এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো, বারো, তেরো, চৌদ্দ, পনেরো, ষোল, সতেরো, আঠারো, ঊনিশ, বিশ
আজ পিএইচডি জীবনের দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা বলবো – রিভিউয়ার হওয়া আর সেমিনার সিরিজে অংশ নেওয়া। দুইটা দুই ঘরানার জিনিস। একটার সাথে আরেকটা মিলিয়ে ফেলবেন না যেন।
রিভিউয়ার হওয়াঃ মানুষ যেকোনো কাজ সবচেয়ে ভালো শিখে সেটা করতে করতে, কীভাবে করতে হয় সেটা পড়তে পড়তে নয়। আমরা বইপুস্তকে যা পড়ি, সেটা দুই একদিন পরই মাথা থেকে গায়েব হয়ে যায়। কিন্তু যদি হাতেকলমে শিখি, সেটা অনেকদিন মনে থাকে। এজন্যই প্র্যাক্টিকেল বা ব্যবহারিক জ্ঞানের এতো কদর, এজন্যেই অভিজ্ঞতার দাম কোটি টাকা। ধরুন আপনি ড্রাইভিং শিখতে চান। প্রথমে আপনাকে পারমিট লাইসেন্স নিতে হবে। সেটা নেওয়ার জন্য একটা লিখিত পরীক্ষা দিতে হবে। ওই পরীক্ষার প্রশ্ন আসে একটা গাইড বই থেকে (অঙ্গরাজ্য ভেদে গাইড বই ভিন্ন হয়ে থাকে)। সেই বইয়ে ছাপানো রাস্তাঘাটের নিয়ম কানুন মুখস্ত করে আপনি পরীক্ষা দিলেন, পাশও করলেন। কিন্তু যখন ড্রাইভিং শেখার জন্য গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামলেন, দেখা গেলো অনেক নিয়ম ভুলে গেছেন, অনেক নিয়মের আগা মাথা বুঝতে পারছেন না। তাহলে এতদিন কী শিখলেন? যাই শিখলেন, সেটা ক্ষণিক একটা পরীক্ষায় পাশের জন্য দরকার ছিলো। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ীভাবে নিয়ম কানুন মনে রাখতে গেলে (বা ড্রাইভিং শিখতে গেলে) স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে, ব্রেক কিংবা এক্সেলেরেটরে চাপ দিয়ে, রাস্তায় লেন বদল করে, গতি নিয়ন্ত্রণ করে হাতেকলমে শিখতে হবে। রাস্তায় না নামা পর্যন্ত লাল-হলুদ-সবুজ বাতি দিয়ে কখন কী বুঝায়, সেটা মাথায় ঢুকবে না যতই বই পড়ুন। তাই মাস্টার্স বা পিএইচডি, যে উচ্চশিক্ষার পথেই আপনি হাঁটুন না কেনো, সবসময় চেষ্টা করুন বিভিন্ন প্রজেক্টে অংশ নিয়ে হাতেকলমে কাজ শেখার। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিনামূল্যে অনেক কোর্স বা সেমিনারে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে। নিজের ক্যারিয়ার মাফিক সেসব কোর্সে অংশ নিয়ে অভিজ্ঞতা বাড়ানো দরকার, বিশেষ করে যদি ব্যবহারিক ক্লাসে অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকে। অনেক সময় শুধু বক্তৃতা শুনেই অনেক জ্ঞান লাভ হয়। তাই বক্তৃতা কোনো ফেলনা জিনিস নয়। কিন্তু আপনাকে ঠিক করতে হবে কোন বিষয়ে আপনি শুধু শোনার জন্য সেমিনারে যাবেন আর কোন বিষয়টা হাতেকলমে শিখবেন।
আমি প্রমাণভিত্তিক পুষ্টিবিজ্ঞান আর সিস্টেম্যাটিক রিভিউ মেথডোলোজি নিয়ে পিএইচডি করছি। আমার সব প্রজেক্টই এই দুটো বিষয় নিয়ে। গত আট মাসে কাজ করতে করতে দুটো বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ের অনেক কিছু শিখেছি। অথচ মাস্টার্স করার সময় এসব বিষয়ে শুধু পেপার পড়ে যে সামান্য জ্ঞানটুকু হতো, তাতেই নিজেকে কেউকেটা ভাবতাম। টুকটাক ধারণা নিয়েই বর্তমান অ্যাডভাইজরকে ইমেইল করেছিলাম, এটার উপর জ্ঞান আছে, সেটার উপর দখল আছে। শুধু একটা সুযোগ দাও, কাজ করে ফাটিয়ে ফেলবো। মনে করলে হাসি পায় খুব। অ্যাডভাইজর জানতেন আমি কেউকেটা নই, কিন্তু আমার আত্মবিশ্বাস আর প্রণোদনা দেখে উনার সাথে কাজ করার সুযোগ দিয়েছিলেন। বেশিরভাগ অ্যাডভাইজরই এসব গুণ দেখে শিষ্য নেন, যতদূর জানি। পিএইচডি হলো দক্ষ কারিগর তৈরির কারখানা। আপনি যদি পিএইচডিতে ঢুকার আগে থেকেই দক্ষ হয়ে থাকেন, পিএইচডি করার দরকার কী, তাই না?
ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে ফেলছি। বলছিলাম নিজের ফিল্ডে দক্ষতা বাড়ানো নিয়ে। আপনি নিজের গবেষণা করছেন, সে কাজের মূল্যায়ন পাচ্ছেন অ্যাডভাইজরের কাছ থেকে এবং এভাবে একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে শিখছেন, সেটাতে দক্ষ হচ্ছেন। সে দক্ষতাকে আরেকটু শান দেওয়ার জন্য শুরু করতে পারেন রিভিউয়ারের কাজ। আপনি যখন কোনো জার্নালে আর্টিকেল সাবমিট করেন, তখন এডিটরের হাত পেরিয়ে সেটা রিভিউয়ারদের কাছে যায়। রিভিউয়াররা আপনার পাণ্ডুলিপি পড়ে তাদের মতামত জানান। সে অনুযায়ী আপনি পাণ্ডুলিপি মেরামত করে রিসাবমিট করেন। তো, এই রিভিউয়াররা কোথা থেকে আসেন? আপনার আমার মতো গবেষকরাই তো রিভিউয়ার হন! তাই নাম লিখিয়ে ফেলুন রিভিউ করার কাজে। যখন বুঝতে পারবেন নিজের ফিল্ডে হালকা তালেবর হয়েছেন, অন্যের কাজ মূল্যায়ন করার মতো মোটামুটি দক্ষ হয়েছেন, তখন আপনার ফিল্ডের বিভিন্ন জার্নালে রিভিউয়ার হওয়ার জন্য যোগাযোগ করুন। অ্যাডভাইজরকেও বলতে পারেন কারো সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে। আপনার অ্যাডভাইজরের নিশ্চয় কোনো না কোনো ফিল্ড রিলেটেড জার্নালের সাথে কানেকশন থাকবে। ভালো একটা জার্নালে রিভিউয়ার হলে অন্যের কাজ মূল্যায়নের মাধ্যমে নিজের ফিল্ডের গবেষণা সম্পর্কে আপ-টু-ডেট থাকতে পারবেন, অনেক কিছু শিখতে পারবেন। ক্যারিয়ারের দিক থেকেও ভীষণ সহায়ক হবে। সিভি জোরদার হবে। ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রে NIW ক্যাটাগরিতে গ্রিন কার্ডের জন্য আবেদন করতে চাইলে ব্যাপারটা বেশ সাহায্য করবে। দেখাতে পারবেন আপনি গবেষণা জগতে উপকারী ভূমিকা রাখছেন।
এবার আসি আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে।
সেমিনার সিরিজে অংশ নেওয়াঃ যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মাস্টার্স এবং পিএইচডি পর্যায়ে সেমিনার সিরিজ বলে একখানা বস্তু থাকে। এই কোর্সে অংশ নেওয়া সাধারণত বাধ্যতামূলক। আপনি শূন্য অথবা এক ক্রেডিটের সেমিনারের জন্য এনরোল করতে পারেন। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট বিভিন্ন কায়দায় সেমিনার কোর্স চালালেও একটা জিনিস সব জায়গায় কমন – এখানে গবেষণা প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা করা হয়। আপনি যদি পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হন, আপনার সেমিনার কোর্সে পুষ্টিবিজ্ঞানের গবেষণা নিয়ে আলোচনা করা হবে। আপনি তড়িৎ প্রকৌশলের শিক্ষার্থী হলে আলোচনা হবে ওই বিষয়ে প্রকাশিত প্রবন্ধ নিয়ে। অনেক সময় ডিপার্টমেন্ট গেস্ট লেকচারার নিয়ে আসে সেমিনারে বক্তৃতা (এখানে বলে ‘টক/talk’) দেওয়ার জন্য। চেষ্টা করবেন সেসব লেকচারে যোগ দিতে। সাধারণত যাদের আনা হয়, তারা কেউকেটা লোকজন। উনাদের কথা শুনলেও পুণ্য। অনেক সময় লেকচারের পর বক্তার সাথে শিক্ষার্থীদের ঘরোয়া আলাপ আলোচনার সুযোগ রাখা হয়। সেখানেও অংশ নিবেন। অন্যদের করা প্রশ্ন এবং অতিথির দেওয়া উত্তর শুনবেন। এসব করবেন নিজের জ্ঞান বাড়ানোর জন্য। উপরে যখন বলেছিলাম, কোন বিষয়ে আপনি শুধু শোনার জন্য সেমিনারে যাবেন সেটা আপনাকে ঠিক করতে হবে, তখন সেমিনার সিরিজের কথাই বুঝিয়েছিলাম।
