আমি পরিকল্পনা করেছি পিএইচডি জীবনের খুঁটিনাটি সম্পর্কে লিখে রাখব। তিন থেকে পাঁচ, যত বছরই লাগুক না কেন, পিএইচডি শেষের পর লেখাগুলো হয়ে থাকবে এই সময়ের সংগ্রাম, ব্যর্থতা আর সফলতার দলিল। এই লেখা আমার অভিজ্ঞতা থেকে আসবে। অন্য পিএইচডি শিক্ষার্থীদের সাথে সে অভিজ্ঞতা নাও মিলতে পারে। সেটাই স্বাভাবিক। সবার পথচলা এক নয়। আপনার আর আমার বিভাগ, অনুষদ, বিষয়, গবেষণার ক্ষেত্র, এমনকি গবেষণা উপদেষ্টাও যদি এক হয়, তবুও আমাদের অভিজ্ঞতা পুরোপুরি মিলবে না। আপনি আর আমি আলাদা মানুষ। আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা আলাদা, দৃষ্টিকোণ আলাদা, যেকোনো বিষয় বিচার করার দক্ষতা আলাদা। তাই পুষ্টিবিজ্ঞানের মানুষ হয়েও হয়ত আমার আপনার সাথে অভিজ্ঞতার বিস্তর ফারাক দেখা যাবে। তাই লেখাগুলোকে কোনোকিছুর সাথে তুলনা না করে আমার ব্যক্তিগত বকবকানি হিসেবে পড়ার অনুরোধ রইল।
প্রথম সেমিস্টার থেকেই আমাকে টিচিং অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে কাজ করতে হবে। ফ্রেশম্যান বা প্রথম বর্ষের আন্ডারগ্র্যাড শিক্ষার্থীদের পড়াতে হবে। কোর্সের নাম ‘ক্রিটিকেল অ্যাপ্রেইজাল’। মোট চারজন টিএ আছি কোর্সটার জন্য, আর আছেন প্রাইমারি ইন্সট্রাক্টর (ইনি আবার আমার পিএইচডি অ্যাডভাইজারও)। কোর্সটা একদম নতুন। মাত্র দেড় বছর ধরে চালু হয়েছে। সেজন্য লেকচারের পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইডগুলো প্রতিনিয়ত আপগ্রেড হয়। প্রফেসর আমাদের সাথে দফায় দফায় মিটিং করেন কীভাবে প্রেজেন্টেশন আরও সহজবোধ্য করা যায়, তা নিয়ে। সবার মাথা থেকে কিছু না কিছু ‘ইউরেকা মুহূর্ত’ বের হয়। ভোটাভুটির মাধ্যমে সেরা আইডিয়াগুলো বাছা হয়। সে অনুযায়ী স্লাইডে সংযোজন, বিয়োজন ঘটে। দাপ্তরিক হিসেব মতে আমার চাকরি জীবন আগস্টের পনেরো তারিখ থেকে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও প্রফেসর আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকেই সব টিএকে নিয়ে মিটিং শুরু করলেন। প্রথম যেদিন মিটিংয়ে গেলাম, বাকি তিনজনের সাথে দেখা হল। দুজন চীন থেকে এসেছে, একজন দক্ষিণ কোরিয়া। মনেই হয় না এরা পিএইচডি শিক্ষার্থী। আন্ডারগ্র্যাডদের মত কম বয়সী লাগে। কিন্তু আমাকে চমকে দিয়ে সবচেয়ে তরুণ যাকে লাগে, সেই জিয়ন বলল, সে পিএইচডি চতুর্থ বর্ষে আছে। আগামী বছর ডিফেন্স দেওয়ার কথা। একটু গোলগাল চেহারার হেইওয়ান বলল, সে তৃতীয় বর্ষে আছে। শ্যেন নামের ছটফটে মেয়েটা বলল, সে আছে দ্বিতীয় বর্ষে। ওর ডান হাত জুড়ে উল্কি আঁকা। বাহুর শুরু থেকে কব্জির শেষ পর্যন্ত। উল্কিটা এত জীবন্ত! মনে হয় যেকোনো মুহূর্তে তুলিতে আঁকা মেয়েটা হাত ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। ওর বুকেও উল্কি আছে। বড় গলার জামা পরেছে বলে উল্কিটা চোখে পড়ছে। ওকে দেখে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম, পিএইচডি করছি বলে গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে বসে থাকব না। ছেলেমানুষী করতে ইচ্ছে করলে করব। অহেতুক পরিপক্ক ভাব এনে চেহারা রামগরুড়ের মত করে রাখব না।
