এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো, বারো, তেরো, চৌদ্দ, পনেরো, ষোল, সতেরো, আঠারো, ঊনিশ, বিশ
পার করে ফেললাম দাপ্তরিকভাবে পিএইচডি প্রোগ্রাম শুরুর প্রথম এক মাস। চার থেকে পাঁচ বছর ব্যাপী একটা প্রোগ্রামের প্রথম এক মাস পার করার পর আসলে তেমন কিছুই বলা যায় না। যাই বলব, তাই হয়ত নতুন অভিজ্ঞতার আলোকে ছয় মাস পর পাল্টে যাবে। তারপরও জীবনানন্দ দাশের কথাকে হালকা টুইস্ট মেরে বলা যায়, আমি স্মৃতি খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসি। তাই একমাসের উপলব্ধি লিখে রাখতে যাচ্ছি। ছয় মাস পর কাঁদতে কাঁদতে এই লেখা পড়ব আর নিজেকে গালি দিব, “কোন ভূতে আদর করেছিল বলে তুমি এই দুঃখের জীবনে এত সুখ খুঁজে পেয়েছিলে?” যা হোক, পিএইচডি জীবন নিয়ে নানা রসিকতা, ভয় ধরানো অনেক গল্প প্রচলিত আছে। সেগুলো সবার জন্যে সত্যি নয়। অনেকেই আছে পিএইচডি জীবন উপভোগ করে। গবেষণার চাপ, পেপার পাব্লিশের চাপ, অ্যাডভাইজরের চাপ, সবকিছু তাদের ভাল লাগে। আবার অনেকে এত চাপ নিতে পারে না। একসময় প্রশ্ন জাগে, “আমি কি ফাইরবো?” ভাবছি আমি কোন দলে পড়ি। মনে হচ্ছে এখনও চাপ পছন্দ করার দলে আছি। কে জানে দুইদিন পর উশটা খেয়ে দ্বিতীয় দলে চলে আসব কিনা!
আমার দিনের একটা বড় অংশ যায় দিনপঞ্জির দিকে তাকাতে তাকাতে। অমুক তারিখে কোন বার পড়েছে? ঐ তারিখে কি আমার কোনো মিটিং আছে? নতুন আরেকটা মিটিং ঢুকানোর জায়গা আছে? মহা যন্ত্রণা! আমি ফলিত পুষ্টিতে পিএইচডি করছি। আমার ল্যাবভিত্তিক কোনো কাজ নেই, নেই ক্লিনিক্যাল কাজও। সমস্ত কাজ আপাতত কম্পিউটারে। দ্বিতীয় বছর থেকে কোয়ালিটেটিভ রিসার্চ শুরু হবে। তখন মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করার মত কাজ করতে হবে। সেটারই ভিত্তি তৈরি করছি কিছু সিস্টেম্যাটিক রিভিউয়ের মাধ্যমে। এই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে গিয়ে অনেক মানুষের সাথে মিটিং মিছিল করতে হচ্ছে। যতদূর বুঝলাম, পিএইচডি হল শেখার জায়গা। যত পারেন, শিখে নেবেন। আমার অ্যাডভাইজর কাজ করে করে শেখায় বিশ্বাসী। কোর্সওয়ার্কের চেয়ে হাতে কলমে শেখার পক্ষপাতী। কানাডার নাগরিক বলে সেখানকার নিয়মের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। বলে রাখা ভাল, যুক্তরাষ্ট্রের পিএইচডি প্রোগ্রামে প্রচুর কোর্সওয়ার্ক থাকে। প্রথম দুই বছর ধরে দেখা যায় শিক্ষার্থীরা কোর্সওয়ার্ক করছে। পরের বছরগুলোয় নিজের গবেষণা। এজন্য পিএইচডি শেষ হতে চার-পাঁচ বছর লাগে। কিন্তু কানাডা বা ইউরোপে এত কোর্সওয়ার্ক থাকে না। তারা গবেষণার পিছে বেশি সময় দেয়। