Read Time25 Minute, 33 Second
সূচনা
রাতের আঁধার যখন মুছে যাওয়ার পথে, পৃথিবীকে একটু পরেই যখন সূর্যের আলো ছোঁবে, তখন সুবিশাল এক পাখি আপন মনে তৈরি করে যাচ্ছে তার বাসা। অতি যত্নে সে বাসা বানাচ্ছে মশলার কোয়া, লবঙ্গ আর ডালপালা দিয়ে। পাখিটির চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট, অথচ কী সুন্দরই না সে দেখতে! একটু পড় যখন সূর্য উঠল, পাখিটি তার বিশাল দুটো ডানা ছড়িয়ে দিল। লাল আর সোনালি রঙের ডানা ঝকমক করে উঠল রোদের আলোয়। পাখিটি গাইতে শুরু করল বিষণ্ণ এক গান। সূর্যদেবতা থমকে দাঁড়ালেন। কান পেতে রইলেন সুমধুর কণ্ঠের দিকে। স্বর্গ থেকে বিচ্ছুরিত হল এক স্ফুলিঙ্গ, এসে পড়ল পাখিটির বাসায়। মুহূর্তে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল বাসাটি, আগুন গ্রাস করে নিল পাখিটিকে।
কিন্তু… তিনদিন পর ওই দেখ! পাখিটি ফের জীবিত হয়ে উঠল। নিজের পুড়ে যাওয়া দেহের ছাই থেকে পুনর্জন্ম হল বিশাল ফিনিক্স পাখিটির।

ফিনিক্স পাখি আদতে কী?
গ্রিক পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী ফিনিক্স একটি অতিকায় পাখি, যার আয়ু অত্যন্ত দীর্ঘ। কিছু উৎসে উল্লেখ করা আছে এটি ৫০০ বছর পর্যন্ত বাঁচে, আবার কিছু উৎস অনুযায়ী ফিনিক্সের আয়ু ১০০০ বছর। তবে এটা তার মূল বিশেষত্ব নয়। ফিনিক্স যে কারণে বিখ্যাত সেটা হল ৫০০ বা ১০০০ বছর পরপর সে মারা যায়, আবার মৃত্যু থেকে পুনর্জীবিত হয়ে উঠে। অন্যভাবে বললে, মৃত্যুর পর ফিনিক্স পুনরায় জন্মগ্রহণ করে।
ফিনিক্স পাখিটি দেখতে কেমন?
প্রাচীন এবং মধ্যযুগের বেশ কিছু ছবিতে ফিনিক্স পাখির মাথার চারপাশে জ্যোতিশ্চক্র বা বলয় দেখা যায়। এ থেকে পাখিটির সাথে সূর্যের সম্পর্ক বুঝা যায়। একদম প্রথম দিককার আঁকা ফিনিক্সের ছবিতে এই বলয়ের চারপাশে সাতটা রশ্মিও দেখা গেছে। সাত রশ্মি বিশিষ্ট বলয় দেখা যায় গ্রিক পুরাণের হেলিওস চরিত্রে, যে কিনা ছিল সূর্য।
যদিও ধারণা করা হয় ফিনিক্স একটা রঙবেরঙের পাখি, কিন্তু ঠিক কোন রঙ তার দেহে ছিল, সেটা সম্পর্কে স্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায় না। রোমান ইতিহাসবিদ ‘ট্যাসিটাস’ শুধু লিখে গেছেন, ফিনিক্সের রঙ একে অন্যান্য পাখি থেকে আলাদা করে তুলেছে। অনেকে বলেন, ফিনিক্সের রঙ নাকি ময়ূরের মত ছিল। কিন্তু গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস বলেছেন অন্য কথা। তার মতে, পাখিটির রঙ ছিল লাল, সাথে হলুদ কিংবা সোনালি। এই রঙের ফিনিক্সের ছবি আমরা বিভিন্ন চিত্রকলায় দেখতে পাই। খ্রিস্টপূর্ব সময়ের ইহুদী কবি এজেকিয়েল বলেছেন, ফিনিক্সের ছিল লাল পা আর চকচকে হলুদ চোখ। কিন্তু রোমান লেখক ল্যাক্টানশিয়াস বলছেন, এর চোখ ছিল নীলকান্তমণির মত ঝকঝকে নীল, আর পা ছিল হলুদ-লাল আঁশ দিয়ে ঢাকা। পাখিটির নখর ছিল গোলাপি। হেরোডোটাস ফিনিক্সকে ঈগল পাখির আকৃতির বলে গেছেন। কিন্তু ল্যাক্টানশিয়াসের মতে, এটি ছিল উটপাখির সমান।

ফিনিক্স পাখির বসবাস কোথায়?