একসময় আমার ধারণা ছিল, যারা পিএইচডি করে, তাদের চুপচাপ বা গম্ভীর থাকাই মানানসই। আন্ডারগ্র্যাডদের মত হইচই, লাফালাফি তাদের মানায় না। কিন্তু এসব ধারণা যে ভুল, বুঝতে পারি। এ বছরের শুরুতে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া ডেভিসের পুষ্টি বিভাগের কিছু পিএইচডি শিক্ষার্থীর সাথে পরিচয় হয়েছিল। একজনকে দেখেছিলাম পাংক স্টাইলে চুলে লাল-নীল রঙ করে ঘুরছে, একজন একপাশের চুল সম্পূর্ণ চেঁছে আরেক পাশে লম্বা রেখেছে, আরেকজন সারা শরীর ভর্তি উল্কি এঁকে রেখেছে। বেশ ধাক্কা খেয়েছিলাম দেখে। পিএইচডি শিক্ষার্থীর যে চেহারা আমার মাথায় ছিল, তার সাথে ওদের মিল নেই। তখনই বুঝেছিলাম, নির্দিষ্ট বয়স হওয়ার পর বা উচ্চতর ডিগ্রি লাভের পর মানুষের আচরণ কেমন হওয়া উচিৎ, তার কেমন জীবন যাপন করা উচিৎ, এসব আজেবাজে আরোপিত ধারণার কোনো বেইল নেই। কারো অপকার না করে জীবন যেভাবে উপভোগ করা যায়, সেভাবেই চলা উচিৎ। আপনার চুপচাপ থাকতে ভালো লাগলে থাকবেন, কারো ডিস্কো ক্লাবে গিয়ে নাচতে ইচ্ছে করলে নাচবে। আপনার তাকে বা তার আপনাকে বিচার করা অবশ্যই ঠিক নয়। জানি এসব কথা বলা সহজ, মানা কঠিন। কিন্তু আমি সেই কঠিন কাজটাই করার চেষ্টায় আছি। মাঝে মধ্যে পা হড়কে যায়। তখন প্রিন্স যাত্রাপালার বিবেক হয়ে বলে, ‘তুমি কেন ওকে জাজ করছ?’ তখন আবার ঠিক হয়ে যাই।
বলছিলাম টিএইং করার কথা। টিচিং অ্যাসিস্টেন্টের কাজকে সংক্ষেপে এরা টিএইং বলে। প্রফেসর যখন আমাকে কোর্স কন্টেন্ট বুঝার জন্য সিলেবাস দিলেন, বললাম, ‘সিলেবাসের ধরনটা কেমন এলোমেলো। একটু মডিফাই করি?’ প্রফেসর রাজি হলেন। এরপর পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন নিয়ে গাঁইগুই করলাম, ‘স্টাইলটা আদ্যিকেলে। আরও আকর্ষণীয় স্টাইলে তৈরি করি?’ প্রফেসর সায় দিলেন। কাজ পছন্দ হওয়ার পর ধরিয়ে দিলেন সম্পূর্ণ নতুন কন্টেন্টের উপর স্লাইড তৈরির কাজ। সে কাজ এখনও চলছে। মজাই লাগছে করতে। যদি স্লাইডগুলো টিকে যায়, তাহলে আমার একটা লিগ্যাসি তৈরি হবে। ভবিষ্যৎ টিএরা এসে এই স্লাইড দিয়েই পড়াবে। সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়েও টিএ থাকা অবস্থায় এমন কিছু কাজ করেছিলাম। জানি না সেই ফর্মগুলো এখনও পিয়ার রিভিউয়ের জন্য ব্যবহার করা হয় কিনা, তবে প্রফেসর খুব মুগ্ধ হয়েছিলেন দেখে। বলেছিলেন, এত গোছানো আইডিয়া উনার মাথায়ও কখনো আসেনি।
এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো, বারো, তেরো, চৌদ্দ, পনেরো, ষোল, সতেরো, আঠারো, ঊনিশ, বিশ