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে দ্রুত পিএইচডি শেষ হয়। এই নিয়মের পক্ষে বিপক্ষে বহু তর্ক আছে। আমি সেদিকে যাচ্ছি না। পুরো ব্যাপারটা সাব্জেক্টিভ। কারো জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ম ভাল, কারো জন্য কানাডার। আমি শুধু আমার অ্যাডভাইজরের চিন্তাভাবনা কীভাবে তৈরি হয়েছে, সেটার পটভূমি দিলাম। উনি আমাকে বলেন, “তোমার দুইটা মাস্টার্স ডিগ্রি আছে। তার মানে অনেক কোর্সওয়ার্ক ইতোমধ্যে করা আছে। আবারও কেন কোর্সওয়ার্ক নিতে হবে? ঐ ক্রেডিটগুলো তুমি গবেষণায় ব্যয় করলে অনেক কিছু শিখতে পারতে!” কথা সত্যি। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক মারপ্যাঁচে পড়ে কয়েকটা থিওরি বেইজড কোর্স নিতে হয়েছে। দ্বিতীয় সেমিস্টার থেকে এমন কোর্স নিব যেগুলোতে প্র্যাক্টিকেল অ্যাসাইনমেন্ট আছে। হাতে কলমে শেখানো হবে কীভাবে সাক্ষাৎকার নিতে হয়, ডেলফাই সার্ভে করতে হয়, সিস্টেম্যাটিক রিভিউ করতে হয়।
কিছুদিন আগে ইমেইল পেলাম পুষ্টি বিভাগের গ্র্যাজুয়েট অ্যাসোসিয়েশনের (NSGA) সিনেটর পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। আগ্রহীরা যেন চটপট আবেদন করে ফেলে। আমি এসব হাঙ্গামা থেকে সারাজীবন দূরে থেকেছি। কখনোই কোনো সংগঠনের সদস্য হইনি। ভাল লাগে না। কিন্তু NSGA-এর কার্যক্রম পড়ে খুব ভাল লাগল। ওরা গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা শনাক্ত করে, সেগুলো মিটমাট করার উদ্যোগ নেয়। এরকম একটা কাজের সাথে যুক্ত থাকতে পারলে ভালই হয়। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হল পিএইচডি তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী, তারা। নাম দেখে ভেবেছিলাম দক্ষিণ এশীয়। কিন্তু না, ওর পূর্বসূরিরা আরব থেকে এসেছে। এখন পুরোদস্তুর আমেরিকান বনে গেছে। ওর সাথে একদিন আড্ডা দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম সিনেটরদের দায়িত্ব কী, সপ্তাহে কতটুকু সময় দিতে হয়, ইত্যাদি। তারা বলল সব সদস্যের মধ্যে সিনেটরদের কাজই সবচেয়ে কম। শুনে আবেদন করে ফেললাম। তাছাড়া টেক্সাস টেকের পুষ্টি বিভাগে পিএইচডিরত এক ভাই বলেছিলেন, ওখানকার ছাত্র সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে তিনি অনেক কিছু শিখেছেন। প্রোফাইলও ভারী হয়েছে। সেটা থেকেও অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। দেখিই না অভিজ্ঞতাটা কেমন! নতুন জিনিস না চাখলে বুঝব কীভাবে এটা আমার ভাল লাগবে কিনা? আর টা ডা! নির্বাচিতও হয়ে গেলাম সিনেটর হিসেবে। এখন সিনেটরদের মিটিংয়েও যেতে হয়। হায়! জীবন মিটিংময়।
থিওরি বেইজড কোর্স হিসেবে আমাকে নিউট্রিশনাল বায়োকেমিস্ট্রি নিতে হয়েছে। অনার্স তৃতীয় বর্ষে থাকতে প্রাণরসায়ন পড়েছিলাম। খুবই প্রিয় একটা বিষয় ছিল। আনিসা ম্যাডাম এত সুন্দর করে বুঝাতেন! সত্যনারায়ণের প্রাণরসায়ন বইটাও দারুণ সোজা ছিল। কিন্তু এরপর পার হয়ে গেছে দশ দশটা বছর। আমি গুলিয়ে খেয়েছি এনজাইম, সাবস্ট্রেটের কারবার। এখন এসে গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ের প্রাণরসায়ন এত কঠিন লাগছে! পড়াচ্ছেন ডঃ গুয়াও উ (Guoyao Wu)। উনি নিউট্রিশনাল