ফিনিক্স পাখির প্রকৃত বসবাস কোথায়, এ বিষয়ে যথেষ্ট মতভেদ আছে। হাজার বছরের পুরনো গল্প তো, লোকমুখে একেকবার একেক জায়গার কথা উঠে এসেছে। তবে পাখিটির বাসস্থান হিসেবে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় জায়গা হল প্যারাডাইস। একে স্বর্গের বিকল্প হিসেবেও ভাবা হয়। প্যারাডাইস অবস্থিত সূর্যের পেছন দিক দিয়ে যেতে যেতে যেতে যেতে আরও বহুদূরে। আবার কিছু ক্ষেত্রে ফিনিক্সের বাসা বলা হয়েছে হেলিওপোলিস নামক জায়গায়। হেলিওপোলিস হল সূর্যের (যার গ্রিক নাম হেলিওস) বাসস্থান।
আবার গ্রিক রূপকথা অনুযায়ী, ফিনিক্সের বাস ছিল আরব দেশের কোনো এক কুয়োর পাশে। পাখিটি প্রতিদিন সূর্যোদয়ের সময় কুয়োতে নেমে স্নান করত আর সুমধুর কণ্ঠে গান গাইত। এই গান শুনে সূর্যদেবতা স্বয়ং অ্যাপোলো তার রথ থামিয়ে কান পেতে রইতেন।
ফিনিক্স পাখির গল্প এল কোথা থেকে?
গ্রিক পুরাণ হতেই মূলত ফিনিক্স পাখি জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু প্রাচীন মিশরীয় পুরাণকে অনেক বোদ্ধা ফিনিক্স পাখির উৎপত্তিস্থল বলে মনে করেন। দুটো সভ্যতায়ই ফিনিক্স পাখির মত একই রকম গল্প চালু আছে। তবে প্যাঁচ হল, মিশরীয় লিপিগুলোতে স্পষ্ট করে কিছু লেখা নেই এই পাখি সম্পর্কে। তাই গ্রিক পুরাণকেই এখন পর্যন্ত ফিনিক্স পাখির উৎপত্তিস্থল হিসেবে গণ্য করা হয়।
ফিনিক্স পাখির পুনর্জন্ম যেভাবে হয়
ফিনিক্স পাখি নিজের মৃত্যু ঘটানোর জন্য বেছে নিয়েছিল মর্ত্যকে। প্যারাডাইস থেকে শত ক্রোশ দূরের পৃথিবীকে কেন সে পছন্দ করেছিল, জানা যায় না পুরাণ থেকে। শুধু জানা যায়, এক সহস্র বছর পুরলে সে প্যারাডাইস থেকে উড়াল দিত পৃথিবীর উদ্দেশ্যে, যেখানে সে নির্বিঘ্নে মারা যেতে পারবে, আবার পারবে মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে নতুন জীবন শুরু করতে। ফিনিক্স কোথায় আসত তার জীবনচক্র শুরু করার জন্য, তার একটা চিত্র পাওয়া যায় পুরাণে। প্যারাডাইস থেকে উড়তে শুরু করে যখন দুনিয়ায় প্রবেশ করত সে, বিভিন্ন জায়গা পার হয়ে আসত মায়ানমারের জঙ্গলে। ওই জঙ্গল পার হয়ে পড়ত ভারতের উষ্ণমণ্ডলীয় এলাকা। এই এলাকা পার হয়ে অবশেষে ফিনিক্স ডানা রাখত আরব দেশে। সেখানকার সুগন্ধি মশলার বাগানে থাকত তার গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ।
