এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো, বারো, তেরো, চৌদ্দ, পনেরো, ষোল, সতেরো, আঠারো, ঊনিশ, বিশ
এস্প্রেসো কফিতে চুমুক দিতে দিতে ভাবছি কীভাবে অ্যাডভাইজরের কাছে ছুটির কথাটা পাড়া যায়। এই গ্রীষ্মে (পাশ্চাত্যে যেটা সামার নামে পরিচিত) আমরা রকি পর্বতশ্রেণী দেখতে যাবো। অন্তত পরিকল্পনা করেছি সেরকমই। কিন্তু এখনো অ্যাডভাইজরকে জানানো হয়নি। উনি ছুটি মঞ্জুর না করলে যাওয়া যাবে না, অথচ আমাদের পরিকল্পনা করা শেষ। অ্যাডভাইজরের ব্যাপারে হালকা ধারণা আছে বলে নিশ্চিন্তি অনুভব করছি। উনিও ভীষণ ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। এক সপ্তাহ ছুটি পেলেই দৌড় দেন এখানে সেখানে। বসন্তের ছুটিতে (স্প্রিং ব্রেক নামে যাকে চেনে মানুষ) চলে গিয়েছিলেন বিগ বেন্ড জাতীয় উদ্যানে। অথচ আমি বাসায় বসে ঘোড়ার ঘাস কেটেছি। সে ঘাস দিয়ে আঁটি বেঁধেছি, তারপর সে আঁটি ফেলে দিয়েছি। অর্থাৎ পুরো ছুটি জলে। উনি ফিরে এসে যখন জিজ্ঞেস করলেন, “কোথাও ঘুরতে গিয়েছিলে?”, মেজাজটা এতো খারাপ হলো! মেজাজ যাতে দ্বিতীয়বার খারাপ না হয় সেজন্য গ্রীষ্মে ঘুরতে যাবো ঠিক করলাম। কোথায় যাওয়া যায়? ভাবতে ভাবতে দেখি তালিকা ক্রমেই বড় হচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলেস শহর নাকি ইওসেমিতি জাতীয় উদ্যান? উত্তরের ওয়াশিংটন নাকি মন্টানা? ইউটার যায়ন জাতীয় উদ্যান নাকি অ্যারিজোনার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন? চিন্তাভাবনা শেষে ঠিক হলো কলোরাডোর রকি মাউন্টেইন জাতীয় উদ্যান (ফিচার্ড ইমেজ দ্রষ্টব্য)। হুমায়ূন আহমেদ আর জন ডেনভারের সৌজন্যে রকি মাউন্টেইন হাই, আর সমাজ বইয়ের সুবাদে রকি পর্বতশ্রেণী চেনে না, এমন বাঙালি পাওয়া দুষ্কর। আমিও সেই কিশোর বয়স থেকে রকি পর্বত দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছি। এবার সে স্বপ্ন পূরণ করার পালা। তো, অ্যাডভাইজরের সাথে মিটিংয়ের সময় পেড়েই ফেললাম কথাটা, “আমি যদি মে’র মাঝামাঝিতে ছুটি নিই, ধরো দশ থেকে বিশ তারিখের ভেতর, তাহলে কি সমস্যা আছে?” ডঃ জন্সটন মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন। আমি বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। এটা কি হ্যাঁ, নাকি না? আরেকটু ব্যাখ্যা দিয়ে বললাম, “মে’র দ্বিতীয় সপ্তাহে স্প্রিং সেমিস্টার খতম হবে আর পয়লা জুন থেকে সামার সেমিস্টার শুরু হবে। এর আগে একটু ‘চিল’ করতে চাই। একটু ‘আউট অফ টাউন’ যেতে চাই।” ডঃ জন্সটন হাসতে হাসতে বললেন, “অবিশ্যি! অবিশ্যি! কোনো সমস্যা নেই।”
দেখতে দেখতে পিএইচডিতে আমার আট মাস পার হলো। আট মাসে কী বুঝলাম? আরও একবার বুঝলাম জ্ঞানের সাগরে আমি এক ফোঁটা শিশির বিন্দু, সাগর সৈকতে এক কণা বালু। প্রথমবার বুঝেছিলাম সেই ২০১২-১৩ সালে যখন সংশয়বাদীতা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলাম। এরপর প্রতি পদে জীবন ঘেটি ধরে আমাকে বুঝিয়েছে আমি একটা মামুলি প্রাণমাত্র যার বিশাল একখানা মস্তিষ্ক থাকার পরও অযৌক্তিক আচরণ করে, জ্ঞানের সাগরে হাবুডুবু