এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো, বারো, তেরো, চৌদ্দ, পনেরো, ষোল, সতেরো, আঠারো, ঊনিশ, বিশ
কলেজ স্টেশনে ঠাণ্ডা পড়া শুরু হয়েছে। একদম দেশের মত ঠাণ্ডা। সকালে চারপাশে কুয়াশা দেখা যায়, দিন গড়াতে গড়াতে সূর্যের আলো ঝলমল করে। দেশে থাকতে শীতের দুপুরে রোদ পোহাতাম। দারুণ লাগত। বৈদেশে মৌজ করে রোদ পোহানোর সময় নেই। ক্যাম্পাসে দৌড়াতে দৌড়াতে যতটুকু গায়ে মাখা যায়। ছুটির দিনে বাসায় বসে কম্পিউটারে ঢং করতেই ভাল লাগে বেশি। উঠোনে বসে রোদ পোহানোর কথা মাথায় থাকে না। তবে রোদ পোহাই আর না পোহাই, টেক্সাসের বিচ্ছিরি গরমের চেয়ে এই ঠাণ্ডা অনেক আরামদায়ক। সবাই বলছে এবারের ঠাণ্ডা নাকি অনেক দেরিতে পড়েছে। অন্য বছর অক্টোবরেই পড়ে যায়। এবার নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেও গরম ছিল। ঘোর কলিকাল (বা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন)। এরপরও কি তোমরা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অনুসরণ করে বলবে গ্লোবাল ওয়ার্মিং একটা বাটপারি? অবশ্য লিওনার্দো দে ক্যাপ্রিও যেখানে মার খেয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমার মত ছাপোষা কেরানির কথা কে শোনে? আমার অ্যাডভাইজর মাঝে মাঝে আক্ষেপ করে বলেন, “পৃথিবী যেখানে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমি পুষ্টি নিয়ে গবেষণা করে কী চুলটা ছিঁড়ব? আমার তো উচিৎ ক্লাইমেট চেঞ্জ নিয়ে কাজ করা!” আমি উৎসাহ দিয়ে বলি, “সময় তো চলে যায়নি। শুরু করে দ্যাও!” প্রফেসর উদাস হয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন। আমি জানি জীবনের কোনো এক সময়ে এই লোক ঠিকই আবহাওয়ার বৈশ্বিক পরিবর্তন নিয়ে কাজ করবেন। আন্ডারগ্র্যাজুয়েটদের পুষ্টিবিজ্ঞান পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে উনি ক্লাইমেট চেঞ্জ নিয়ে কথা বলেন। ছেলেমেয়েগুলোকে সচেতন করার চেষ্টা করেন। আমারও এই রাস্তা ধরা দরকার।
কিছুদিন আগে প্রফেসরকে বলেছিলাম আমি একটা প্রিটেস্ট-পোস্টটেস্ট স্টাডি করতে চাই। শুনে প্রফেসর ঝিলিক দিয়ে উঠলেন, “আরে ব্বাহ! এখনই তুমি আইডিয়া প্রসব করা শুরু করেছ? দিন তো আরও পড়েই রয়েছে।” তারপর বেশ কিছুদিন আলোচনা চলল স্টাডি ডিজাইন নিয়ে। আমি ভেবেছিলাম আইডিয়া খালাস করলেই বুঝি বাকি জিনিস গড়গড় করে হয়ে যাবে। কিন্তু একটা পরীক্ষণ দাঁড়া করানো যে এত ঝামেলা, কে জানত? রিসার্চ কোয়েশ্চেন, প্রোটোকল লেখ; আইআরবি এপ্রুভাল লাগবে কিনা খোঁজ নাও, লাগলে সেটার জন্য এপ্লিকেশন কর। প্রি-পোস্টটেস্টের কোয়েশ্চেনিয়ার বানাও, সেটা পাইলট টেস্ট কর। তবে সত্যি বলতে, ঝামেলার হলেও কাজগুলো করতে ভাল লাগছে কারণ এটা আমার আইডিয়া। এখন বুঝি গবেষকরা