এই বাগানে জন্মাত নানা ধরনের সুগন্ধযুক্ত লতা আর ঔষধি বৃক্ষ। সেগুলো থেকে সবচেয়ে ভাল জাতের লতা আর মশলা বেছে নিত ফিনিক্স। সবচেয়ে বেশি পরিমাণে নিত দারুচিনি। এর গন্ধের সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত, তাই বুঝতে পারি কেন এটা ফিনিক্সের এত প্রিয়। বাসা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণে মশলা আর লতা জোগাড় করা হয়ে গেলে ফিনিক্স সেগুলো নিয়ে উড়াল দিত সিরিয়া অঞ্চলের “ফিনিশিয়া” নামক উপকূলে। ধারণা করা হয়, উপকূলটির নাম এসেছে ফিনিক্স পাখির থেকে।
ফিনিশিয়াকেই ফিনিক্স বেছে নিয়েছিল পুনর্জন্মের জন্য। এখানে এসে একটা তালগাছ বেছে নিয়ে সেটার সবচেয়ে উঁচু শাখায় সে তৈরি করত বাসা। বাসা তৈরি হয়ে গেলে পরের দিনের সূর্যোদয়ের জন্য অধীর অপেক্ষা শুরু হত তার। পরদিন সূর্যদেব যখন পূব দিক থেকে রথ চালিয়ে পৃথিবীর বুকে প্রবেশ করতেন, তখন ফিনিক্স পূবের দিকে তাকিয়ে শুরু করত বিষণ্ণ অথচ সুমধুর এক গান, যা সূর্যদেবতাকেও থমকে দিত। তিনি পরম বিস্ময় নিয়ে শুনতেন কিন্নর কণ্ঠের ওই সুর। তারপর যখন ফিনিক্স তার গাওয়া শেষ করত, সূর্যদেবের খেয়াল হত তিনি এগিয়ে চলার বদলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গান শুনছিলেন। তখন রথের ঘোড়াগুলোর উপর নেমে আসত সূর্যদেবের চাবুকের হররা। তারা লাফিয়ে উঠে প্রচণ্ড জোরে ছুটতে শুরু করত। তাদের খুর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসত স্ফুলিঙ্গ, ছিটকে পড়ত ফিনিক্সের সুগন্ধি লতায় বানানো বাসায়। মুহূর্তে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠত বাসাটি, সাথে জ্বলে পুড়ত হাজার বছরের পুরনো ফিনিক্স পাখি!

ভাবছেন, পুড়ে ছাই হয়ে মরে গেল ফিনিক্স? উঁহু, ফিনিক্সের জীবন চক্র একটু অদ্ভুত কিসিমের! পৌরাণিক এই পাখি নিজের ছাই থেকে জন্ম দেয় নতুন ফিনিক্সের। তাই যখন ফিনিক্সসহ বাসাটি জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেল, সে ছাইয়ের ভেতর আমরা কীটের মত ছোট্ট এক প্রাণীকে নড়াচড়া করতে দেখি। তিনদিনের মাথায় এই কীটের মত প্রাণীটি পরিণত হয় পূর্ণাঙ্গ ফিনিক্সে। শুরু হয় নতুন ফিনিক্সের এক হাজার বছরের জীবন। নতুন জীবন পাওয়ার পর ফিনিক্সটি প্রথম কাজ হত পূর্বসূরির দেহভস্ম সংগ্রহ করে একটা পাত্রে জমা করা। তবে যে সে পাত্র হলে চলবে না, লাগবে গন্ধরস (এক ধরনের সুগন্ধি আঠা, myrrh) দিয়ে তৈরি পাত্র। তাই গন্ধরস জোগাড় করার জন্য সে বেরিয়ে পড়ত। খুঁজে খুঁজে নিয়ে আসত সবচেয়ে ভাল জাতের গন্ধরস, আর সেটা দিয়ে তৈরি করত একটা ডিম। এরপর ডিমের ভেতরের অংশটুকু সরিয়ে ফেলে বানাত একটা ফাঁপা ডিম্বাকৃতির পাত্র। তারপর পাত্রের ভেতর জমা করত পূর্বসূরির দেহভস্মের সবটুকু। এরপর পাত্রের মুখ গন্ধরস দিয়ে আটকে সে রওনা দিত তার প্রাথমিক গন্তব্যে। গন্তব্যের নাম হেলিওপোলিস। সেখানে পৌঁছে সূর্যদেবতার মন্দিরে পাত্রটা রেখে ফিনিক্স রওনা দিত তার চূড়ান্ত গন্তব্য প্যারাডাইসে।