খেতে ভয় পায়, নতুনভাবে চিন্তা করতে গড়িমসি করে। মাঝে মাঝেই মনে হয় জীবনের বিশটা বছর দেশী বিদ্যালয় আর মহাবিদ্যালয়ে কাটিয়ে কী চুল শিখলাম? না শেখানো হলো মুক্তভাবে চিন্তা করার প্রক্রিয়া, না শিখেছি গবেষণা করা। সেন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় মাস্টার্স করতে এসেই বরং চোখের সামনে জ্ঞানের দরজা খুলে গেলো। যদিও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন প্রধানকে আমি বিভিন্ন কারণে পছন্দ করতাম না, কিন্তু উনার প্রতি আমি আজীবন কৃতজ্ঞ আমাকে অ্যাডমিশন দেওয়ার জন্য। আমি দীর্ঘদিন ইম্পোস্টার সিন্ড্রোমে ভুগেছি স্লুতে আসা নিয়ে। খালি মনে হতো আমার যোগ্যতা না থাকার পরও সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু চার বছরে অ্যাডমিশন প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছু মিছু জ্ঞানলাভের পর বুঝি, হালকা যোগ্যতা ছিলো বলেই আসতে পেরেছি। কিন্তু এই ক’বছরের মধ্যে একটা মাস্টার্স, একটা চাকরি আর পিএইচডির আট মাসের অভিজ্ঞতা নিয়েও আত্মবিশ্বাসের সাথে জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় অংশ নিতে পারি না। নিজের মতামত দিতে গেলে হাঁটু কাঁপে। কিছু বলতে গেলে মনে হয়, আরে! এই বিষয়ে তো কিছুই জানি না। তবে অবস্থা উন্নতির দিকে। আত্মবিশ্বাস অর্জনের একটা উপায় হলো নিজের গবেষণা বা পড়ানোর (টিচিং) টপিকে আপডেটেড জ্ঞান রাখা। এজন্য দরকার পড়াশোনা করা। প্রচুর না হলেও প্রতিদিনই পড়ি। সেই সাথে বিভিন্ন ইভেন্টে অংশ নিই যেখানে মানুষের সাথে কথা বলার সুযোগ আছে। আমার মত মুখচোরা (ইন্ট্রোভার্ট বা অন্তর্মুখী) মানুষের জন্য এটা খুবই জরুরী। আপনিও যদি অন্তর্মুখী হন, ভয় পাবেন না। মনে রাখবেন জ্ঞানের অভাব সারাজীবন থাকবে। পৃথিবীর সব বিষয়ে জ্ঞান ধারণ করা সম্ভব নয়। তাই মানুষ পিএইচডি করে একটা নির্দিষ্ট টপিকে দক্ষ হওয়ার জন্য, সবকিছুতে নয়। তবে… কথা আছে। এক টপিকে বিশেষজ্ঞ হলে যে অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞান রাখার দরকার নেই, তা নয়। একটা টপিকে বিশেষজ্ঞ হতে হলে আশেপাশের আরও অনেক বিষয়ের উপর দখল থাকতে হয়। কোনো টপিক স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তাই শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে আপনি বেশ কয়েকটা বিষয়ের উপর দখলদার হয়ে বসে আছেন।
আরেকটা বিষয় শিখেছি আট মাসে। বৃত্তির জন্য আবেদন করতে হবে প্রচুর পরিমাণে। যেখানে আপনার উপযোগী বৃত্তি/ফেলোশিপ পাবেন, সবগুলোতে আবেদন করবেন যদি হাতে সময় থাকে। সেই সাথে খুঁজবেন কীভাবে সুপারভাইজর বা গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের কাছ থেকে ফান্ড ম্যানেজ করে বিভিন্ন কনফারেন্স বা ওয়ার্কশপে অংশ নেওয়া যায়। আসছে অক্টোবর পুষ্টিবিজ্ঞানের জগতে সবচেয়ে নামকরা প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাকাডেমি অফ নিউট্রিশন অ্যান্ড ডায়াটেটিক্স’-এর বার্ষিক কনফারেন্স “Food & Nutrition Conference & Expo™” অনুষ্ঠিত হবে। এটাকে সংক্ষেপে FNCE বা