টেক্সাস এঅ্যান্ডএমে একেক সেমিস্টারে একেক ফরম্যাটের সেমিনার সিরিজ চলে। তবে সব ফরম্যাটেই একটা জিনিস কমন – যে গবেষকের প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা হয়, সেই গবেষক বক্তৃতা দিতে আসেন। বক্তৃতা শেষে এক ঘণ্টার জন্য শিক্ষার্থীদের সাথে অনানুষ্ঠানিক আলাপ করেন। ওই সময় রুমে কোনো ফ্যাকাল্টি থাকেন না। মন খুলে বক্তাকে প্রশ্ন করা যায়। এখন পর্যন্ত আমি কোনো বক্তৃতা মিস করিনি। যখন ক্লিনিক্যাল বা অ্যাপ্লায়েড নিউট্রিশনের গবেষক আসেন, আমার খুশী লাগে কারণ এসব আমি বুঝি। কিন্তু কোষ, টিস্যু, মাউস মডেল, রোডেন্ট মডেল নিয়ে করা ল্যাবরেটরি এক্সপেরিমেন্টের আগা মাথা আমি কিছু বুঝি না। না বুঝলেও ঠিকই এসব ফিল্ডের গবেষকদের লেকচার শুনতে যাই। লেকচারের আগা মাথা কিছু বুঝি না, কিন্তু ঠিকই উনাদের সাথে অনানুষ্ঠানিক আলাপচারিতায় অংশ নিই। কেন নিই? কারণ গবেষণার ধরন আলাদা হলেও উনাদের অভিজ্ঞতার একটা মূল্য আছে। সে অভিজ্ঞতার ব্যাপারে শুনলে জ্ঞান লাভ হয়। এছাড়া উনাদের সাথে ক্যারিয়ার নিয়েও কথা বলা যায়। সেখান থেকেও অনেক কিছু শিখি। আজ যেমন একজন গবেষক এসেছিলেন যিনি সেলুলার লেভেলে (কোষ নিয়ে) গবেষণা করেন। উনার বক্তৃতা আমার মাথার উপর দিয়ে গেছে। কিন্তু যখন উনার সাথে লাঞ্চ করতে বসলাম, উনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শুনলাম, তখন একটা জিনিস শিখলাম। পিএইচডি করার সময় উনি জীবনের প্রথম R01 গ্র্যান্টের জন্য আবেদন করেছিলেন। তো, রিভিউয়াররা উনার আবেদনের বিভিন্ন দুর্বল দিক নিয়ে মন্তব্য করেছিলো। সেগুলো পড়ে রাগে, অপমানে উনার কান্না করার যোগাড়। উনি পিএইচডি অ্যাডভাইজরকে বললেন, ‘এতো জঘন্য মানসিকতার মানুষ কীভাবে রিভিউয়ার হয়? কী বিচ্ছিরিভাবে মন্তব্য করেছে! আরেকটু ভদ্রভাবে লেখা যেতো না?’ কয়েক বছর পর উনিও অন্যদের গ্র্যান্ট অ্যাপ্লিকেশন রিভিউ করতে শুরু করলেন। তখন উনারও হাত নিশপিশ করতে লাগলো ওইভাবে মন্তব্য করার জন্য। উনি টের পেলেন ঐসব মন্তব্য অতোটা খারাপভাবে নেওয়ার কিছু ছিলো না। আবেদন নাকচ হয়েছিলো বলে সে যন্ত্রণায় সাধারণ মন্তব্যগুলো কুৎসিত লেগেছে। তারপর আমাদের বললেন, ‘যেকোনো আপাত নেতিবাচক মন্তব্যকে মনে ধরে রেখো না। সেগুলো থেকে ইতিবাচক কিছু বের করার চেষ্টা করো। দরকার হলে কিছুদিন যেতে দাও। মাথা যখন ঠাণ্ডা হবে, তখন সেসব মন্তব্য পড়ো।’ আরও বললেন, ‘আমার জীবনে যা কিছু শিখেছি, সব ব্যর্থতা থেকে। সফলতা তেমন কিছু শেখাতে পারেনি। তাই ব্যর্থ হতে লজ্জা পেও না।’
এসব কথা আপনি বইয়ে পাবেন না। এগুলো মানুষ ঠেকে শিখে। এসব অভিজ্ঞতা শোনার জন্যে হলেও সেমিনার সিরিজে অংশ নেওয়া প্রয়োজন।