাসতেও না। নানী জিজ্ঞেস করলেন, “চুল ছাড়বে না? হাসবে না?” এই শালা, নানী এটাও লক্ষ্য করেছে? হাসতে হাসতে ঝুঁটি খুলে ছবি তুললাম। নানী বললেন এই ছবি নাকি প্রথমটার চেয়েও ভাল এসেছে। এইবার আমার তথ্যও সব ঠিকমত পাওয়া গেল। ১১ ডলার পরিশোধ করে রোড টেস্টে বসার ফর্ম নিলাম। নানী আমাকে শুভ কামনা জানিয়ে বললেন গাড়ি নিয়ে কোথায় যেতে হবে। আমিও বিদায় জানিয়ে ওয়েটিং রুমে ফিরলাম। প্রিন্সকে বললাম এখনই গাড়ি নিয়ে অফিসের পিছন দিকে (যেখানে প্র্যাকটিস করেছি) যেতে হবে। ওখান থেকে টেস্ট শুরু। প্রিন্সও শুভ কামনা জানাল। বলল, সে জানে আমি কোপাবো। আমার আত্মবিশ্বাস দেখে সে বুঝে গেছে। শুনে ভাল লাগল। প্রশিক্ষকের মুখ থেকে এরকম বাণী এলে ভয় কেটে যায়।

আমি ফুরফুরে মেজাজে পার্কিং লট থেকে গাড়ি বের করে নির্দিষ্ট লেইনে এলাম। আমার আগে আরও আটটা গাড়ি দাঁড়ানো। আমার পিছেও দেখতে দেখতে তিনটা গাড়ি চলে এল। মরার আজকেই এতগুলোর শিডিউল নিতে হল? তার উপর সামনের গাড়িগুলো নড়ছে তো নড়ছে না। প্রখর রোদে গাড়ির ভেতর এসি দিয়েও গরম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় দেড় ঘণ্টা কেটে গেল। কোন অফিসাররা পরীক্ষা নিচ্ছেন, সবাইকে আমি চিনে ফেললাম। একজন হিস্পানিক নারী, আর একজন এশীয় পুরুষ। অবশেষে আমার পালা এল। হিস্পানিক অফিসারটা এসে গরম গলায় বললেন, “তোমার কাগজপত্র দাও।” উনি এতক্ষণ যে চালকের পরীক্ষা নিয়েছেন, নিশ্চয় সে ভাল করেনি। নতুবা এত গরম হয়ে থাকার কারণ কী? নাকি একের পর এক পরীক্ষা নিয়ে বেচারা ক্লান্ত? আমি কাগজ দিলাম। সব দেখে উনি বললেন, “ডান ইনডিকেটর দাও, বাম ইনডিকেটর দাও, ব্রেক লাইট দাও। আবার ডান ইনডিকেটর দাও, হর্ন বাজাও।” আমি ওয়াইপার, হাই বিম, হেডলাইট, হ্যাজার্ড লাইট – সবকিছু দেখানোর প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি। কিন্তু উনি এগুলো দেখতে চাইলেন না। গাড়িতে এসে বসে বললেন, “আমার নাম অমুক। আমি আজকে তোমার ড্রাইভিং টেস্ট নেব।” জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন আছেন আজকে?” অফিসার লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বললেন, “প্রচণ্ড গরম!” হেসে দিলাম দুইজনই। এরপর বললেন টেস্টের সময় উনি কোন কোন ব্যাপার খেয়াল করবেন আর কী করলে আমি ফেল করব। যদি আমার মোট নাম্বার ত্রিশের নিচে থাকে, তাহলে আমি পাশ। উপরে উঠলে ফেল। বুঝলাম যে, টেক্সাসে প্রতিটা ভুলের জন্য নাম্বার জমতে থাকে। অন্য জায়গায় যেমন ভুলের জন্য নাম্বার কাটতে থাকে, এখানে উল্টো।

শুরুতেই অফিসার প্যারারাল পার্কিং করতে নিয়ে গেলেন। যা ভেবেছিলাম, তাই। প্রথম চান্সেই বাজিমাত। অফিসারের ভাব দেখে মনে হল খুশি হয়েছেন। এরপর নিয়ে গেলেন পাশের পাড়াতে, যেখানে এতদিন প্র্যাকটিস করেছি। তবে যেসব অলিগলিতে উনি গেলেন, সেগুলোতে যাইনি। উনি একটু প্যাঁচানো আর টাইট টার্নওয়ালা রাস্তা দিয়ে ঘুরাতে লাগলেন। আমি খুব সুন্দরমত চালাতে লাগলাম। একটু যে ভয় লাগছিল না, তা না। কিন্তু যেরকম ভয় পেলে মানুষ স্বাভাবিক চিন্তা হারিয়ে ফেলে, সেরকম কিছু না। মজার ব্যাপার হল, অফিসার আমাকে এমন এক রাস্তায় নিয়ে এলেন যেখানে গাছপালার ভিতরে স্টপ সাইন ঢাকা পড়ে গেছে। কিন্তু আমি তো এখন সচেতন বান্দা! এই ফাঁদে পা দিলাম না। সুন্দর করে থেমে টার্ন নিলাম। অফিসার খাতায় কী যেন লিখলেন। তারপর পাড়া থেকে বের করে হাইওয়েতে উঠালেন। এই হাইওয়ে ধরে চালাতে থাকলেই ডান পাশে ডিপিএসের গলি। ওখান দিয়েই নিশ্চয় ঢুকাবে। আহ, একদম যা প্র্যাকটিস করেছি, তাই।