ফিনিক্সের আত্মাহুতি দেওয়ার ঘটনার তিনটা বিকল্প বর্ণনা পাওয়া যায় পৌরাণিক ইতিহাসে। প্রথম কাহিনী মতে, ফিনিশিয়া উপকূলে না গিয়ে আত্মাহুতি দেওয়ার জন্য ফিনিক্স যায় হেলিওপোলিসে। হেলিওপোলিস হল সূর্যদেবতার বাসস্থান। সেখানকার কোনো এক অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে সে আত্মহত্যা করে, আর সেই আগুন থেকেই জন্ম নেয় নতুন ফিনিক্স। দ্বিতীয় কাহিনী মতে, ফিনিশিয়া উপকূলে পৌঁছার পর ফিনিক্স যখন প্রথম সূর্যোদয়ের মুখোমুখি হয়, তখন তার মরণ ঘটে। মরণের পর তার দেহ পচতে শুরু করে। তিনদিন পর যখন দেহ পুরোপুরি পচে গেছে, তখন সে পচনধরা পদার্থ থেকে জন্ম নেয় নতুন ফিনিক্স। তৃতীয় কাহিনী মতে, ফিনিক্স যখন জীবনের শেষ প্রান্তে উপস্থিত হয়, তখন তার শরীরে বার্ধক্যের নানা চিহ্ন দেখা যেতে শুরু করে। ফিনিক্স তখন বুঝতে পারে, মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। নিজে মারা গিয়ে নতুন ফিনিক্সের জন্ম দিতে হবে। কিছুটা “এসেছে নতুন শিশু, ছেড়ে দিতে হবে স্থান” টাইপ ঘটনা। তখন সে মরণশীল পৃথিবীতে চলে আসে। তারপর সুগন্ধি মশলা দিয়ে তৈরি বাসায় আগুন ধরিয়ে সে আগুনে আত্মাহুতি দেয়, সুযোগ করে দেয় নতুন ফিনিক্সের জন্ম হওয়ার। ফিনিক্সের বয়স নিয়েও ঝামেলা আছে। কেউ বলেন ফিনিক্স বাঁচত এক হাজার বছর, কেউ বলেন ১৪৬১ বছর। কিন্তু কেউই ফিনিক্সকে পাঁচশ বছরের কম কিংবা পনেরশ বছরের বেশি হিসেবে আখ্যায়িত করেননি।
ফিনিক্সের অশ্রুর ছিল ক্ষত সারাবার ক্ষমতা। যারা হ্যারি পটার চলচ্চিত্রের “অর্ডার অফ দা ফিনিক্স” সিকুয়েলটা দেখেছেন, তারা এই ক্ষমতা সম্পর্কে অবগত আছেন, ঠিক কিনা? সে ছিল অমর। আবার ফিনিক্স যদি আশেপাশে থাকত, তাহলে মিথ্যে কথা বলা ছিল অসম্ভব! কারণ ফিনিক্স নিজে ছিল সৎ আর বিশ্বস্ত প্রাণী। তার আশেপাশে যাই থাকত, সেগুলোও তার সততার প্রভাবে প্রভাবিত হত। চিন্তা করুন, যদি সত্যিই ফিনিক্স পাখি থাকত, কী ঝামেলাটাই না পোহাতে হত মানবজাতিকে! ফিনিক্সের খাবার দাবারের অভ্যাসও ছিল পৃথিবীর অন্যান্য পাখির চেয়ে আলাদা। ফলমূল কিংবা বাদাম-বীজ নয়, ফিনিক্স খেত কুন্দু (গাছ থেকে প্রাপ্ত এক ধরনের সুগন্ধি আঠা)।
ফিনিক্স পাখি কীসের প্রতীক?
