Read Time5 Minute, 17 Second
উচ্চ মাধ্যমিকে বাধ্য হয়ে “পদ্মা নদীর মাঝি” উপন্যাসটা পড়তে হয়েছিলো বলে খুশি মনে পড়তে পারিনি। উপন্যাসের রসাস্বাদনও তাই করা হয়নি। কিন্তু সেই উপন্যাস দিয়েই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে আমার পরিচয়। “পদ্মা নদীর মাঝি”কে ব্যবচ্ছেদ করে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখতে হতো বলে মানিকের উপর থেকে মন উঠে গিয়েছিলো। নাম শুনলেই বিরক্ত লাগতো। একই কাণ্ড ঘটেছিলো জহির রায়হান, মুনির চৌধুরী, অদ্বৈত মল্লবর্মণের সাথে। যাদেরই লেখা পাঠ্যবইয়ে ছিলো, তাদের সাথেই একটা বিরক্তির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো আমার। যা হোক, প্রায় নয় বছর পর হঠাৎ মানিকের “পুতুল নাচের ইতিকথা” উপন্যাসটা পড়তে মন চাইলো। ততদিনে বিরক্তি ভাব অনেকাংশে কমে এসেছে। তাছাড়া অনেক প্রশংসাও শুনেছি বইটার। পড়েই দেখি না, কী যাদু আছে!
.
সেই থেকে শুরু। মজে গেলাম মানিকে। তিনি হয়ে গেলেন “আমার মানিক”। আমার পড়া শ্রেষ্ঠ প্রেমের উপন্যাসের (এখনও পর্যন্ত) একটা হয়ে গেলো “পুতুল নাচের ইতিকথা”। এই উপন্যাস পড়ার পর বেশ কয়েকমাস আমি অন্য প্রেমের উপন্যাস ধরতে পারিনি, এতোই হ্যাংওভারে ভুগছিলাম। যা হোক, সম্প্রতি শেষ করলাম মানিকের “জননী” উপন্যাসটি। উচ্চ মাধ্যমিকে থাকতেই আমার এক পড়ুয়া বন্ধু “জননী” পড়তে পড়তে বলেছিলো, “নিঝু, দেখো মানিক কী গভীর একটা ডায়ালগ দিয়েছে! ‘লোকটা স্নেহ করে, কিন্তু স্নেহের প্রত্যাশা মিটায় না’।” বলা বাহুল্য, সে সময় আমি ডায়ালগটার গভীরতা পুরোটা অনুভব করতে পারিনি। আজ দশ বছর পর উপন্যাসটা পড়ে বন্ধুর বিস্ময়ের কারণটা ধরতে পারি।

.
“জননী” উপন্যাসের নায়িকা শ্যামাকে আমার লেগেছে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের “মানবজমিন” উপন্যাসের নায়িকা তৃষার মত। এক হাতে সামলাতে হচ্ছে সংসারের যাবতীয় বিষয়, হাজব্যান্ড যেন থেকেও নেই। একাকী, নিঃসঙ্গ এক কিশোরী বধূ কখন যে তরুণী, যুবতী কিংবা মধ্যবয়স্ক নারী হয়ে উঠলো, আমরা তার ভাগগুলো টের পাই না। শুধু নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শ্যামার যে একাকীত্ব আর নিঃসঙ্গতা, সেটা থেকে পাঠকেরা রেহাই পায় না। জগদ্দল পাথরের মত শ্যামার এই মানসিক কষ্টটা আমরাও বয়ে বেড়াই পুরো উপন্যাসে।
.
যে সময়ের প্রেক্ষাপটে “জননী” রচিত, সে সময় মফস্বল বা গ্রামের বাঙালি বধূর নির্ভরতার জায়গা ছিলো “স্বামী” নামক ব্যক্তিটি। কিন্তু জননী উপন্যাসের শ্যামার সেই নির্ভরতাটুকু কখনই সম্পূর্ণরূপে ছিলো না। কীভাবে সে একলা হাতে শূন্য থেকে শুরু করে পূর্ণ সংসার সাজায়, সেই সংসার মহাকালের চক্রে পড়ে কীভাবে আবার রিক্ত হয়, সেটা এতো চমৎকারভাবে মানিক বাবু ফুটিয়ে তুলেছেন যে, মুগ্ধ হয়ে পাতার পর পাতা গিলতে হয়। মানুষের জীবন সংগ্রাম বলতে আসলে কী বুঝায়, সেটা জননী পড়লে খুব সহজে বুঝা যায়। যদিও সাধু ভাষায় রচিত, কিন্তু বর্ণনা এতো সহজ সরল যে পড়তে পড়তে মনে হয়, চলিত ভাষার চেয়ে এই ভাষায়ই বোধহয় সাহিত্য খোলতাই হয় বেশি! এই অনুভূতি আমার তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পড়েও হয়েছে।
.
উপন্যাসটা পড়তে গিয়ে “পুতুল নাচের ইতিকথা”র মত গাঁথুনি বা কাহিনি বর্ণনা পাইনি। পরে দেখলাম এটা মানিক রচিত প্রথম উপন্যাস। এজন্যেই একটু কাঁচা কাঁচা লেগেছে। তবে মানুষের মনস্তত্ত্বের বর্ণনা কী সুন্দরভাবেই না দিয়েছেন লেখক মশাই! অবস্থার উন্নতির সাথে সাথে মানুষের চাওয়া পাওয়া কেমন করে বাড়ে, অবনতি হলে আকাঙ্ক্ষা কীভাবে কমে, কোন পরিস্থিতিতে মানুষ কীভাবে ভাবে, কেন ঐভাবে ভাবে – সব এক মোড়কে পাবেন এখানে। As usual Manik things আর কি! তবে উপন্যাসের নাম “জননী” কেন হয়েছে, সেটা বের করার ভার পাঠকের উপরেই ছেড়ে দেওয়া উচিৎ বলে মনে করি।