এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ, এগারো, বারো, তেরো, চৌদ্দ, পনেরো, ষোল, সতেরো, আঠারো, ঊনিশ, বিশ
মাঝে মাঝে প্রতিদিনকার জীবনে ভীষণ হাঁফ ধরে যায়। এই যেমন এখন ধরেছে। গত কয়েকদিন যাবত খালি মনে হচ্ছে ‘জীবন এতো বোরিং ক্যানে?’ চব্বিশ ঘণ্টা কাজ আমি কখনই করি না। কোনোদিন করবোও না। নিজের জন্য কয়েক ঘণ্টা বরাদ্দ রাখা আমার প্রতিদিনকার অভ্যাস। কিন্তু সেই কয়েক ঘণ্টায়ও দেখা যায় রুটিন বাঁধা কিছু কাজ করছি। হয় লেখালেখি, নয় মুভি/টিভি সিরিজ দেখাদেখি। এই করতে করতেও তো একসময় বিরক্তি ধরে যায়, নাকি? তখন মনে হয় সব ছেড়ে ছুঁড়ে বেরিয়ে পড়ি, কোনো পাহাড়ে চলে যাই। যতই ভাবি এই দুনিয়াবি কাজকাম করে কী স্বার্থ সিদ্ধি করছি, ততই ধরা পড়ে এসব কাজের অর্থহীনতা। মানুষ নিজেই টাকার ধারণা তৈরি করেছে, চাকরি নামক বিচ্ছিরি একটা ব্যবস্থা তৈরি করেছে এবং সমাজের বাসিন্দাদের এই ফালতু ব্যবস্থাপনায় আটকে ফেলেছে। সমাজ কী? সমাজ তো আদতে মানুষের সমষ্টি। আমরা যখন সমাজ সমাজ করি, তখন কি সেটাকে একটা জীব ভাবি? না, আমরা সমাজ নামের কোনো জীবকে ভয় পাই না। আমরা ভয় পাই মানুষকে। এক দঙ্গল মানুষ কী মনে করবে, সেটা নিয়ে চিন্তা করে করে জীবন পার করে ফেলি। সেই এক দঙ্গল মানুষই সমাজ। এই ‘সমাজ’ একটা বিমূর্ত ধারণা, যেটা তৈরি করেছে মানুষ। নিজের প্রয়োজনে। তৈরি করে ধীরে ধীরে সেটার মধ্যে এমন সব জিনিস ঢুকিয়েছে, আধুনিককালে যেগুলো ছাড়া আয়েশি একটা জীবন কল্পনাই করা যায় না। এরকমই একটা ফালতু বিষয় হল টাকা। যাই করি না কেনো, সবার আগে মাথায় খেলে ‘যথেষ্ট টাকা আছে তো?’
গ্রীষ্মের ছুটিতে কলোরাডো যাবো ঠিক করেছি। সে পরিকল্পনা করতে গিয়েও হাজারবার চিন্তা, ‘ব্যাংকে এখন কতো আছে? ঘুরতে গেলে কতো খরচ হবে? শেষ পর্যন্ত কতো থাকবে? সেটা দিয়ে কয় মাস চলা যাবে?’ তার উপর সামার সেমিস্টারে আমার টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ থাকবে না। পুষ্টি বিভাগ শুধু ফল আর স্প্রিং সেমিস্টারের জন্য আমাকে টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে চাকরি দিয়েছে। সামারে নিজের গাঁটের পয়সা দিয়ে চলতে হবে বা অন্য কোথাও চাকরি জুটাতে হবে। এই প্যাঁড়া মাথায় নিয়ে আরেক অঙ্গরাজ্যে ঘুরতে যাওয়ার জন্য হ্যাডম লাগে। আমার আর প্রিন্সের হ্যাডম অনেক বেশি। আমরা ‘যেকোনো পরিস্থিতিতে’ দেশে উড়াল দেওয়ার জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ‘ধ্রুবক’ হিসেবে রেখে যেটুকু বাকি থাকে, সেটা দিয়ে ঘুরাঘুরির পরিকল্পনা করে ফেলি। আমাদের একটাই কথা – আইজ আছি কাইল নাই, ইচ্ছামতো ঘুরতে চাই। কিন্তু গ্রীষ্মে একটা চাকরি না জোটালে তো কলোরাডোর শান্ত স্নিগ্ধ পাহাড়ে গিয়ে শান্তি পাবো না। তাই অ্যাডভাইজরকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সামারের তিনমাস তোমার গবেষণা সহকারী হিসেবে চাকরি দিতে পারবা?’ উনি বললেন, ‘টেকা নাই।’ তবে অন্য এক ডিপার্টমেন্টের সাথে আমাকে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। ওদের সাথে বেশ এগুলো কথাবার্তা। আমি যদি ওদের ওখানে গ্র্যাজুয়েট অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যোগ দিই, তাহলে পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্টের সাথে কাজ করতে পারবো। পাবলিক হেলথের সাথে আমার গবেষণার অনেক মিল। তাই চাকরিটা আমার জন্য ভালোই হবে।