সূর্যের স্ফুলিঙ্গ থেকে ফিনিক্সের মৃত্যু ঘটে অথচ ফিনিক্স পাখি কিনা সূর্যেরই প্রতিনিধিত্ব করে! সূর্য যেমন দিন শেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, কিন্তু পরদিন নতুন করে জন্ম নেয়, সেভাবে ফিনিক্স পাখিরও জীবনচক্র চলতে থাকে। একই জিনিস আমরা দেখি খ্রিস্টান ধর্মে, যেখানে মৃত্যুবরণের পর তিনদিনের মাথায় যীশু খ্রিস্ট পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠেন। ধরা হয়, পুনরুজ্জীবনের বিষয়টি খ্রিস্টান ধর্মের প্রবর্তকেরা ফিনিক্সের পৌরাণিক কাহিনী থেকে ধার নিয়েছিলেন। ফিনিক্স পাখি আগুন থেকে জন্ম নেয়, আবার আগুনেই আত্মাহুতি দেয়। এ কারণে কোনো কোনো ধর্মে একে মহাজাগতিক অগ্নির সাথে তুলনা করা হয়েছে। সেসব ধর্মমতে, আমাদের পৃথিবী মহাজাগতিক অগ্নি থেকে সৃষ্টি হয়েছিল, আবার এই অগ্নিই পৃথিবীকে গ্রাস করে নেবে। ফিনিক্স আমেরিকার অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের রাজধানী ‘ফিনিক্স’-এর প্রতীক। এই শহরের নামকরণ এক মজার ঘটনা। অনেক আগে এই শহর পরিচিত ছিল বৃহদাকার মিষ্টিকুমড়ার ফলনের জন্য। শহরের নামও ছিল পাম্পকিনভিল। তখন এই এলাকায় বাস করত ‘হোহোকাম’ গোষ্ঠীর জনগণ। একসময় উপনিবেশকারীরা এসে যুদ্ধ বিগ্রহের মাধ্যমে এলাকাটি দখল করে নেয়। দখলের পর স্বাভাবিকভাবে সেখানে তাদের বসবাস শুরু হয়। লর্ড ড্যারেল ডুপ্পা ছিলেন একদম প্রথম দিককার একজন বসতকারী। তিনি এলাকাটির নতুন নাম দেন ‘ফিনিক্স’, কারণ আগের হোহোকাম সভ্যতার ধ্বংসস্তুপ থেকে জন্ম নিয়েছে এই নতুন শহর।
অন্যান্য পুরাণে ফিনিক্স পাখির অস্তিত্ব
গ্রিক পুরাণের ফিনিক্স পাখির সাথেই আমজনতার পরিচয় বেশি। কিন্তু হিন্দু, ইহুদী, রাশিয়ান, পার্সি, চৈনিক, তিব্বতীয়, তুর্কি, আরব্য, জর্জিয়ান, জাপানিজ, নেটিভ আমেরিকান কিংবা মিশরীয় পুরাণেও ফিনিক্সের মত পাখির উল্লেখ আছে। এর মধ্যে মিশরীয় “বেনু”-র কথা আমরা আগে বলেছি। চলুন জেনে নিই অন্য পুরাণগুলোয় কী নামে পরিচিত এই পাখি!