বায়োকেমিস্ট্রি জগতের একজন কেউকেটা। অ্যামিনো অ্যাসিড নিয়ে উনার গবেষণা ভীষণ বিখ্যাত। যখন উনি গল্প করেন, মুগ্ধ হয়ে শুনি। কিন্তু যখনই পড়াশোনায় ফিরে আসেন, আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। মনে হচ্ছে সত্যনারায়ণের বইটা রিভিশন দিতে হবে। বেসিকগুলো মনে পড়লে ডঃ উর ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারব। এছাড়া এপিডেমিওলজির একটা কোর্স নিয়েছি যেখানে পড়ান একজন ইংরেজ প্রফেসর। চিকন, মেদহীন শরীর। মাথার সব চুল পাকা, কিন্তু ভুরু কাঁচা। পরে আসেন ফুল হাতা শার্ট, টাই, চামড়ার জুতা। একদম ফুলবাবু যাকে বলে। ইংরেজদের ফরমাল অ্যাটায়ার সম্পর্কে হালকা জানতাম। এবার চাক্ষুষ দেখলাম। গতকাল উনি পরে এসেছিলেন আকাশী রঙের একটা জুতা। কে যেন বলে উঠল, “তোমার জুতাটা মারাত্মক!” প্রফেসর দেখি লজ্জা পেয়ে গেলেন। লাল হয়ে বললেন, “ধন্যবাদ… ইয়ে, আমরা যেন কী পড়ছিলাম?”
গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী হিসেবে আমার সেমিনার কোর্সে অংশ নেওয়া বাধ্যতামূলক। সেমিনারে বিভিন্ন গবেষকের গবেষণা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়, তারপর ঐ গবেষককে আমন্ত্রণ জানানো হয় বক্তৃতা দিতে। গবেষক নিজেই দু’তিনটে পেপার ঠিক করে দেন যেগুলোর উপর আমাদের ক্রিটিকেল অ্যাপ্রেইজাল করতে হয়। মানে ঐ স্টাডিতে কোনো বায়াস (ভুল) আছে কিনা, যে মেথড ব্যবহার করা হয়েছে সেটা উপযুক্ত ছিল নাকি এরচেয়েও ভাল মেথড ব্যবহার করা যেত, ইত্যাদি। মোট কথা, পেপারের সমালোচনা করা। ব্যাপারটা এমন কঠিন লাগছে আমার! শেষ পর্যন্ত রিস্ক অফ বায়াস টুল ব্যবহার করে বায়াস বের করার চেষ্টা করলাম। সেখানেও ঝামেলা। একেক ধরনের স্টাডির জন্য একেক রকম টুল। এক্সপেরিমেন্টাল স্টাডির জন্য এক টুল, অব্জার্ভেশনাল স্টাডির জন্য আরেকটা। গতবার যে বক্তা এসেছিলেন, উনার সাথে আমি আর তারা ঘণ্টাখানেক আড্ডা দিয়েছিলাম। উনি যে প্রফেসর, মনেই হচ্ছিল না। ব্যাপারটা ছিল গবেষকের সাথে গবেষকের আড্ডা। এত ভাল লাগছিল! আগামীতে আসবেন ডঃ শ্যারন ডনোভান। ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় অ্যাট আর্বানা-শ্যাম্পেইনের প্রফেসর। শিশুদের পুষ্টি নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে অসম্ভব বিখ্যাত একজন। আমার অনেক ইচ্ছে ছিল উনার সাথে গবেষণা করার। বেশ কয়েকবার নকও দিয়েছিলাম। কিন্তু ব্যাকগ্রাউন্ড না মেলায় ব্যাটে বলে হয়নি। তাতে কী? উনাকে সামনাসামনি দেখব, বক্তৃতা শুনব, এটা আমার জন্য স্বপ্নের মত। স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে, এতেই আমি খুশি। মাঝে মাঝে মনে হয় যারা লেখাপড়া বা গবেষণা ভালবাসে, তাদের সবার উচিৎ যুক্তরাষ্ট্রের মত গবেষণাবহুল দেশগুলোতে আসার। বিশ্বখ্যাত গবেষকদের সান্নিধ্যে আসা, তাদের কথা শোনা, একটাবার চোখে দেখার মধ্যে অনেক আনন্দ। এই আনন্দটুকু তাদের পাওয়া উচিৎ!