ফেন্সি বলে। এই ফেন্সি ডাইলের ফেন্সি নহে। তো, এখানে যাওয়ার জন্য অ্যাডভাইজারকে বললাম, “আমার সাবমিট করা পোস্টার যদি এখানে এক্সেপ্টেড হয়, তুমি কি খরচাপাতি দিবা যাওয়ার জন্য?” ডঃ জন্সটন বললেন, “হোটেল ভাড়া, বিমান ভাড়া, রেজিস্ট্রেশন ফি মিলিয়ে কেমন খরচ হতে পারে জানাও। দেখি সম্ভব কিনা।” আমি খুঁজে পেতে সবচেয়ে সস্তা মোটেল বের করলাম। বললাম পাঁচ রাত থাকার জন্য তিনশো ডলার লাগবে। ডঃ জন্সটনের চোয়াল ঝুলে পড়লো। চোখ বড় বড় করে বললেন, “অ্যাঁ! আমার তো ধারণাই ছিলো না একশো টাকার কমে হোটেল পাওয়া যায়।” শুনে নিজেকে থাপড়ালাম কিছুক্ষণ। গরীবের নজর ছেঁড়া কাঁথা পর্যন্ত। আমিও তাই এতো সস্তা খুঁজতে চেয়েছি। যাক গে, আমার কথা ফ্লোরিডা যাওয়া নিয়ে। ডঃ জন্সটন যদি কিছু দেন আর গ্র্যাজুয়েট ট্রাভেল অ্যাওয়ার্ডয়ের জন্য আবেদন করে যদি কিছু পাই, তাহলে একটা টুর হয়ে যাবে ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোতে।
এই প্রসঙ্গে আরেকটা কাহিনী মনে পড়লো। গত বছরের আগস্টের কাহিনী। প্রথমবারের মত কলেজ স্টেশনে আসবো। আসতে আসতে বিকেল হবে। ঐসময় আমাদের নতুন এপার্টমেন্টের লিজিং অফিস বন্ধ থাকবে বলে এপার্টমেন্টে উঠতে পারবো না। তাই ঠিক করলাম প্রথম রাতটা হোটেলে থাকবো। সেজন্য উইন্ডহ্যাম কোম্পানির অধীনে মাইক্রোটেল নামের এক হোটেলে রুম বুক দিলাম। ফল সিজন বলে হয়তো মাঞ্জামারা হোটেলটায় বিশাল ছাড় দিচ্ছে। অন্য সময় হলে এখানে বুকিং দেওয়ার প্রশ্নই উঠতো না। যা হোক, ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে বিকেল চারটা নাগাদ কলেজ স্টেশনে পৌঁছলাম। মাইক্রোটেলের রিসেপশনে দেখা করে, ঘরের চাবি নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। নির্দিষ্ট লটে গাড়ি পার্ক করে একটা ছন্নছাড়া, পুরনো দালানের লোহার সিঁড়ি বেয়ে দুইতলায় উঠলাম। আমাদের মাথায় ঢুকলো না কেন রিসেপশন এতো হাইফাই অথচ মূল হোটেল এতো পোঁতানো। দুইশো সাত নাম্বার রুম দেওয়া হয়েছে আমাদের। সেটার দরজায় চাবি দিয়ে যতই কিরিঞ্চি করি, দরজা আর খুলে না। এদিকে ক্লান্তিতে আমাদের অজ্ঞান হওয়ার দশা। কোনোমতে রুমে ঢুকে স্নান করে বিছানায় গড়িয়ে পড়ার ইচ্ছে, অথচ দরজাই খুলতে পারছি না। পাঁচ মিনিটের মত হ্যাঁচোড় প্যাঁচোড় করে ফিরে এলাম রিসেপশনে। কোন্সিয়ার্শকে (এখানে রিসেপশনিস্ট বলে না, concierge বলে। কাছাকাছি উচ্চারণ কোন্সিয়ার্শ) হাত দিয়ে পুরনো দালানটা দেখিয়ে বললাম, “চাবি তো রুমের দরজায় কাজ করে না!” মেয়েটা বিস্মিত হয়ে বললো, “তোমাদের রুম তো এই বিল্ডিংয়ে! ওই বিল্ডিং তো আরেক মোটেলের। লিফট ধরে দুইতলায় উঠে যাও, হাতের ডানে তোমাদের রুম পাবে।” আমি বেক্কলের মত দাঁড়িয়ে রইলাম। মস্তিষ্কের নিউরনগুলো বিভ্রান্ত হয়ে গেছে নিজেদের বোকামিতে। পরে রুমে এসে আরেকবার হতভম্ব হলাম। সে কী হাইফাই! তারপর প্রিন্স আর আমি মিলে হাসতে হাসতে লুটোপুটি। এই না হলে আমাদের মত গরীবের মানসিকতা! ছেঁড়া কাঁথার বাইরে নজরই যায় না। আমাদের জন্য যে মখমলের কম্বল অপেক্ষা করতে পারে, কল্পনাতেই আসে না।