ইহুদী – মিলশাম
হিন্দু – গরুড়, গান্দাবেরুন্দা
রাশিয়ান – আগুনপাখি
পার্সি – সিমোর্গ
চৈনিক – ফেংহুয়াং, যু কুয়ে
তিব্বতীয় – মে বাই কার্মো
তুর্কি – যুম্রুদু আঙ্কা
আরব্য – আঙ্কা
জর্জিয়ান – পাস্কুঞ্জি
জাপানিজ – হোওয়ু
নেটিভ আমেরিকান – বজ্রপাখি
বেনুঃ মিশরীয় পুরাণের ফিনিক্স
মিশরীয় পুরাণে ফিনিক্স পাখির উল্লেখ আছে “বেনু” নামে। বেনু ছিল সারস গোত্রীয় পাখি এবং দেবতা ওসিরিস-এর প্রতীক। পাহাড়ের চূড়া কিংবা উঁচু স্তম্ভ ছিল বেনুর আবাসস্থল। মিশরের জনগণ যেভাবে সূর্যদেবতা ‘রা’ কিংবা পাতালের দেবতা ‘ওসাইরিস’-এর পূজা করত, তেমনিভাবে বেনুর পূজাও করত। বেনু ছিল স্ত্রী পাখি এবং তার পালক ছিল লাল-সোনালি। কেউ বলেন বেনু বাঁচত ৫০০ বছর, কেউ ১৪৬১ বছর। একে ধরা হত পুনর্জন্ম আর অমরত্বের প্রতীক হিসেবে।

নীল (নাইল) নদে বন্যা হলে যখন মিশরের তীরবর্তী এলাকা প্লাবিত হয়ে উর্বর জমিতে পরিণত হত, তখন সে জমিতে ফসলের বন্যা বয়ে যেত। এই যে খরা মৌসুম শেষে জমির উর্বর হওয়ার চক্র, একে পুনর্জন্মের সাথে তুলনা করত মানুষ। বেনুর সাথে এই চক্রের একটা সম্পর্ক আছে বলে ভাবত তারা। তাই দেবতা ওসিরিস আর রা-এর সাথে বেনুর পূজাও চলত প্রাচীন মিশরীয়দের মাঝে। আবার বেনুর পুনর্জন্ম লাভের ক্ষমতার কারণে একে আগুন আর স্বর্গের প্রতীক হিসেবেও মানা হত। কেউ কেউ মনে করেন, গ্রিক পুরাণের ফিনিক্স পাখি এসেছে মিশরীয় পুরাণের বেনু চরিত্রটি থেকে। আবার কেউ কেউ মনে করেন উল্টোটা। আমরা আপাতত কে কোথা থেকে এসেছে না খুঁজে বেনু সম্পর্কে কিছু জানার চেষ্টা করি।
ধারণা করা হয়, বেনু চরিত্রটি মিশরীয়দের চিন্তায় এসেছিল পূর্ব আফ্রিকার ফ্ল্যামিঙ্গো পাখি দেখে। আবার প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বিশালাকারের সারস পাখির প্রমাণ পেয়েছেন যারা প্রায় ৫০০০ বছর আগে পার্সিয়ান উপসাগর এলাকায় বাস করত। অনেকের ধারণা, মিশরীয়রা এই বিশাল পাখিকে কালেভদ্রে মিশরের আকাশে উড়তে দেখত আর সেখান থেকে বেনুর উৎপত্তি। অথবা তারা আরব সাগর পার হয়ে আসা পর্যটকদের কাছ থেকে এই পাখি সম্পর্কে শুনে শুনে বেনুকে কল্পনা করে নিয়েছিল।
ফেং হুয়াংঃ চৈনিক পুরাণের ফিনিক্স