কিন্তু এ কী! অফিসার থামতে বললেন না। গলির একদম কাছাকাছি চলে এসেছি। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে গলি পার হয়ে যাব। কিন্তু ড্রাইভিং টেস্টের সময় আপনি পরীক্ষকের নির্দেশ ছাড়া কিছুই করতে পারবেন না। এমনকি লেইন বদল করতে হলেও উনি আপনাকে বলবেন। উনার নির্দেশ ছাড়া সামনে বাস দাঁড়িয়ে থাকলেও আপনি লেইন বদলে সামনে এগোতে পারবেন না। বাসের পিছেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। তাই আমিও সোজা চালাতে থাকলাম। মাথার মধ্যে প্রশ্ন ঘুরছে, আমাকে আর কোথায় নেবে পরীক্ষার জন্য? ইন্টারসেকশনে এসে অফিসার বললেন ডানে যেতে। ডান রাস্তা ধরে খানিক এগোতেই ডান দিকে ডিপিএসে ঢুকার আরেকটা গলি চোখে পড়ল। অফিসার ওটা দিয়ে আমাকে ঢুকতে বললেন। আচ্ছা! এটাও একটা ফাঁদ ছিল মনে হয়। আমরা শিক্ষানবিশরা প্র্যাকটিস করার সময় আগের প্রবেশমুখ ধরে প্র্যাকটিস করি, কিন্তু আসল পরীক্ষার দিন এইদিক দিয়ে আনা হয়। এতে কেউ নার্ভাস হয়ে ভুলচুক করে কিনা, সেটাই হয়ত দেখতে চায়।

আমি অফিসারের নির্দেশ মত গাড়ি নিয়ে যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, সেই স্পটেই ফেরত এলাম। উনি বললেন ‘পার্ক’ করতে। আমি ফুল পার্ক করলাম। উনি সেটাও খেয়াল করলেন। তারপর বললেন, “ওকে! তুমি কোনোকিছুতে ধাক্কা মারোনি, কোনোকিছুর উপর দিয়ে চালিয়ে দাওনি, তোমার স্কোর ত্রিশের নিচে। তুমি পাশ করেছ।” আমি টের পাচ্ছিলাম যে, আমি পাশ করেছি। কিন্তু অফিসারের মুখ থেকে কথাটা শুনে বুকটা এমন ধ্বক করে উঠল! এই মুহূর্তের জন্য আমি কত বছর অপেক্ষা করেছি… কত উদ্বেগ আর মানসিক ধকল সয়েছি… কতবার নিজেকে অপদার্থ মনে হয়েছে! আজ আমি প্রথম সুযোগেই ড্রাইভিং টেস্ট পাশ করে ফেলেছি। পেটের ভেতর থেকে দলা পাকিয়ে কান্না উঠে এল। অনেকের কাছে এটা একটা টেস্ট মাত্র। কিন্তু আমার কাছে এটা তারচেয়েও বেশি। এটা নিজের ভয়কে জয় করা, নিজের দুর্বলতাকে জয় করা। অটো সাজেশন দিতে দিতে আত্মবিশ্বাস তৈরি করা যে, আমিও পারব।

অফিসার আমাকে পার্কিংয়ে রেখে ভেতরে চলে গেলেন অস্থায়ী লাইসেন্স আনতে। এই ফাঁকে আমি প্রিন্সকে কল দিয়ে কান্না করে ফেললাম। বললাম, “পাশ করেছি! আমি পাশ করেছি!” টের পেলাম প্রিন্সের বুক থেকে বিশাল এক ভার নেমে গেল। খুশিতে আটখানা হয়ে ও অভিনন্দন জানাল। আবারও মনে করিয়ে দিল যে, সে জানত আমি ‘ছাঞ্চ পেয়ে দেকাতে পারব’। একটু পর অফিসার কাগজে প্রিন্ট করে অস্থায়ী লাইসেন্স নিয়ে এলেন আর অভিনন্দন জানালেন। আমিও গর্বে গরবিনী হয়ে প্রিন্সকে প্যাসেঞ্জার সিটে বসিয়ে ‘প্যাসেঞ্জার প্রিন্স’ বানিয়ে বাসায় ফিরলাম।

এভাবেই শেষ হল আমার জীবনের প্রথম ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার কাহিনী। এক চান্সেই লাইসেন্স পাওয়ার কাহিনী।

Happy
Happy
100 %
Sad
Sad
0 %
Excited
Excited
0 %
Sleepy
Sleepy
0 %
Angry
Angry
0 %
Surprise
Surprise
0 %
Previous post পিএইচডি দিনলিপি – ২১ (দুই বছর পর আমার উপলব্ধি)