কিন্তু হঠাৎ ওরা জানালো, পাবলিক হেলথের সাথে ওদের কোলাবরেশন বন্ধ হয়ে গেছে। আমি যদি ওদের ওখানে যোগ দিই, আমাকে হেলথ সায়েন্সের বাইরে অন্য কোনো কাজ করতে হবে। শুনে আমার অ্যাডভাইজর নাখোশ হলেন। বললেন, ‘ওদের ওখানে কাজ করলে টাকা বানানো ছাড়া তোমার কোনো লাভ হবে না। সিভিতে কিছু লিখতে পারবে না।’ আমিও বেশ হতাশ হলাম। ঠিক তখনই কাকতালীয়ভাবে অ্যাডভাইজর একটা গ্র্যান্ট পেয়ে গেলেন। বললেন, ‘টেকা আসছে হাতে। করবা নাকি আমার গবেষণা সহকারীর কাজ?’ লাফিয়ে উঠলাম, ‘আবার জিগস!’ অন্য ডিপার্টমেন্ট যে বেতন দিবে বলেছিলো, সেটা থেকে অনেক ভালো বেতন দেবে অ্যাডভাইজর। সাথে আমার গবেষণা অভিজ্ঞতাও বাড়বে। অবস্থা পুরাই লালে লাল।
সামার অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ নিশ্চিত হয়েছে। এখন মজায় মজায় ঘুরতে যাবো। এই পোস্টের ফিচার ফটো হিসেবে রকি পর্বতমালায় অবস্থিত ক্যাজম হ্রদের ছবিও দিয়েছি। কিন্তু তারপরও কোথায় যেন তাল লয় কেটে যাচ্ছে। উত্তেজনাটা ঠিক আসছে না। বিভিন্ন প্রজেক্টের অগ্রগতি নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তা লাগে। সাথে স্কলারশিপ নিয়ে দুঃখ। বছরের শুরুতে যেসব বৃত্তির জন্য আবেদন করেছিলাম, কোনোটা থেকেই সাড়া পাইনি। কিন্তু দমে না গিয়ে আরেকটা বৃত্তির জন্য আবেদন করেছি দুইদিন আগে। কে জানে এটা থেকে কিছু পাবো কিনা। একটা আবেদনপত্র প্রস্তুত করতে ভালো সময় লাগে, মানসিক ধকলও যায়। সিভি আপডেট করা, পার্সোনাল স্টেটমেন্ট লেখা, স্কলারশিপ অনুযায়ী আমার রিসার্চের ইমপ্যাক্ট বর্ণনা করা, অ্যাডভাইজরের জন্য রেকোমেন্ডেশন লেটারের খসড়া লেখা ইত্যাদি কাজ হাতের মোয়া নয়। অন্তত আমার জন্য। এগুলো করতে গিয়ে প্রতিবার আমার কপালের উপরে অথবা জুলফিতে একটা করে চুল পাকে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যখন চুল আঁচড়াই, তখন পাকা চুলগুলো জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু এতো কিরিঞ্চির পর বৃত্তি না পেলে মনে হয় পুরো কষ্ট পানিতে গেলো। তখন নিজেকে সান্ত্বনা দিই এই বলে, আমি মাত্র প্রথম বর্ষে। এখনো ঝুলিতে ভালো মানের পাবলিকেশন নেই, এক্সট্রা কারিকুলার অভিজ্ঞতাও তেমন নেই। একটা, দুটো মানসম্মত পেপারের মালিক হলে আবেদন আরও জোরদার হবে। তখন হয়তো বৃত্তি পাওয়ার সম্ভাবনাও বাড়বে। তাই আপাতত গড়পড়তা প্রোফাইল নিয়ে আবেদন করছি আর ধরে রাখছি কিছু পাবো না। তারপরও কি মনটা খারাপ হয় না? হয়। সেজন্যই খুব একটা উত্তেজিত বোধ করছি না। খালি মনে হচ্ছে একটা অ্যাওয়ার্ড পেলে বর্তে যেতাম। ব্যাংক ব্যালেন্সটা জোরদার হতো।
যা হোক, কিছু পেলে তো ভালো, না পেলেও মন খারাপ জিইয়ে রাখার মানে নেই। আমিও চেষ্টা করি মন খারাপকে দূরে পাঠিয়ে দিতে। যখন অনেক বেশি খারাপ লাগে, বইপত্র বন্ধ করে চালিয়ে দিই অ্যামাজন প্রাইম বা এইচবিও বা অ্যাপল টিভি। বিঞ্জ ওয়াচ করি কোনো একটা টিভি সিরিজ। কয়েকদিন আগে দুর্বার গতিতে শেষ করেছি টেড ল্যাসো এবং দা মর্নিং শো। দেখার পর চাঙা লাগছিলো খুব। চাঙা হয়ে দুর্বার গতিতে শেষ করেছি প্রজেক্টের কিছু কাজ। এরপর ব্যাক টু ব্যাক দেখেছি দুটো মুভি – বলিউডের ‘জলসা’ আর হলিউডের ‘মাস্টার’। এরপর আবার তরতর করে প্রজেক্টের কাজ এগিয়েছে। অনেকগুলো মিটিং শেষ করেছি, পেপারের ড্রাফ্ট লিখেছি। একই পদ্ধতি যে আপনার বেলায় কাজ করবে, তা বলা যায় না। নিজের মন খারাপ বা দুশ্চিন্তার ওষুধ নিজেকেই বের করতে হবে।