প্রাচীন চীনে ফিনিক্স পাখি পরিচিত ছিল ফেং হুয়াং নামে। এর ঠোঁট ছিল মোরগের, ঘাড় ছিল সাপের, চেহারা ছিল আবাবিল পাখির, বুক ছিল হাঁসের, পিঠ ছিল কাছিমের, নিতম্ব ছিল হরিণের আর লেজ ছিল মাছের। এটি ছিল চৈনিক সম্রাজ্ঞী এবং নারীজাতির প্রতীক। সেই সাথে একে সূর্য আর দক্ষিণ দিকের প্রতীক হিসেবেও বিবেচনা করা হত। ফেং হুয়াংয়ের দেখা পাওয়াকে সৌভাগ্য মনে করা হত। এটি দেখা দিলে বুঝা যেত, বিজ্ঞ কোনো ব্যক্তি রাজা হিসেবে সিংহাসনে বসেছেন এবং পুরনো অন্ধকার যুগের অবসান ঘটিয়ে নতুন যুগের সূচনা করেছেন। চীনের রাজপ্রাসাদ আর মন্দিরগুলোর সামনে প্রহরী হিসেবে সিরামিকের তৈরি পশুর মূর্তি বসানো থাকত, যাদের দলনেতা হিসেবে থাকত ফেং হুয়াংয়ের মূর্তি।

ফেং হুয়াংকে মনে করা হত অসম্ভব নরম চরিত্রের এক প্রাণী। এতই নরম যে, সে কোনো প্রাণকে (উদ্ভিদ এবং প্রাণী) খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করত না, সে খেত শুধু শিশিরকণা। একমাত্র চৈনিক সম্রাজ্ঞীরই অধিকার ছিল ফেং হুয়াংয়ের ছবি বা প্রতীক সম্বলিত জামাকাপড় পরার। প্রতীকে সাধারণত ফেং হুয়াংকে ড্রাগনের সাথে মিলিতভাবে আঁকা হত। এখানে ড্রাগন ছিল চীন সাম্রাজ্যের প্রতীক।
মিলশামঃ ইহুদী পুরাণের ফিনিক্স
মিলশামের কাহিনীর শুরু ইডেন বাগান থেকে। তখন ইডেন উদ্যানে মানুষের অর্থাৎ আদম আর হাওয়ার চলাফেরা ছিল। যখন সাপের দেখানো প্রলোভনে পা দিয়ে হাওয়া নিষিদ্ধ ফল খায় আর আদমকেও খাওয়ায়, তখন সে ওই ফল বাগানের অন্যান্য প্রাণীদেরও সাধে। অনেক প্রাণীই ফলটা খেতে অস্বীকৃতি জানায়। তাদের মধ্যে মিলশামও ছিল। মিলশামের এই বিশ্বস্ততায় খুশি হয়ে ঈশ্বর তার বসবাসের জন্য গোটা একটা শহর উপহার দেন। সাথে মিলশামকে করে দেন অমর। মৃত্যুদেবতার ক্ষমতা ছিল না মিলশামকে ছোঁয়ার। ঈশ্বরের দেওয়া শহরে মিলশাম এক হাজার বছর ধরে নির্বিঘ্নে বাস করত। যখন ওর জীবনচক্র ফুরিয়ে আসত, তখন সে মারা গিয়ে আবার জীবিত হত, কারণ ঈশ্বরের দেওয়া আশীর্বাদের কারণে সে ছিল অমর। তার মৃত্যু ঘটা অসম্ভব। এজন্য প্রতি এক হাজার বছর পরপর মিলশামের পুনরুজ্জীবনের ঘটনা ঘটতে থাকে।
গরুড়ঃ হিন্দু পুরাণের ফিনিক্স
গরুড়কে আমরা চিনি দেবতা বিষ্ণুর বাহন হিসেবে। কিন্তু আমরা জানতাম কি, ফিনিক্স পাখির ভারতীয় রূপ এই গরুড়? একে সকল পাখির রাজা বলা হয়। খল সাপের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য গরুড় পরিচিত ছিল। প্রায়ই গরুড়কে দেখা যায় বিষ্ণুকে পিঠে চড়িয়ে উড়ে বেড়াতে।

Sources:
- https://en.wikipedia.org/wiki/Phoenix_(mythology)
- https://www.ancient-origins.net/myths-legends/ancient-symbolism-magical-phoenix-002020
- https://mythology.net/mythical-creatures/phoenix/