কীসের প্রণোদনায় গবেষণা করেন। এই পরীক্ষণের লেজ ধরে পরিচয় হল সেন্টার ফর টিচিং এক্সিলেন্সের এক প্রফেসরের সাথে। ষাটোর্ধ্ব নারীটি এমন ঘাঘু মাল যে উনার সাথে পনেরো মিনিট কথা বলে আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। উনি আমার পরিকল্পনায় একশো একটা সীমাবদ্ধতা খুঁজে পেলেন। আমি মুগ্ধ। অ্যাডভাইজরকে ধন্যবাদ যে উনি এই প্রফেসরের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। কথায় কথায় ঘাঘু প্রফেসরের জানতে চাইলাম, উনারা যে ধরনের গবেষণা করেন, আমিও যেহেতু ঐরকম কিছু করছি, উনাদের সাথে কোলাবরেশন সম্ভব কিনা। কোলাবরেশন করলে হয়ত কিছু ফান্ড পাওয়া সম্ভব উনাদের কাছ থেকে। উনি বললেন, ব্যাপারটা নিয়ে ঘেঁটে দেখবেন। সেই থেকে আশায় আশায় দিন গুজরান করছি। অ্যাডভাইজর অবশ্য হেডস আপ দিয়ে রেখেছেন, “এখান থেকে কিছু না পেলে মন খারাপ কোরো না। আরেক জায়গায় এপ্লাই কোরো। ফান্ডের জন্য দৌড়াদৌড়ি করা এবং রিজেক্টেড হওয়া গবেষকদের জীবনের অংশ।”
এই মুহূর্তে আমি বেশ কয়েকটা প্রজেক্টের সাথে জড়িত। একটা সিস্টেম্যাটিক রিভিউ করছি, একটা রিভিউ আপডেট করছি, আর কিছু প্রজেক্টে সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করছি। প্রথম দুটো প্রজেক্টে আমি লিডার হিসেবে আছি। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে টাইম ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে পিপল ম্যানেজমেন্ট পর্যন্ত সবকিছু হাতেকলমে শেখা হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সমস্যার কারণে টিম মেম্বাররা যখন বলে, “কাজ জমা দেওয়ার সময় বাড়ানো যাবে কি?”, তখন খেয়াল রাখতে হয় যেন সময় বাড়ালেও সেটা মূল টাইমলাইনকে প্রভাবিত না করে। আবার দফায় দফায় মেম্বারদের নিয়ে মিটিং করতে হয় যেন সবাই সব ব্যাপারে আপডেটেড থাকে। এসব বিষয়ে আমার প্রোএকটিভিটি দেখে, নাকি তার মেন্টি (mentee) বলে কে জানে, অ্যাডভাইজর একদিন একটা কাজ করে বসলেন। আমাকে ডেকে বললেন, “কানাডায় যেতে চাও?” আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম, “অবিশ্যি!” উনি হেসে বললেন, “ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটিতে একটা সামার ওয়ার্কশপ হবে এভিডেন্স বেইজড মেডিসিনের উপর। ওখানে তোমাকে নিয়ে যেতে চাই।” এই ওয়ার্কশপের কথা অনেক শুনেছি। ‘এভিডেন্স বেইজড মেডিসিন’ টার্মের জনক ডঃ গর্ডন গায়াট ওয়ার্কশপটার প্রতিষ্ঠাতা। উনি আবার আমার অ্যাডভাইজরের পোস্টডক অ্যাডভাইজর ছিলেন। তাই আমার প্রফেসর চাচ্ছেন আমি যেন ওখানে গিয়ে ডঃ গায়াটের লেকচার শুনতে পারি। এমন সুযোগ কে ছাড়ে? তার উপর বিমান ভাড়া ছাড়া আমার কোনো খরচ নেই। রাজি হয়ে গেলাম। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২২ সালের গ্রীষ্মে সাতদিনের জন্য কানাডার হ্যামিল্টনে যাব। ম্যাকমাস্টার ওখানেই অবস্থিত। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের Department of Health Research Methods, Evidence & Impact আমার অন্যতম স্বপ্নের জায়গা। টামুতে এপ্লাইয়ের আগে এখানে এপ্লাই করার পরিকল্পনা করছিলাম। নানা কারণে হয়ে উঠেনি। তবে পোস্ট ডক যদি কখনো করি, এখানে আসার চেষ্টা করব।
পিএইচডি করতে এসে একটা জিনিস বুঝতে পারছি – ফেসবুক আমার জন্য সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই নয়। আগে দেখতাম আমার বন্ধুদের মধ্যে যারা পিএইচডি করছে, তারা ফেসবুকে খুবই কম সক্রিয়। একমাসে হয়ত একটা পোস্ট দেয়। হয়ত বছরে একটা। ভাবতাম, এমন হওয়ার কারণ কী? এখন নিজে বুঝি। ফেসবুকে প্রোডাক্টিভ কিছু তো হয়ই না, উল্টো খারাপ খবর দেখে মেজাজ গরম হয়, মানুষের একে অন্যের পিছে লাগা দেখে গা গুলোয়। ২০১১ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ফেসবুকে অনেক শিক্ষণীয় পোস্ট দেখেছি যেটার হার গত কয়েক বছরে শুন্যের কোঠায় নেমেছে। তাই মোবাইল থেকে ফেসবুক মুছে দিয়েছি। ল্যাপটপ থেকে হালকা পাতলা ঢুকি, কিন্তু ফ্রিকোয়েন্সি অনেক কমে গেছে। এখন টুইটারেই বেশি সময় কাটাই। দুনিয়ার গবেষককে টুইটারে অনুসরণ করি, তাদের টুইট পড়ি। অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আর ওয়েবসাইটও অনুসরণ করি। সময় ভাল কাটে। কোনোকিছু শেখার জন্য পরিবেশ লাগে। চারপাশে প্রভাব বিস্তারকারী মানুষজন লাগে। টুইটারে আর লিংকডিনে সেটা পাই। আপনারাও চাইলে ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। বলছি না ফেসবুক ডিলিট করে দিন। কিন্তু ফেসবুকের কারণে যেন আপনার স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত না হয়, সেভাবে ব্যবহার করুন।
কিছুদিন আগে আরেকটা খুশির খবর পেলাম। আমার মাস্টার্স থিসিসকে চেপেচুপে ছয় হাজার শব্দের মধ্যে এনে যে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধটা লিখেছিলাম, সেটা নিউট্রিশন নামের এক জার্নালে একসেপ্টেড হয়েছে। প্রকাশিত হলে এটাই হবে আমার জীবনের প্রথম পাব্লিশড আর্টিকেল। আহ! কতদিন স্বপ্ন দেখেছি এমন একটা মুহূর্তের। অবশেষে ধরা দিল। আরেকটা খুশির কথা হল, ২০২২ সালের বইমেলায় পুরাণ নিয়ে আমার আরেকটা বই বের হবে। এবার শুধু আমি একা নই, সহ লেখক হিসেবে আছেন আমার অর্ধাঙ্গ মশাই, রিজওয়ানুর রহমান প্রিন্স। কতদিন চেয়েছি আমাদের দুজনের যৌথ একটা বই থাকবে! কিন্তু হয়েই উঠছিল না। এবার সে ইচ্ছেও পূরণ হতে যাচ্ছে। প্রথম যৌথ লেখা পুরাণ নিয়ে হলেও পরের বই হবে বিজ্ঞান নিয়ে। দেখি আলসেমি থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠা যায় কিনা।